জানেন, কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা চার্নকের পাশে সমাধিস্থ বেগম জনসন এই শহরের জন্য ত্যাগ করেছিলেন স্বামী, সন্তান। বন্দি হয়েছিলেন সিরাজের হাতে?

ফেলুদা আপত্তি করল না। একটু ভেবে বলল, তোপসেকে একবার চার্নকের সমাধিটা দেখিয়ে আনব ভাবছিলাম।
লালমোহন বাবু বলে উঠলেন, চার্নক? জব চার্নক?
ফেলুদা বলল, না।
অবাক হয়ে লালমোহনবাবু জানতে চাইলেন, তবে? চার্নক আরও আছে নাকি?
ফেলুদা জানাল, আরও নিশ্চয়ই আছে, তবে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা চার্নক একজনই।
তাঁর নাম জব নয়, জোব। জব হল কাজ, চাকরি। আর জোব হল নাম। যে ভুলটা আর পাঁচজনে করে সেটা আপনি করবেন কেন?
এভাবেই লালমোহনবাবুর উচ্চারণ শুধরে দিয়েছিলেন ফেলু মিত্তির। (গোরস্থানে সাবধান)

সেই জোব চার্নক, দেড় দশক আগে পর্যন্ত যাকে এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা মানা হোত। কিন্তু কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠা কে করেছিলেন, ২০০৩ সালে এই বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে। আর তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতা শহর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছে, সেখানে চার্নক সাহেবের ভূমিকাকে খাটো করা হয়নি, তবে তিনি যে ‘কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা’ এই তকমা বর্জন করা হয়েছে।
তাই বলে চার্নক সাহেবকে নিয়ে বাঙালির আবেগ কি কমে গেছে? তা একেবারেই না। ১৬৩০ সালে ইংল্যন্ডে জন্ম, আর মৃত্যু এই খাস কলকাতায়, সালটা ১৬৯৩। চার্নক সাহেবকে সমাধিস্ত করা হয়েছিল সেন্ট জন্স চার্চ চত্বরে, তখন এটা ছিল কবরস্থান। আসলে আজকের এই চার্চটি তখনও পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। চার্নক সাহেবের মৃত্যুর প্রায় ৯০ বছর পরে গড়ে উঠেছিল চার্চ।

আসলে ৩২৫ বছর ধরে কলকাতার স্রষ্টা ঘুমিয়ে রয়েছেন কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের এই চার্চ সংলগ্ন চত্বরে। জোব চার্নককে নিয়ে ইতিহাস একটু হলেও নীরব, খুব বেশি তথ্য আমাদের কাছে নেই। প্যারীচাঁদ মিত্র একদা চার্নক সাহেব প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘Calcutta owes its origin to Job Charnock, the agent of the East India Company at Hugli. In 1678-79 he married a Hindu Lady Whom he rescued from being burnt as a Sati. He took a liking to Calcutta because In going to and Coming from Hugli, he halted at Baithak khana under the shade of an umbrageous tree and enjoyed the repose of his huka. Charnock was molested by the foujdar at Hugli and he decided upon making the site where the tree stood, the scene of his future Labors.’

আসলে চার্নক সাহেবকে নিয়ে এইরকম কিছু কিছু ছোট গল্প জানা যায়।
এবার না হয় আসা যাক তাঁর সমাধি প্রসঙ্গে। সমাধিতে যে স্মৃতি ফলকটি রয়েছে, তাতে জোবাস শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে জোবাস হল জোবের ল্যাটিন সংস্করণ, আর পুরো ফলকটাই ল্যাটিন ভাষায় লেখা। ভালোভাবে দেখলেই ডি-ও—এম শব্দটি আপনার চোখে পড়বে, যার অর্থ, ডমিনুস অমনিউম ম্যাজিস্টের। অর্থাৎ, ঈশ্বর সকলের কর্তা।
বাংলায় মধ্যযুগের শেষদিকে যেরকম মন্দির নির্মাণ করা হত, এই সমাধি নির্মাণের ক্ষেত্রেও সেইরকম বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন, একরত্ন প্রকৃতির, তাছাড়াও অষ্টভুজাকৃতি রাসমঞ্চের ন্যায় এই সমাধি, বড় স্ট্রাকচারের উপর একটি ছোট স্ট্রাকচারও রয়েছে, যা দেখতে অনেক দোতলা রাসমঞ্চের মতো। যা কিনা আজও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এই পর্যন্ত তো অনেকেই জানেন। কিন্তু জানেন কি, চার্নকের সমাধির পাশে সাদা রঙের সমাধিটি কার? কে শুয়ে আছেন কলকাতার প্রতিষ্ঠাতার পাশে?
চার্নকের পাশের সমাধিটা বেগম জনসনের, তবে তাঁর আসল নাম মিস ফ্রান্সিস ক্রূক। বেগম নামটা শুনে হতবাক হতে পারেন। ভাবতে পারেন, ফ্রান্সিস ক্রূক কীভাবে বেগম জনসন হলেন?

আসলে ফ্রান্সিস ক্রূকের বাবা ছিলেন এডয়ার্ড ক্রূক, যিনি করমণ্ডল উপকূলের কাছে অবস্থিত একটা ফোর্টের গর্ভনর ছিলেন। ফ্রান্সিসের গোটা জীবনই, বিশেষ করে বৈবাহিক জীবন অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। তাঁর প্রথম স্বামী ছিলেন টেম্পলার। ১৩ বছর বয়সে ফ্রান্সিসের প্রথম বিয়ে, কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হল না। টেম্পলার মারা গেলে ফ্রান্সিস চলে এলেন কলকাতায়। দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন জেমস এলথাম। কিন্তু বিয়ের এক মাসের মধ্যেই মারা যান তিনি। এরপর ফ্রান্সিস বিয়ে করলেন উইলিয়াম ওয়াটসকে। ওয়াটস ছিলেন ইংরেজ অফিসার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, ঠিক বিয়ের পর সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করলে ফ্রান্সিস তিন সন্তানসহ আটক হলেন সিরাজের সেনার হাতে। কিন্তু নাবালক শিশুসহ মহিলাকে আটক করার বিষয়টি ভাল চোখে নেননি সিরাজের মা। তাই মুক্তি পেলেন তিনি। আর এই সময় থেকেই তাঁর নামের আগে যুক্ত হল ‘বেগম’ শব্দটি। এরপর সস্ত্রীক দেশে ফিরলেন ওয়াটস সাহেব, কিন্তু সেখানে গিয়ে কয়েক বছর বাদে মৃত্যু হয় ওয়াটসের।
স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের ইংল্যন্ডে রেখেই কলকাতায় ফিরে এলেন বেগম। এরপর করলেন জীবনের চতুর্থ এবং শেষ বিয়ে, সালটা ১৭৭৪। বিয়ে করলেন সেনা অফিসার উইলিয়াম জনসনকে। তখন থেকে তিনি পরিচিত হলেন বেগম জনসন নামে। এই বিয়েও বেশি দিন স্থায়ী হল না। জনসন ইংল্যন্ডে ফিরে গেলেন। কিন্তু কলকাতার বা দেশের টানে বেগম জনসন গেলেন না স্বামীর সঙ্গে। থেকে গেল কলকাতায়, একা। তৃতীয় স্বামীর মৃত্যু পর যিনি সন্তানদের ছেড়ে একাই জাহাজে চেপে চলে এসেছিলেন কলকাতায়, তিনিই চতুর্থ স্বামী ইংল্যন্ডে ফিরে গেলেও, নিজের দেশে থেকে গেলেন। এই রঙিন চরিত্রের মানুষটি মারা মারা গেলেন ১৮১২ সালে, বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বেগম জনসনকে সমাধিস্থ করা হল শহরের প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নকের সমাধির পাশে।

চার্চ চত্বরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে আর্কিওলোজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বড় করে একটি বোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছেন, যেখানে এই চার্চটিকে প্রোটেক্টড মনুমেন্টের আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তথ্য বলছে, The West Bengal Preservation of Historical Monuments and Objects and Excavation of Archaeological Sites Act, 1957.(West Bengal Act XXXI of 1957) অনুসারে, চার্নক সাহেবের সমাধিটা স্টেট প্রোটেক্টড মনুমেন্টর আখ্যা পেয়েছে। অর্থ্যাৎ, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যে রাজ্য সরকারের তা বুঝতে অসুবিধা নেই। আসলে সমস্যাটি হল এখানেই। আইনতভাবে এটি রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু সবরকম রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে চার্চ কর্তৃপক্ষ।
‘আমাদের চার্চের ভিতরে যতগুলো সমাধি রয়েছে সবগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ আমরাই করি, আমাদের নিজস্ব যা ফান্ড আছে সেই মতোই রক্ষণাবেক্ষণ হয় আর কি। রাজ্য সরকারের ভুমিকা প্রথম থেকেই কিছু ছিল না।’ জানালেন রঙ্গন দত্ত, যিনি বর্তমানে চার্চ অফিসার পদে রয়েছেন।
শীতের দুপুরে ময়দানের আড্ডা সেরে অনেকেই উপস্থিত হন এই চার্চ চত্বরে। শুধু চার্নক সাহেবের সমাধি দেখতে নয়, গোটা চার্চটিকে দেখতে। ১৭৮৭ সালে এই চার্চ খুলে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ মানুষের জন্য। চার্চের জন্য জমি দিয়েছিলেন শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ। আর চার্চ নির্মাণের খরচ জোগাড় করার উদ্যোগটা নিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। ১৭৮৭ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত এই চার্চের অ্যাংলিকান ক্যাথেড্রাল ছিলেন সেন্ট জন্স। আজও এই চার্চ আর চার্চ অভ্যন্তরস্থ সবকটি সমাধি সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করছেন চার্চের লোকজন। আশেপাশের পরিবেশ এক মুহূর্তে মন ভাল করে দেয়। তাই শীতের দুপুরে

কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে চার্চ ঘোরা একটা অন্যরকম অনুভুতির সাক্ষী থেকে যায়। ঘুরতে ঘুরতে কয়েক’শ বছর পিছিয়ে যাওয়া যায়। বাঙালির ইতিহাস প্রেম তো আর আজকের নয়, আর এই চার্চের পরতে পরতে এখনও রয়েছে ইতিহাসের গন্ধ। সেই ইতিহাস এই শহরকে ভালোবাসার ইতিহাস। কারণ শুধু এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক নন, তাঁর পাশের সমাধিতে শুয়ে রয়েছেন ব্রিটিশ মহিলা বেগম জনসন, যিনি এই শহরের টানে, কলকাতার টানে সন্তান থেকে স্বামী সব ত্যাগ করেছেন। হয়তো, তাঁর পরিচিতি নেই তত, কিন্তু জোব চার্নকের মতোই বেগম জনসনের জীবনও কলকাতার সঙ্গে জুড়ে আছে একই রকমভাবে।

Comments are closed.