শ্যামলদার লড়াইয়ে কোনও দাঁড়ি নেই, কমা আছে। এ লড়াইয়ে আমরা জিতবই, তিনি বলতেন, ‘যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর তা আজও আমরা দেখিনি’

সেদিন কলকাতা বিমানবন্দরে নামার কথা ছিল ম্যাকনামারার। ভিয়েতনাম যুদ্ধের কুখ্যাত নায়ক রবার্ট ম্যাকনামারা। বাংলার বামপন্থী ছাত্র-যুবরা শপথ নিয়েছিল কিছুতেই তাঁকে বাংলার মাটিতে নামতে দেবে না। সেদিন একদিকে ছিল শাসকের পুলিশ, ব্যারিকেডের অন্যপ্রান্তে ছিল সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীর নেতৃত্বে হাজার হাজার ছাত্র যুব কমরেড। সেদিন প্রায় চার ঘণ্টা যুদ্ধ চলেছিল পুলিশ আর জনতার। সেই যুদ্ধে ম্যাকনামারা আর বিমানবন্দর থেকে নেমে সরাসরি গাড়িতে করে যেতে পারেননি। এমনই ছিল ‘৬০- ৭০ দশকের দামাল দরিয়ার দক্ষ চালক শ্যামল চক্রবর্তীদের আখ্যান। তাদের লড়াই এর প্রত্যেকটা কাহিনী নিয়ে যে কোনও দিন হতে পারে সিনেমার গল্প বা পুরস্কার জয়ী উপন্যাস। তবে সেই কাহিনীর বাস্তবের চরিত্র ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তীরা।
সেই দূরন্ত সময়ে যাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন এক নতুন পৃথিবী, দেশ ও বাংলা গড়ার, তার অন্যতম নায়ক ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। শ্যামল চক্রবর্তী মানে শুধু একজন অসাধারণ ছাত্রনেতা, শ্রমিক নেতা, সাংসদ কিংবা মন্ত্রী না, বর্তমান ছাত্র প্রজন্মের কাছে তিনি তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। শ্যামল চক্রবর্তী ছিলেন আমাদের অভিভাবক। আমাদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, এমনকী ব্যক্তিগত সংকটের মুশকিল আসানের নাম।
সেই ৬০- ৭০ -এর দশকের এক উত্তাল সময়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য সঠিক পথে রাখা ছিল কঠিন। একদিকে খাদ্য আন্দোলন। ৬২’ তে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়েছেন অসংখ্য বামপন্থী ছাত্র-যুব নেতা। অন্যদিকে ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে দুর্বার গতিতে এগিয়েছে সেই ছাত্র আন্দোলন। তারপর ১৯৬৬ র খাদ্য আন্দোলন, যেখানে নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইতরা শহিদ হয়েছিলেন। একদিকে যখন শাসকের আক্রমণ তীব্র হচ্ছে, অন্যদিকে লক্ষ্যে অবিচল, আদর্শে অনমনীয় ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তীরা। শুধুমাত্র আদর্শ, দুরন্ত জেদ এবং সাংগঠনিক বোঝাপড়াকে সম্বল করে সেইদিনগুলিতে গোটা ছাত্র সমাজকে যাঁরা নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী।
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু সুভাষ চক্রবর্তী বারবার কমিউনিস্টদের কয়েকটা গুণের কথা বলতেন- ”বাজপাখির শ্যেন দৃষ্টি, সিংহের হৃদয় এবং মায়ের মমতা,” এই তিনটি গুণই পুরোমাত্রায় ছিল শ্যামল চক্রবর্তীর মধ্যে।
তাঁরা জানতেন মানুষের খিদের যন্ত্রণা কেমন। পূর্ব বাংলার ছিন্নমূল পরিবারের সন্তান সুভাষ এবং শ্যামলরা জানতেন দেশভাগের যন্ত্রণা কী। তাঁরা জানতেন ধর্মের বিষ কীভাবে সর্বনাশ করে দিতে পারে অসংখ্য পরিবারের। ১৯৪৩ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি ওপার বাংলায় জন্মানো শ্যামল চক্রবর্তীর জীবনটাই শুরু হয়েছিল দাঙ্গা ও দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। এপারে এসে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাসা বেধেছিলেন প্রথমে নদিয়ার কুপার্স ক্যাম্পে। তারপর দমদমে। পদে পদে তাঁরা অনুভব করেছিলেন খিদের যন্ত্রণা কতটা পীড়াদায়ক। সে কারণেই তো খেটে খাওয়া মানুষের জন্য আজীবন নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রক্ষায় এক অবিচল সৈনিকে পরিণত হয়েছিলেন তাঁরা। আমরা এসএফআইয়ের ৫০ বছরের জন্মবর্ষে শিক্ষা, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা বলি। পঞ্চাশ বছর আগে যখন সংশোধনবাদ, অন্যদিকে সংকীর্ণতাবাদীর ঝোঁক তৈরী হচ্ছিল কমিউনিস্ট আন্দোলনে, সে সময় ছাত্র আন্দোলনেও তার প্রভাব পড়েছে। স্পষ্ট হয়েছে বিভাজন। সেখান থেকেই জন্ম নেয় ছাত্র ফেডারেশন। যদিও তার পরবর্তীতে অনেকগুলো মিটিংয়ের মাধ্যমে, বেলঘরিয়া, নেতাজিনগর, দমদমে একটার পর একটা সভা হয়েছে। অবশেষে ১৯৭০ সালে কেরলের তিরুবনন্তপুরমে এসএফআইয়ের জন্ম হয়। সেই জন্মলগ্ন থেকে ৫০ বছর যাঁরা কারিগর হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী। ১৯৭৩ সালে শিবপুর রাজ্য সম্মেলন থেকে এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। সম্পাদক হন সুভাষ চক্রবর্তী। দু’জনেরই ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি দমদম থেকে। দমদমে খুব কাছাকাছিই ছিল দুই বন্ধুর বাড়ি। আমার বাড়িও যেহেতু দমদমেই, যখনই অতীতের সংগ্রাম, লড়াইয়ের গল্প শুনেছি সেখানে উঠে এসেছে শ্যামল-সুভাষ জুটির কথা। একদিকে পুলিশ প্রশাসন অন্যদিকে নকশালবাড়ির আন্দোলন যখনই তীব্র হয়েছে, যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন এই দুই কমরেড তা কখনওই ভোলা যাবে না। তবে এই দ্বিমুখী রাজনৈতিক লড়াই প্রতিহত করার পাশাপাশি শিক্ষা সংগ্রামের, আত্মত্যাগেরর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তাই রাজনীতির সঙ্গে পড়াশোনার সঙ্গেও সম্পর্ক অটুট ছিল শ্যামল চক্রবর্তীর। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ডবল প্রোমোশন পেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠেন। পড়তেন দমদমের বৈদ্যনাথ ইনস্টিটিউটে। এরপর দমদমের মতিঝিল কলেজ ও বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। মতিঝিল কলেজে পড়ার সময়ই তাঁর ছাত্ররাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁর। বিদ্যাসাগর কলেজে জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৭৪ এ এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। সেই সম্মেলন থেকে সর্বভারতীয় সহ সভাপতি নির্বাচিত হন শ্যামল চক্রবর্তী। এরপর ১৯৭৯’র জানুয়ারিতে (মতান্তরে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর) ব্যারাকপুরে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলন থেকে অব্যাহতি নেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে পাটনায় অনুষ্ঠিত এসএফআই এর তৃতীয় সর্বভারতীয় সম্মেলন থেকে ছাত্র আন্দোলন থেকে অব্যাহতি নেন। ওই সম্মেলন থেকেএসএফআই এর সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন নেপালদেব ভট্টাচার্য, সভাপতি হয়েছিলেন এম এ বেবি।
সেই সময়কার যে ‘পঞ্চ পান্ডব’ এর কথা বলা হত, তারা ছিলেন- সুভাষ চক্রবর্তী , শ্যামল চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু এবং অনিল বিশ্বাস। এখন বুদ্ধবাবু শারীরিক অসুস্থতার কারণে আর বাইরে বেরতে পারেন না। চলে গিয়েছেন অনিল বিশ্বাস, সুভাষ চক্রবর্তী। এবার চলে গেলেন শ্যামলদাও। এঁদের যে বন্ধুত্বের সাক্ষ্য দেখেছি, যে আত্মত্যাগ, আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে বাংলা তাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি আমরাও। শ্যামলদার চরিত্রের আরও যে বিষয়টি আমাকে তীব্র আকৃষ্ট করত, সেটা তাঁর বহুমুখী কাজকর্ম। ছাত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যেমন খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন, তেমনই ছিল তার পড়াশোনা ও লেখনী শক্তি। সুলেখক শ্যামল চক্রবর্তী সেই সময়ের কাহিনি লিখে গিয়েছেন ‘৬০-৭০ ছাত্র আন্দোলন’ শীর্ষক বইয়ে।
আবার বয়সের বেড়া ডিঙিয়ে খুব সহজেই মিশে যেতেন তরুণদের সঙ্গে। তাই তাঁর জীবনের শেষ কটা দিনেও দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষকে বার্তা দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি। আমরা যখন বলতাম, আপনি আবার এই সোশ্যাল মিডিয়ার বিতর্ক- বিবাদে জড়াচ্ছেন কেন, শ্যামলদার সহজ উত্তর ছিল, ‘মানুষকে বোঝাতে হবে তো!’ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কোনও বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেওয়ার যে সহজাত গুণ তা শ্যামলদার মধ্যে ছিল।উনি বলতেন, আমাদের লড়াই করতে গেলে সবচেয়ে আগে জানতে হবে নিজেদের শিকড়, সমাজ, রাজ্য, ইতিহাস, ভূগোল। জানতে হবে নিজেদের দেশটাকে। সেই লক্ষ্যে আগামী প্রজন্মকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে প্রচুর বই লিখে গিয়েছেন শ্যামলদা। আজকের দিনে ভারতবর্ষজুড়ে যে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা হচ্ছে, তা নিয়েও লিখে গিয়েছেন শ্যামলদা। যেমন বাগ্মী, তেমনই ছিল তাঁর লেখনী শক্তি। মানুষের হৃদয় জয় করার সহজপাঠও আমরা পেয়েছি শ্যামলদা’র কাছে। মনে আছে দিল্লিতে এসএফআইয়ের সেন্টারে যখন কাজে গিয়েছি কীভাবে ফোন করে খবর নিতেন তিনি। দিল্লিতে বাঙালি খাবার মেলা কঠিন, তাছাড়া অন্য একটা সংস্কৃতিয়ে মানাতে সময় লাগে। এই ছোট্ট ছোট্ট জিনিসগুলোও বুঝতেন শ্যামলদা। একইসময়ে দিল্লি গিয়েছি হয়ত, সেই সময় শ্যামলদার ফোন আসবেই। খবর নিতেন কী খেয়েছি। খেতে এবং খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন তিনি। বঙ্গভবনে উঠলেই ফোন করে বলতেন, ‘রাত্রে চলে আসবি, আমার এখানে খাবি।’ ডুয়ার্সে চা বাগানে গবেষণার কাজ করতে গিয়েও ওনার সহায়তা ও পরামর্শ ভীষণ সহায়তা করেছিল।তরুণ কমরেডদের প্রতি এমনই অপত্য স্নেহ ছিল তাঁর। শ্যামল চক্রবর্তীর ‘৬০-৭০ ছাত্র আন্দোলন’বইটির ড্রাফট তৈরিতে তাঁকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছিলেন তরুণ কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত। ওকে শ্যামলদার কাছে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের পশ্চিমবঙ্গের তখনকার এসএফআই এর রাজ্য সম্পাদক শুভদা (দেবজ্যোতি দাস)। আমাকে যেটা ব্যক্তিগত ভাবে যন্ত্রণা দেয় তা হল শ্যামলদা চলে যাওয়ায় এই বইটির দ্বিতীয় পর্বের কাজ অসমাপ্ত থেকে গেল।
সুদীপ্তর মতো কমরেডদের তিনি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশেছেন যে শ্যামলদা, ছাত্র রাজনীতির মহীরুহ, আশা করেছিলাম এবারেও ফাইট ব্যাক করবেন। আমরা বলতাম, সুভাষদা আর শ্যামলদা জুটি ঠিক শোলের জয় ও বীরুর মতো। কী অদ্ভুত সমাপতন দেখুন, সুভাষ চক্রবর্তী চলে গিয়েছিলেন ৩ রা অগাস্ট এক বৃষ্টিঝরা দিনে। অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু শ্যামলদারও মৃত্যু হল অগাস্টের ৬ তারিখ, আর এক বৃষ্টিভেজা দিনে।
করোনার আবহে মানব সভ্যতার সামনে আসা সংকটের মধ্যে শাসকরা যখন একটার পর একটা জনবিরোধী নীতি প্রয়োগের চেষ্টা করছে, সেই সময় তা প্রতিহত করতে যে সাহস ও অনুপ্রেরণা লাগে তা শ্যামলদা’রাই দিতে পারতেন। প্রশ্নাতীতভাবে এই সময়টা আমাদের কাছে কঠিন। কিন্তু শ্যামলদাদের লড়াইয়ের যে অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন সেটাই তরুণ কমরেডদের কাছে পাথেয়। শ্যামলদা’দের সেই ম্যাকনামারাকে আটকানো, কলেজ স্ট্রিট ছাত্র আন্দোলন, মতিঝিল, বিদ্যাসাগর কলেজের দিনগুলির আন্দোলনের স্মৃতি ফিকে হবে না। কলকাতার পুরোন ট্রামেদের সারিরা জীবনানন্দের মতই শ্যামল-সুভাষ জুটির নাম মনে রাখবে। শুধু শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকবে না জয় ও বীরু। প্রজন্মান্তর হবে ওঁদের লড়াইয়ের আখ্যান। যা গড়ে তুলবে সুদীপ্ত গুপ্তর মতো কমরেডকে। মহানগর মহামারি পার করবে সেদিনের দামাল ছাত্রদের পায়ের চিহ্ন গায়ে এঁকেই। কোন শ্রাবণ সেসব ধুয়ে দিতে পারবে না। শ্যামলদার লড়াইয়ে কোনও দাঁড়ি নেই, কমা আছে। শ্যামলদা লড়াই চলবে, তুমি ঘুমোও। এ লড়াইয়ে আমরা জিতবই। নাজিম হিকমতের যে কবিতা শ্যামলদা আবৃত্তি করতেন, সে ভাষায় বলা যায়,

“যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠেনি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলিনি।”

Comments are closed.