(২০ মার্চ, ২০২০ টমাস পুয়োর করোনা সংক্রান্ত এই গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় medium.com এ। জানা যাচ্ছে, প্রকাশিত হওয়ার পর ৫ দিনে গোটা বিশ্বে ১ কোটি মানুষ এই লেখা পড়েন। ৩৭ টি ভাষায় মূল লেখাটি অনুবাদ হয়েছে। হুবহু অনুবাদ করে আমরা তা প্রকাশ করছি তিন পর্বে। আজ দ্বিতীয় পর্ব। অনুবাদ করেছেন অনির্বাণ দাশ।)
আগের পর্বে আমরা দেখেছিলাম করোনা মোকাবিলায় ফ্রান্স, ইংল্যান্ড কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে। এই পর্বে পর্যালোচনা মিটিগেশন ও সাপ্রেশন পদ্ধতি নিয়ে।
দেশগুলোর এই দুটি তালিকা আসলে করোনাভাইরাস মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুটি পথের হদিশ দেয়। প্রথম পথটি মিটিগেশন এবং দ্বিতীয়টি সাপ্রেশন। আসুন দেখি এগুলোর অর্থ কী।
উপায় নম্বর ১:
কিছুই না করা
এটা করার আগে আসুন দেখে নিই, আমেরিকার মতো একটি দেশের সাপেক্ষে কিছুই না করা ব্যাপারটা ঠিক কেমন হতে পারে।
আমরা যদি কিছুই না করি: সবাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে, মৃত্যুহার আকাশ ছোঁবে এবং অন্তত ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হবে (নীল বার)।
অঙ্কের হিসেবে: যদি অন্তত ৭৫ শতাংশ আমেরিকান ইনফেকটেড হয় এবং তার ৪ শতাংশ মারা যায়, তাহলে আমেরিকায় মৃত্যু হচ্ছে ১ কোটি মানুষের। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত আমেরিকানদের চেয়ে অন্তত ২৫ গুন বেশি।
আপনি ভাবতেই পারেন, শুনে তো মনে হচ্ছে প্রচুর। আগে অনেক কম সংখ্যার কথা শুনেছিলাম।
ব্যাপারটা কী? নম্বরে কচকচানিতে না গিয়ে শুধুমাত্র দুটি নম্বর মনে রাখুন। কত পরিমাণ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, এবং তাদের মধ্যে কত জনের মৃত্যু হচ্ছে। সুতরাং, মাত্র ২৫ শতাংশ অসুস্থ হয়ে পড়ে (কারণ বাকিদের শরীরে ভাইরাস থাকতে পারে কিন্তু অসুস্থতার কোনও লক্ষণ হয়ত নেই, তাই তারা বাদ) এবং মৃত্যুহার ৪ শতাংশের বদলে ০.৬%। হিসেব করলে দেখা যাবে আমেরিকায় মৃত্যু হচ্ছে ৫ লক্ষ মানুষের।
আর যদি আমরা কিছুই না করি, তাহলে করোনাভাইরাস থেকে মৃত্যু হার ওই দুটি সংখ্যার মধ্যেই কোনও একটিতে ঠেকবে। এই দুই ক্ষেত্রের মূল পার্থক্য মৃত্যুহারে। তাই আমাদের সবার আগে বোঝা দরকার করোনাভাইরাসের ফলে মৃত্যু হয় কীভাবে?
মৃত্যুহারকে কীভাবে দেখা হবে?
এটা সেই আগের গ্রাফ। এবার দেখুন ইনফেকটেড বা আক্রান্ত কিংবা মৃত না দেখে দেখুন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মানুষদের সারণি।
হালকা নীল এলাকায় যারা, তাদের হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন। এবং গাঢ় নীল এলাকার অর্থ হল যে সমস্ত রোগীদের আইসিইউয়ে ভর্তি করা প্রয়োজন। গ্রাফে দেখা যাচ্ছে, এই সংখ্যাটি ৩০ লক্ষের উপর।
এবার এটাকে দেশে ব্যবহারযোগ্য আইসিইউ বেডের সঙ্গে তুলনা করুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ হাজার আইসিইউ বেড আছে এবং এই সংখ্যাকে দ্বিগুণ করা সম্ভব। গ্রাফে এই অংশটি রয়েছে ওই লাল দাগের মধ্যে।
না, এটা ভুল করে করা নয়।
ওই লাল দাগের অর্থ হল আমাদের আইসিইউ বেডের যা সামর্থ। এবার সেই বেডে না থাকা প্রতিটি রোগীরই ওই পরিষেবা দরকার, কিন্তু তিনি তা পাবেন না। এবং তারা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বেন।
আইসিইউ বেড বাদ দিন। ভেন্টিলিটরের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গোটা আমেরিকায় সাকুল্যে ১ লক্ষ ভেন্টিলেটর আছে।
এই একটিমাত্র কারণের জন্যই প্রথমে হুবেই প্রদেশে গাদাগাদা মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তারপর একইভাবে হয়েছে ইতালিতে, ইরানে। হুবেইতে তাও মৃত্যুহার খানিকটা কমানো গিয়েছে, রাতারাতি দুটি হাসপাতাল তৈরি করে। ইরান ও ইতালি তা করতে পারেনি। জানা নেই অন্য কোনও দেশও তা করতে সক্ষম কিনা।
তাহলে প্রশ্ন হল, মৃত্যুহার ৪ শতাংশের কাছাকাছি কেন?
সহজ হিসেব। যদি আক্রান্ত মানুষের ৫ শতাংশেরও ইনটেনসিভ কেয়ারের প্রয়োজন হয়, তা তারা পাবে না। ফলে বেশিরভাগ রোগী মারা যাবে।
পাশাপাশি আরও একটি তথ্য আপনাদের জানাতে চাইব। তা হল চিনের ভাইরাসের থেকেও মারাত্মক আমেরিকার এই ভাইরাস।
আমি খুশি হতাম, এখানেই শেষ করতে পারলে। কিন্তু তা করা গেল না।
Collateral Damage
করোনাভাইরাসে মৃত মানুষের সংখ্যাই কেবল দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু কী হবে যদি গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থাই করোনাভাইরাসের চিকিৎসা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে? উত্তরটা খুব সহজ। বাকিরাও অন্যান্য উপসর্গে মারা পড়বেন এক এক করে।
আপনার হার্ট অ্যাটাক হল আর আপনি অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেন। কিন্তু ৮ মিনিটের জায়গায় সেই অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছল ৫০ মিনিট পর। এবং এখানেই শেষ নয়। অ্যাম্বুলেন্সে নেই আইসিইউয়ের ব্যবস্থা, অনুপস্থিত ডাক্তারবাবুও। কী হবে? আপনার মৃত্যু হবে।
আমেরিকায় প্রতি বছর ৪০ লক্ষ মানুষ আইসিইউতে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ৫০ হাজার মানুষ (শতাংশের বিচারে ১৩%) মারা যান। আইসিইউ বেড ছাড়া সেই সংখ্যাটা সহজেই ৮০% কাছাকাছি গিয়ে ঠেকতে পারে। যদি মাত্র ৫০ শতাংশেরও মৃত্যু হয়, তাহলে এক বছরে মোট মৃত্যু ঠেকছে ২০ লক্ষে। এর মধ্যে বছরভর অতিমারিতে ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কো ল্যাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে বছরের সারণিতে যোগ হচ্ছে অতিরিক্ত ১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু।
করোনাভাইরাসকে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া হলে, আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে এবং মৃত্যুর সংখ্যা লাখ ছাড়াবে, হয়ত কোটিতে গিয়ে ঠেকবে।
অন্যান্য সমস্ত দেশের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা বিদ্যমান। ফলে করোনাভাইরাসের লাগামছাড়া বৃদ্ধি যে কোনও দেশের পক্ষেই মৃত্যুমিছিল বয়ে আনতে পারে।
এখন পর্যন্ত একটা জিনিস বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। এখানে আমাদের হাতে আছে মিটিগেশন এবং সাপ্রেশন, এই দুটি পথ। দুটোর ক্ষেত্রেই প্রাথমিক লক্ষ্য হল বৃদ্ধিতে লাগাম পরানো। কিন্তু দুই পথের চলন সম্পূর্ণ ভিন্ন।
দ্বিতীয় উপায়: মিটিগেশন কৌশল
মিটিগেশন কৌশলটি চলবে মোটমুটিভাবে এভাবে: এখন করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব। তাই তাকে তার মতো চলবে দাও। বরং চেষ্টা চলুক ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে। এভাবে খানিকটা হলেও ভাইরাসের হামলার অভিঘাতকে কমিয়ে দেওয়া হলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর ভয়ানক চাপটা এড়ানো সম্ভব।
এই চার্টটি প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের একটি প্রকাশনায়। এবং বলা হয় এই প্রকাশনার চাপে পড়েই ইংল্যান্ড ও আমেরিকাকে করোনা মোকাবিলার পথ বদলাতে হয়।
আগের গ্রাফের সঙ্গে এর বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। হুবহু এক না হলেও, ধারনাগত দিক থেকে সাযুজ্যপূর্ণ বলা যেতেই পারে।
এখানে কিছুই করো না, এই বোঝানো হয়েছে কালো রেখা দিয়ে। অন্যান্য সমস্ত রেখাই দেওয়া হয়েছে যদি আরও কঠিন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের পদক্ষেপ নেওয়া যেতো তাহলে যা হত, সেটা বোঝাতে। নীল রেখাটি কঠিনতম সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বোঝাতে। অর্থাৎ আক্রান্তদের আইসোলেট করে, যে মানুষেরা আক্রান্ত হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে তাদের কোয়ারেন্টিনে রেখে এবং বয়স্কদের আলাদা করে। এই নীল রেখাটি বর্তমানে ইংল্যান্ডের মেনে চলা পথ। যদিও এখনও অবধি তারা একে পরামর্শ আকারে রেখেছে মাত্র, এখনও বাধ্যতামূলক করেনি।
এখানে, আবার লাল রেখার অর্থ হল ইংল্যান্ডে আইসিইউয়ের ক্ষমতা। এক্ষেত্রেও তার অবস্থান একেবারে তলানিতে। লাল রেখার একেবারে উপরের অংশের এলাকায় রয়েছেন সেই করোনা আক্রান্ত রোগীরা, যাদের বেশিরভাগের হয়ত আইসিইউ রসদের অভাবে মৃত্যু হতে চলেছে।
এখানেই শেষ নয়, সংক্রমণের কার্ভকে সমান রাখার জন্য যে অতিরিক্ত আইসিইউ ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলোও বেশ কয়েকমাস ধরে আটকা থাকবে। ফলে আইসিইউয়ের সামগ্রিক ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকবে। যার ফলে কোল্যাটেরাল ড্যামেজ লাফিয়ে বাড়বে।
আপনি জানলে অবাক হবেন, ওঁরা যখন বলে কিছু মিটিগেশনের কাজ করতে হবে, তার আসল অর্থ হল, আমরা আমাদের সজ্ঞানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ উপচে পড়তে দেবো, মৃত্যুহার বাড়বে অন্ততপক্ষে ১০ গুণ।
আপনি ভাবছেন হয়ত, এটা অত্যন্ত কদর্য একটা পদক্ষেপ। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। কারণ এই কৌশলের অন্যতম একটি প্রধান দিক হল হার্ড ইমিউনিটি বা যুথবদ্ধ প্রতিরোধ শক্তি।
Herd Immunity বনাম Virus Mutation
এই ধারণা বলে, যে সমস্ত মানুষ আক্রান্ত হলেন এবং তারপর চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেন, তিনি নিজের মধ্যে এই ভাইরাসের প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। আর এটাই এই কৌশলের অন্যতম দিক।
দেখুন, আমি জানি কিছুদিনের জন্য ব্যাপারটা সহজ হবে না। কিন্তু একবার কাজ শেষ হলে, কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পর, আমরা বাকিরা এই ভাইরাস থেকে ইমিউন হয়ে যাব। ফলে ভাইরাস ছড়ানো নিজে থেকেই থেমে যাবে এবং আমরা করোনাভাইরাসকে বিদায় জানাতে পারব।
একবারে এটা করে ফেলাই সবচেয়ে ভালো। কারণ আমাদের হাতে অন্য যে বিকল্পগুলো আছে, যেমন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের মতো বিষয়, আমাদের অন্তত ১ বছর ধরে টেনে নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি থেকে যাবে আবার ভাইরাসের ফিরে আসার ভয়।
এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো। তা হল, ভাইরাসটি নিজে খুব বেশি বদলাচ্ছে না। আর যদি সত্যিই যদি তা না হয়, তাহলে অনেক বেশি পরিমাণে মানুষ ইমিউন হতে পারবেন। এবং একটা সময় এই অতিমারির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে।
ভাইরাসটির পরিবর্তনের (mutate) সম্ভাবনা কতটা?
দেখে মনে হচ্ছে, ইতিমধ্যেই তা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।
এই গ্রাফের মধ্যে দিয়ে ভাইরাসের আলাদা আলাদা মিউটেশন দেখানো হয়েছে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, প্রাথমিকভাবে সংক্রমণ শুরু হল চিনে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ল। একটি পার্পল রেখা দিয়ে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। আপনি বাঁ দিকের গ্রাফে অসংখ্য শাখা দেখছেন, এগুলো ভাইরাসের একেক বার মিউটেশনের চিহ্ন। প্রতিবার মিউটেশনের পরই ভাইরাসটির মধ্যে নতুন কিছু বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা গিয়েছে।
এতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই যে, RNA নির্ভর ভাইরাস যেমন করোনাভাইরাস কিংবা ফ্লু, DNA নির্ভর ভাইরাসের চেয়ে ১০০ গুণ দ্রুত মিউটেট করতে পারে। যদিও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের চেয়ে করোনাভাইরাসের মিউটেশনের গতি কম।
এখানেই শেষ নয়, ভাইরাসের মিউটেট করার আদর্শ পরিবেশ হল, মিউটেশনের হাজারো সুযোগ থাকা। মিটিগেশন স্ট্র্যাটেজিতে ঠিক তাই হচ্ছে। হাজার-হাজার-লাখ-লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন।
এই কারণের জন্যই প্রতিবছর নিয়ম করে আপনাকে ফ্লুয়ের টিকা নিতে যেতে হয়। কিন্তু তা আপনাকে করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। ঠিক তেমনই প্রতিবছর যে নতুন নতুন ভাইরাসের আমদানি হচ্ছে, ফ্লুয়ের টিকা তাও রুখতে অপারগ।
তার মানে, মিটিগেশন কৌশল যে ইংল্যান্ড-আমেরিকায় শুধুমাত্র কয়েক লক্ষ প্রাণ নিয়েই সফল হচ্ছে তেমন নয়। বরং ভাইরাসটি খুব বেশি মিউটেট করছে না, এই দাবি করেও কার্যত জুয়া খেলা হচ্ছে। অর্থাৎ এরকমই চললে বছর বছর করোনাভাইরাসের থাবার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ঠিক যেমন ফ্লু। কিন্তু করোনা আরও বিপজ্জনক, আরও ভয়ঙ্কর।
সুতরাং কিছুই করো না কিংবা মিটিগেশন, কোনওটাই কাজ করছে না। তাহলে বিকল্প কী? উত্তর হল, সাপ্রেশন (Suppression)।
উপায় ৩:
Suppression Strategy
আমরা দেখলাম, মিটিগেশন কৌশল ভাইরাসকে বোতলবন্দি করে না, প্রভাব খানিকটা কমায় মাত্র। অন্যদিকে সাপ্রেশনের মাধ্যমে কঠোর পদক্ষেপ জারি করে দ্রুত মহামারিকে কবজা করা হয়। বিশেষত,
ক. আগ্রাসী হয়ে এগিয়ে চলো। কঠিন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নীতি লাগু করো। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করো।
খ. তারপর, আস্তে আস্তে হালকা করে দাও বিধি নিষেধ। যাতে নাগরিকরা আস্তে আস্তে পুরনো স্বাধীনতা ফিরে পান। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।
আসুন দেখে নিই কেমন লাগবে গোটা বিষয়টা,
সাপ্রেশন স্ট্র্যাটিজিতে প্রথম ধাক্কার পর মৃতের সংখ্যা কমে আসবে হাজারে। লাখে নয়।
কীভাবে?
কারণ, আমরা যে শুধু আক্রান্তের সংখ্যা লাগামছাড়া হওয়া থেকে ঠেকিয়েছি তাই নয়, মৃত্যুহারও একধাক্কায় কমে গিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। এখানে আমি মৃত্যুহারকে ধরেছি ০.৯% হিসেবে। মোটামুটি যে হার আমরা দক্ষিণ কোরিয়ায় দেখেছি। এই দেশ সাপ্রেশন স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করেছে।
কিন্তু অন্যান্য দেশগুলো কেন এই কৌশল নিল না?
এর নেপথ্যে রয়েছে মূলত ৩ টি কারণ।
প্রথমত, প্রথম লকডাউন এক মাস ধরে চলবে। যা কিছু নাগরিক মানতে পারবেন না।
দ্বিতীয়ত, মাসাধিক কাল ধরে লকডাউন অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দেবে।
তৃতীয়ত, এর ফলে সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ আমরা অতিমারিকে পিছিয়ে দিয়েছি কেবল। যেই সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বন্ধ হবে, লাখো লাখো মানুষ আবার আক্রান্ত হবেন এবং মৃত্যু হবে।
এখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে ইম্পিরিয়াল কলেজের টিম, সাপ্রেশন মডেলটিকে তৈরি করেছে। সবুজ ও হলুদ রেখা দুটি সাপ্রেশনের আলাদা আলাদা দুটি অবস্থার ছবি। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাপারটা ভালো দিকে যাচ্ছে না।
এখানে একটা জিনিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা গোটা আলোচনায় একবারের জন্যও উঠে আসেনি। তা হল সময়ের মূল্য।
সময়ের মূল্য
আগের পোস্টে জীবন বাঁচাকে সময়ের মূল্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা আমরা পদক্ষেপ নিতে সময় নষ্ট করি, আর ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া আরও বেগপ্রাপ্ত হয়। আমরা দেখেছিল একটি মাত্র দিন, কীভাবে ৪০% পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে, কীভাবে সেই হারেই কমতে পারে মৃত্যুও।
বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর এক অভূতপূর্ব চাপ এসে পড়ছে, এমন ঘটনা ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি। আমরা সম্পূর্ণভাবে অপ্রস্তুত এবং জানি না শত্রুকে। যুদ্ধের জন্য এটা মোটেও সুখকর নয়।
ধরুন আপনাকে আপনার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু আপনি তার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। আপনার হাতে তখন মাত্র দুটি পথ। প্রথম পথ, আপনি মরিয়া হয়ে শত্রুর দিকে ধাওয়া করবেন আর দ্বিতীয়, সাময়িক পালিয়ে এসে প্রস্তুতির জন্য খানিকটা সময় আদায় করে নেওয়া। কোনটা করবেন আপনি?
ঠিক এই জিনিসটাই চাই আজ। বিশ্বের ঘুম ভেঙেছে। করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা যত বেশি সময় পাবো, তত বেশি প্রস্তুত হতে পারব। পরের অংশে জানুন, এই সামান্য সময়ও আমাদের কতটা উপকার করতে পারে।
আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস
কার্যকরী সাপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে রাতারাতি আক্রান্তের সংখ্যা যে কমানো সম্ভব, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হুবেই।
আজ অবধি, চিনের ৬ কোটি জনসংখ্যার বিশাল হুবেই প্রদেশে নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ০।
রোগ নির্ণয়ের পরিমাণ শুরুর দিকে বাড়বে, কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা ক্রমেই কমে আসবে। আক্রান্তদের সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গেই কমবে মৃত্যুর সংখ্যাও। স্বভাবতই কমছে কোল্যাটেরাল ড্যামেজ। কারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর অতিরিক্ত চাপ সামলানো গিয়েছে। ফলে স্বাভাবিক সময়ে যাঁদের আইসিইউ পরিষেবা পাওয়ার কথা, তাঁরা তা পাচ্ছেন। ফলে সাধারণ মৃত্যুহারও স্বাভাবিক হওয়ার পথে।
সাপ্রেশন স্ট্র্যাটেজির সফল প্রয়োগে আমাদের লাভ:
ক. করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস
খ. স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দম ফেলার ফুরসত পাবে। এবং অতি অবশ্যই এই ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষরা।
গ. মৃত্যুহার হ্রাস
ঘ. কো-ল্যাটেরাল ড্যামেজে ক্ষতির পরিমাণ কম
ঙ. চিকিৎসা সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের পর আক্রান্ত স্বাস্থ্য কর্মীরা ফের কাজে ফেরার পথে। ইতালিতে মোট সংক্রমণের ৮ শতাংশ ছিলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
আসল সমস্যা চিনুন: টেস্টিং অ্যান্ড ট্রেসিং
এই মুহূর্তে আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ড, কারওই দেশে করোনা আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা জানা নেই। আমরাও জানি না ঠিক কত লোক আছেন। আমরা কেবল জানি সরকারি পরিসংখ্যান সত্যি নয়। এবং সত্যিটা হল, চারপাশে হাজারে হাজারে মানুষ আক্রান্ত। এর কারণ আমরা যথেষ্ট পরীক্ষা (testing) বা চিহ্নিতকরণ (tracing) করছি না।
১. আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের পরীক্ষা করার পরিকাঠামো তৈরি হয়ে যাবে এবং সবাইকে পরীক্ষা করা হবে। তারপর আমরা জানতে পারব সঠিক সংখ্যা, সমস্যার বিস্তৃতী, কোথায় আমাদের আরও বেশি আগ্রাসী হতে হবে এবং কোন এলাকায় লকডাউন তুলে নেওয়া যেতে পারে।
২. নয়া পদ্ধতির পরীক্ষা সামগ্রিক প্রক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি করতে পারে। ফলে স্বভাবতই খরচ ক্রমশ কমের দিকে যাবে।
চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমরা অনুসরণ করতে পারি চিন কিংবা অন্যান্য ইস্ট এশিয়ান দেশগুলোকে। যেখানে প্রশাসন একজন অসুস্থ ব্যক্তি কার কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তার অব্যর্থ হিসেব রেখেছে এবং শুধু তাই নয়, তাঁদের কোয়ারেন্টিনেও পাঠিয়েছে। অর্থাৎ আমরা যদি এটা জানতে পারি, যে ভাইরাসটির অবস্থান এখন ঠিক কোথায়, তাহলে আমরা শুধু সেই জায়গাগুলোকেই টার্গেট করতে পারব। এর মধ্যে কোনও রকেট সায়েন্স নেই। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো স্রেফ এই পদ্ধতি অবলম্বন করেই করোনাভাইরাসকে বাগে এনে ফেলেছে। আবার কোনও দানবিক লকডাউনের পথেও যেতে হয়নি।
আগ্রাসী পরীক্ষা ও চিহ্নিতকরণ পদক্ষেপ দক্ষিণ কোরিয়ায় একা হাতে করোনার তাণ্ডবলীলা থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
ইংল্যান্ড এবং বিশেষ করে আমেরিকা কার্যত খালি হাতে যুদ্ধে নামতে চলেছে।
আমাদের কাছে মাত্র ২ সপ্তাহের মুখোশের মজুত আছে, হাতে গোনা কয়েকটি পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুইপমেন্টস (PPE), যথেষ্ট ভেন্টিলেটর নেই, যথেষ্ট আইসিইউ বেড নেই। নেইয়ের তালিকায় ECMO মেশিনও। মিটিগেশন স্ট্র্যাটেজিতে এই কারণেই মৃত্যহার অনেক বেশি হবে।
কিন্তু হাতে যদি খানিকটা সময় পাওয়া যায়, খেলা ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে:
১. ভবিষ্যতের জন্য যন্ত্রপাতি কিনে রাখার সময় পাওয়া যাবে
২. আমরা দ্রুত মাস্ক, ভেন্টিলেটর, PPE, ECMO কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন বাড়ানোর পথে যাবো। জীবনদায়ী যন্ত্রের বহুল ব্যবহারে মৃত্যুহার কমবে।
অন্যভাবে দেখলে, অস্ত্র ভাণ্ডার তৈরির জন্য আমাদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমাদের দরকার কেবল কয়েক সপ্তাহ। এইসব জীবনদায়ী যন্ত্রপাতি যাতে সহজেই বানানো যায়, তা বরং ভেবে দেখুক তরুণ প্রজন্ম। থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে ভেন্টিলেটরের অংশ তৈরির কথা ইতিমধ্যেই ভেবে ফেলেছে তাঁরা। হাতে একটু সময় পেলেই তা করা সম্ভব। ভয়ঙ্কর শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর আগে অস্ত্রভাণ্ডার সাজাতে আপনি কয়েকটা সপ্তাহ সময় নেবেন না?
এটাই অবশ্য সব নয়। যত বেশি সম্ভব স্বাস্থ্যকর্মী চাই। কোথায় পাবো? আমাদের সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যাতে তারা নার্সদের সাহায্য করতে পারে। অবসর নিয়ে নেওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের ফের কাজে ফেরার আবেদন করুন। তাঁদের এই মুহূর্তে প্রচণ্ড দরকার। বিশ্বের অনেকগুলো দেশ ইতিমধ্যেই এই প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। তবে সামগ্রিক সাড়া মিলতে কিছুটা সময় লাগবে।
ভাইরাস ছড়ানো রুখতে
মানুষ ভীত। করোনাভাইরাস একটি নতুন ভাইরাস। কিন্তু বাস্তবের দিকে তাকিয়ে দেখুন, মানুষ এখনও কেমন নির্দ্বিধায় হাত মেলাচ্ছে, কীভাবে জড়িয়ে ধরছে একে অপরকে। তারা কনুই দিয়ে দরজা খোলা অভ্যাস করে না। হাতল ঘুরিয়ে দরজা খোলার পর তারা এখনও হাত ধোঁয় না। কোথাও বসার আগে তারা সেই জায়গাকে জীবানুশূন্য করে নেওয়ারও কোনও চেষ্টা করে না।
যখন মাস্কের জন্য হাহাকার কমবে, আমরা বাইরে বেরোলে মাস্ক ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত মাস্কটা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যই একচেটিয়া থাক। পরিস্থিতি বদলালো তখন সাধারণ মানুষ ব্যবহার করুক। কিছুই না ব্যবহার করার চাইতে কিছু অন্তত ব্যবহার করা ভালো।
এই সবগুলোই সংক্রমণ রোখার অত্যন্ত সহজ কতগুলো উপায়। এই ভাইরাস যত কম বংশবৃদ্ধি করে, ভবিষ্যতে এই ভাইরাসকে বোতলবন্দি করতে ততই কম সমস্যার মুখে পড়তে হবে। কিন্তু মানুষকে শিখিয়ে পড়িয়ে প্রস্তুত করতে খানিকটা সময় তো লাগবেই।
ভাইরাসটিকে চিনুন
আমরা এই ভাইরাসটি সম্পর্কে খুবই কম জানি। কিন্তু প্রতি সপ্তাহেই নিয়ম করে শয়ে শয়ে গবেষণাপত্র আসছে।
কমন শত্রুর বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে সারা বিশ্ব। গোটা দুনিয়ার গবেষকরা ভাইরাসটিকে আরও একটু ভালোভাবে জানার চেষ্টায় মগ্ন।
ভাইরাসটি ছড়ায় কীভাবে?
সংক্রমণের গতিবেগ কমানো যায়?
উপসর্গহীন বাহকের গুরুত্ব কতটা?
তারা কি ছোঁয়াচে? কতটা ছোঁয়াচে?
ভালো চিকিৎসা কী?
কতদিন বাঁচে?
কোন সারফেসে কতদিন বাঁচে?
বিভিন্ন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সংক্রমণের হার কতটা প্রভাবিত হয়?
সেজন্য খরচের পরিমাণ কেমন?
সেরা চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া কোনটি?
পরীক্ষার রিপোর্টগুলো কতটা নির্ভরযোগ্য?
এই প্রশ্নগুলোর সরাসরি উত্তর আমাদের সাহায্য করবে অর্থনীতি ও সমাজের উপর পড়া কোল্যাটেরাল ড্যামেজের মোকাবিলা করতে। তার পরিমাণ কমাতে। আর এটা কয়েক সপ্তাহেই করা যায়, বছর লাগে না।
চিকিৎসার খোঁজ
আচ্ছা, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যদি এর কোনও চিকিৎসা বেরিয়ে যায়? প্রতিটি দিন সেই সম্ভাবনা আরও জোরালো করছে। বর্তমানে, বেশ কয়েকজন প্রার্থী যেমন, Favipiravir, Chloroquine, or Chloroquine combined with Azithromycin বাজারে চলে এসেছে। চলছে প্রয়োগ। কী হবে যদি আজ থেকে দুমাসের মধ্যে আমরা করোনাভাইরাসের চিকিৎসা বের করে ফেলি? হাজারে হাজারে মৃত্যু নিয়ে মিটিগেশন কৌশল মেনে চলা দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে করুণা ছাড়া কী করবেন?
খরচ কম, তা বুঝতে হবে
উপরে আলোচনা হওয়া প্রতিটি ফ্যাক্টর, লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ বাঁচাতে পারে। এটাই কি যথেষ্ট নয়? অদ্ভুতভাবে, রাজনীতিবিদদের অবশ্য আবার কেবলমাত্র আক্রান্ত মানুষের জীবন নিয়ে ভাবলেই চলে না। তাঁদের ভাবনায় গোটা জনসংখ্যা এবং সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের প্রভাব বাকিদের উপরও পড়বে।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা জানি না, বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং কড়াভাবে পালন করলেও আদতে সংক্রমণ কমছে কিনা। আমরা জানি না তার জন্য কত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মূল্য চোকাতে হবে।
আগামীকাল শেষ পর্ব
Comments are closed.