যুদ্ধে সিগনাল দিতে চিনে তৈরি হয়েছিল ফানুস, আর বিডন স্ট্রিটের দত্ত বাড়িতে কালী পুজোর ফানুস বানানো এক প্রাচীন ঐতিহ্য

স্কাই ল্যান্টার্ন, যাকে আমরা ফানুস বলে জানি। ‘ল্যান্টার্ন’ শব্দের উৎপত্তি গ্রীক শব্দ থেকে। কিন্তু ফানুস প্রথম তৈরি হয়েছিল কোথায়? ইতিহাস বলছে, ফানুস প্রথম তৈরি হয়েছিল প্রাচীন চিন সাম্রাজ্যে। পরবর্তীকালে বাণিজ্যের জন্য পর্তুগিজ বণিকরা চিনে যান, আর তাঁদের হাত ধরেই এই ফানুস পৌঁছোয় ইউরোপে এবং গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ফানুস এবং তা তৈরির টেকনোলজি। কিন্তু চিনাদের ফানুস তৈরির কারণটা কি শুধুই মনোরঞ্জন? আজ্ঞে না! পুরোটাই ছিল প্রয়োজনের খাতিরে।
শত্রু দ্বারা পরিবৃত্ত হলে তার থেকে মুক্তির জন্য ফানুস ওড়ানো হত সাহায্যের তাগিদে। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের চিনের বিখ্যাত যুদ্ধ বিশারদ ছিলেন জুগে লিয়াং, যাঁকে অনেকে কনমিং নামেও চেনেন। তাঁর যুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অগাধ। কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে যুদ্ধ চলবে সেটারই নির্ধারক ছিলেন লিয়াং। তাঁর দৌলতে বহু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল শু হান রাজবংশ। বিখ্যাত ঐতিহাসিক জোসেফ নিধাম মত প্রকাশ করেছেন, চৈনিক সাম্রাজ্যে এই ফানুসগুলো সিগনালের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হত। এই ফানুস যে লিয়াং এর মস্তিষ্কপ্রসূত সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ফানুসকে চিনে কনমিং ল্যান্টার্ন নামেও অভিহিত করা হয়। এখনও অবশ্য বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ম করে ফানুস ওড়ানোর প্রথা রয়েছে চিনে। তাইওয়ানে আবার একধাপ এগিয়ে বাৎসরিক ফানুস উৎসবেরও চল রয়েছে, অন্যদিকে থাইল্যান্ডে ফানুসের নাম খোম লোই, যার অর্থ ভাসমান লন্ঠন।
আর আমাদের দেশ কিংবা শহর কলকাতায় ফানুস এল কোথা থেকে। অনেকে মনে করেন, ইংরেজদের হাত ধরে এই শহরে ফানুস এসেছিল। এরকম মনে করাটা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিকও নয়, কেননা ইংরেজরা কলকাতাকে আলোকিত করতে উদ্যোগী হয়েছিল। আলোর রোশনাইতে মুড়ে ফেলতে চেয়েছিল শহর। তাদের হাত ধরে যে ফানুস আসবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আর এক তথ্য বলছে, এই ফানুস ব্যবহার ইংরেজদের আসার আগে থেকেই বাংলার নবাবরা মজ্জাগত করেছিলেন। তুর্কী আমল থেকেই ফানুস ব্যবহার করেছিল বাংলা। এরকমও উদাহরণ রয়েছে, নবাবি আমলে সেনাবাহিনী অন্দরমহল থেকে ফানুস ছাড়ত, কিন্তু সেই ব্যবহার সাধারণ মানুষের মধ্যে তখনও পৌঁছোয়নি। আবার অন্যদিকে, ইংরেজরা অযোধ্যা দখল করে নিলে, অযোধ্যার নবাবের ঠাঁই হল মেটিয়াবুরুজে। নিজের মেটিয়াবুরুজের প্রাসাদে বসে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ মাঝে মাঝে নাকি আলোকিত উড়ান ছাড়তেন। ১৮৭০–৮০ র দশকে নাকি মেটিয়াবুরুজ থেকে ছাড়া ফানুসগুলো উড়ে বেড়াতো গঙ্গার দু’পাশ দিয়ে, যা অবাক হয়ে দেখতেন মানুষজন। ইতিহাস সেই সব দিনেরও সাক্ষী রয়েছে।

পরবর্তীকালে এই ফানুসের ব্যবহার বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে অবশ্য কলকাতার উচ্চবিত্ত মানুষের বাড়ি থেকে ছাড়া হত ফানুস, যার বেশিরভাগটাই ছিল উত্তর কলকাতাজুড়ে। সেই সঙ্গে একটা সময়ে নিয়ম করে ফানুস ওড়ানোর প্রতিযোগিতাও বসানো হত। অনেকে আবার এই ট্র্যাডিশনকে ‘বাবুয়ানা কালচার’ বলেও ব্যঙ্গ করেছেন। তারপর ধীরে ধীরে ফানুস ছড়িয়ে পড়তে লাগল সাধারণ মধ্যবিত্তদের মধ্যে। আর হালে কালী পুজো উপলক্ষে বাংলার ঘরে ঘরে এই ফানুস ওড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকা খরচ করলেই আপনার হাতে চলে আসবে রঙিন ফানুস। কিন্তু হঠাৎ কালী পুজো কেন? ফানুস ওড়ানোর কি কোনও আলাদা কারণ আছে?
সেইরকম আহামরি কোনও ট্র্যাডিশন কিন্তু নেই। একে তো অমাবস্যার রাত, আকাশ অন্ধকার থাকে। রঙ-বেরঙের ফানুস আলোকিত করে আকাশকে। আর তার উপর বাঙালির কালী পুজো! কবে থেকে কালীপুজোতে ফানুস ছাড়া হয় সে নিয়ে প্রমাণ নির্ভর কোনও তথ্য আপাতত নেই।

‘আরে মশাই বাজারে যা দেখেন, সব তো চাইনিজ ফানুস। কলকাতার মানুষজন আজকাল তো আর নিজেরা ফানুস তৈরি করতে ভুলেই গেছেন। একটা সময় ছিল উত্তর কলকাতাজুড়ে বনেদি বাড়িগুলোতে ফানুস তৈরি হোত’, জানাচ্ছিলেন বর্তমানে বিডন স্ট্রিটের ভোলানাথ ধামের বাসিন্দা অজয় দত্ত। আসলে ফানুস তৈরি অজয়বাবুর একটা নেশা আর কী! বাড়ির দুর্গা পুজো ১১৪ বছরের পুরনো, লক্ষ্মী পুজোর পর থেকে শুরু হয়ে ফানুস তৈরির কাজ। স্নান, খাওয়া ছেড়ে লেগে পড়া হয় ফানুস তৈরিতে। ছেলে অরিন্দম দত্তও বাবার সাথে হাত লাগান ফানুস তৈরিতে। বাবা-ছেলে ছাড়াও অজয়বাবুর কিছু ছাত্র রয়েছেন, যাঁরা নিজেরাই তাঁকে সাহায্য করতে এসে পড়েন।

‘জানেন তো, এখন খুব কমসংখ্যক মানুষজন রয়েছেন যাঁরা ফানুস তৈরির প্রযুক্তি জানেন। আমাদের জেনারেশনের পর যাতে ফানুস তৈরি করে ওড়ানোর প্রবণতা কমে না যায়, তাই আমি আমার ছাত্রদের এই ফানুস তৈরির প্রযুক্তি শিখিয়ে যাচ্ছি আর কী, বললেন বিডন স্ট্রিটের অজয় দত্ত। তিনি নিজে নিয়ম করে ফানুস তৈরির ওয়ার্কশপও করেন। বাবা, ঠাকুরদার কাছ থেকে ফানুস তৈরি শিখেছেন অজয়বাবু। নিজের নাতি ও ছেলেকে সেই শিক্ষাই দিয়ে যেতে চান তিনি।

অজয়বাবুর ছেলে অরিন্দম দত্ত বললেন, ‘আমি নিজে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আমাদের জেনারেশনের মধ্যে ফানুস তৈরির লোকজনের অভাব। ছোটবেলা থেকেই দেখছি, বাবা ফানুস বানাচ্ছে। তখন থেকেই আমার ফানুস তৈরির প্রতি ভালবাসা জন্মায়। এটা একটা নেশার মতো হয়ে গেছে এখন। আর জানেন তো, তৃপ্তি আসে তখনই যখন দেখি আমার চার বছরের ছেলেও ফানুস তৈরিতে মজে গেছে।’ দত্ত বাড়িতে নিয়ম করে কালী পুজোর দিন এখনও ফানুস ওড়ানো হয়। এটাই ট্র্যাডিশন! বাড়ির কালী পুজো মোটামুটি ১৪৪ বছরের পুরনো। পুজোর দিন ফানুস ওড়ানো হচ্ছে সেই ১৯২৫ সাল থেকে। ফানুস ওড়ানো দেখার জন্য কালী পুজোর দিন বাড়িতে ভিড় করেন অনেক মানুষ। পা ফেলার জায়গা থাকে না। এবছর যে ফানুস ওড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে দত্ত বাড়ি তা শুনলে অবাক হয়ে যেতে পারেন! ১৫০ ইঞ্চি বা তার থেকেও বড় ফানুস ওড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে দত্ত বাড়ির অজয় দত্ত।
কিন্তু বর্তমানে এই শহর কলকাতায় বাড়িতে ফানুস তৈরির প্রবণতা প্রায় নেই বললেই চলে। এটা বাঙালি কালচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল, তবে কেন আজকাল বাঙালি ফানুস তৈরি থেকে মুখ ফিরিয়েছে?

আসলে ফানুস তৈরির জন্য প্রয়োজন এক বিশাল জায়গার আর সময়েরও। তাহলে কি জায়গা আর সময়ের অভাবে বাঙালি ফানুস তৈরী করছে না? আজ্ঞে না! আসল হচ্ছে শখ এবং ইচ্ছে। পাশাপাশি এর টেকনজিও জানেন না বেশি মানুষ। কিন্তু এই কালচারটা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন একটু সময়ের, নাহলে ধীরে ধীরে তো এই ট্র্যাডিশন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিডন স্ট্রিটের এই দত্ত বাড়ি এখনও টিকিয়ে রেখেছেন পরিবারের এই পুরনো ঐতিহ্য, যাতে বাড়িতে ফানুস বানানোর পরম্পরা ঠাঁই না পায় ইতিহাসের পাতায়। আর কালী পুজোর রাতে এলাকার আকাশ যেভাবে তাঁদের ফানুসের আলোয় ঝলমল করে, যা দেখতে জড়ো হন স্থানীয় মানুষজন, সেটাও দত্ত পরিবারের এক পরম পাওয়া।

[ফানুস এবং অন্যান্য ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন the bengal story র ইউটিউব চ্যানেল]

Comments are closed.