করোনা নিরাময়ের কথা উল্লেখ না করেই উত্তরাখণ্ডে ড্রাগ লাইসেন্স নিয়েছে পতঞ্জলি! আর কী কী আইন ভেঙেছে রামদেবের সংস্থা?

৭ দিনে একশো শতাংশ করোনা মুক্তির যে দাবি রামদেব করছেন, তার সত্যতা নিয়ে দেশজোড়া বিতর্কের মাঝেই কেন্দ্রের নির্দেশে বন্ধ ওষুধের বিজ্ঞাপন। রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলির থেকে ওষুধ সংক্রান্ত সমস্ত নথি, তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
পতঞ্জলির দাবি, কোভিডের উপসর্গ যুক্ত মানুষের উপর ৩ থেকে ১৫ দিন এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাঁরা প্রত্যেকেই আজ অ্যাসিমটোম্যাটিক। দিল্লি, মেরঠ, আহমেদাবাদে এই ওষুধের ক্লিনিক্যাল কেস স্টাডি চালানো হয়েছিল বলেও বিবৃতিতে বলা আছে।
কিন্তু রামদেবের এই দাবির পরই যে প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়, এই ঘোষণা কতটা আইনসম্মত? আসুন দেখে নেওয়া যাক, ঠিক কোন কোন আইন এবং সরকারি নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে করোনা নিরাময়ের ওষুধ করোনিল বের করয়েছে পতঞ্জলি।

 

আয়ুষ মন্ত্রকের ২১ এপ্রিলের নির্দেশিকা লঙ্ঘন 

গত ২১ এপ্রিল আয়ুষ মন্ত্রক চিরাচরিত ওষুধ ব্যবহার করে কোভিড ১৯ নিরাময় সম্ভব কিনা তা গবেষণা করে দেখার ছাড়পত্র দেয়। সেই সঙ্গে বেশ কিছু শর্তও ছিল। সেই শর্তের মধ্যেই ছিল, যে কোনও পরিস্থিতিতেই এই গবেষণার গতিপ্রকৃতি আয়ুষ মন্ত্রককে নিয়মিত জানিয়ে যেতে হবে।
মঙ্গলবার আয়ুষ মন্ত্রকের বক্তব্যে পরিষ্কার, রামদেবের গবেষণার বিষয়ে সম্যক ধারণাই ছিল না তাদের। যা ২১ এপ্রিলের সরকারি নির্দেশিকা লঙ্ঘন বলে মনে করছেন আইনজ্ঞ মনু সেবাস্টিয়ান। আয়ুষ মন্ত্রক পতঞ্জলির কাছে ড্রাগ কমপোজিশন, টেস্টিং প্রোটোকল, স্যাম্পেল সাইজ, ইন্সস্টিটিউশনাল এথিকস কমিটির ছাড়পত্র এবং সিটিআরআই রেজিস্ট্রেশন চেয়ে পাঠিয়েছে।

 

ভুয়ো দাবির বিজ্ঞাপন রুখতে তৈরি নির্দেশিকা লঙ্ঘন 

২৪ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের (NDMA) আওতায় ঘোষণা করে কোভিড সংক্রান্ত ভুয়ো দাবি করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। পয়লা এপ্রিল আয়ুষ মন্ত্রক নির্দেশিকা জারি করে বলে, ১৯৪০ সালের ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্টের ৩৩(P) ধারা অনুযায়ী সমস্ত রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, কোভিড নিয়ে টিভি, সংবাদপত্র বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো বিজ্ঞাপন বা তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। সেখানে আয়ুষ মন্ত্রকের নাম ব্যবহার করেও বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী প্রচারের সম্ভাবনা যে আছে, নির্দেশিকায় তাও জানিয়েছে মন্ত্রক। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে NDMA তে মামলা হবে।
গবেষণার ফলাফল প্রকাশ্যে নেই অথচ কোভিড ১৯ এর ১০০ শতাংশ নিরাময় দাবি করার মধ্যে দিয়ে রামদেব এই নির্দেশিকাও লঙ্ঘন করলেন। যা ভুয়োর দাবির আওতায় পড়ছে, বলছেন মনু সেবাস্টিয়ান।

 

ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট লঙ্ঘন 

একটা ব্যাপার স্পষ্ট নয়, কীসের উপর ভিত্তি করে উত্তরাখণ্ডের ড্রাগ লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ পতঞ্জলিকে এই ওষুধ তৈরির ছাড়পত্র দিল। আয়ুষ মন্ত্রক উত্তরাখণ্ড সরকারের ড্রাগ লাইসেন্সিং অথরিটির কাছে জবাব তলব করেছে।
এই অবস্থায় কিছু প্রতিবেদনে উঠে আসছে এক মারাত্মক তথ্য। সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে উত্তরাখণ্ডের মেডিক্যাল লাইসেন্সিং অথরিটির জয়েন্ট ডিরেক্টর ডক্টর ওয়াই এস রাওয়াত বলেছেন, দিব্যা ফার্মেসি (পতঞ্জলির শাখা) করোনা সংক্রান্ত কোনও ওষুধের জন্য আবেদন করেনি এবং আমরাও তাদের এই ধরনের কাজের অনুমতি দিইনি। লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছিল ইমিউনিটি বুস্টার কিটস এবং সর্দি, জ্বরের ওষুধের জন্য। আয়ুষ মন্ত্রক থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থার জবাব চাওয়া হয়েছে। উত্তর সন্তোষজনক না হলে অনুমতি বাতিল করা হবে।
আইনজীবী তথা আইনজ্ঞ মনু সেবাস্টিয়ানের মতে, ব্যাপারটা যদি তাই হয়, তাহলে রামদেবের করোনা কিট এই আইনের ‘মিসব্র্যান্ডিং অফ ড্রাগস’ বা কোনও ওষুধের ভুল উপযোগিতা বিজ্ঞাপন ধারা লঙ্ঘন করছে।

 

আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, সিদ্ধ ওষুধের বিজ্ঞাপন বন্ধ 

২০১৮ সালে আয়ুষ মন্ত্রক জানিয়ে দেয়, আয়ুষ ড্রাগসের বিজ্ঞাপন করা যাবে না। কারণ আয়ুষ ড্রাগস রোগ নিরাময় সম্বন্ধীয় ওষুধ নয়।
এক্ষেত্রে রামদেব দাবি করছেন একশো শতাংশ নিরাময়ের। ফলে এক্ষেত্রে আয়ুষ মন্ত্রকের এই বাধ্যতামূলক নির্দেশিকাও লঙ্ঘিত হতে পারে।

 

১৯৫৪ সালের ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ (অবজেকশনেবল অ্যাডভার্টাইজ অ্যাক্ট) লঙ্ঘন 

সবচেয়ে জলজ্যান্ত আইন ভাঙার হয়েছে এই ক্ষেত্রে, এমনটাই মনে করছেন সিনিয়র আইনজ্ঞ তথা নালসার হায়দরাবাদের উপাচার্য ফৈজান মুস্তাফা। এই আইন বলে, রামদেবের সংস্থাকে ভারতের আয়ুর্বেদ ওষুধ সংক্রান্ত সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান তথা নিয়ন্ত্রক পর্ষদ আয়ুষ মন্ত্রকের কাছে ওষুধের গুণাগুণ বর্ণনা করে হাতেকলমে প্রমাণ করিয়ে দেখাতে হবে। সন্তুষ্ট করতে হবে পর্ষদকে। এক্ষেত্রে আয়ুষ মন্ত্রকের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, আয়ুষ মন্ত্রককে এ বিষয়ে অন্ধকারে রেখে ওষুধ বাজারে ছেড়েছেন রামদেব।
উপরের তালিকা থেকেই স্পষ্ট, আইনজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন সরকারি কর্তৃপক্ষকে অন্ধকারে রেখে রাতারাতি করোনা নিরাময়ের দাবি করে ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে একের পর এক আইন ভেঙেছেন, লঙ্ঘন করেছেন সরকারি নির্দেশিকা।

Comments are closed.