করোনাভাইরাস কতটা ভয়াবহ হতে পারে? কী আছে টমাস পুয়োর গবেষণাপত্রে, যা পড়ে হতবাক সারা বিশ্ব?

(২০ মার্চ, ২০২০ টমাস পুয়োর করোনা সংক্রান্ত এই গবেষণামূলক  প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় medium.com এ। জানা যাচ্ছে, প্রকাশিত হওয়ার পর ৫ দিনে গোটা বিশ্বে ১ কোটি মানুষ এই লেখা পড়েন। ৩৭ টি ভাষায় মূল লেখাটি অনুবাদ হয়েছে। হুবহু তার অনুবাদ করে আমরা তা প্রকাশ করছি তিন পর্বে। আজ প্রথম পর্ব। অনুবাদ করেছেন অনির্বাণ দাশ।)

Coronavirus: The Hammer and the Dance

আগামী ১৮ মাস কেমন হতে চলেছে?

 

প্রবন্ধের সারাংশ:

করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে যদি শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে তার মেয়াদ হবে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। সব মিটে যাওয়ার পর ফের ভাইরাসের তাণ্ডব হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর এই সব কিছুই করা যায় সমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। আর এই গোটা যাত্রাপথে বাঁচবে লাখো মানুষের প্রাণ। আর যদি আমরা এই পদক্ষেপগুলো নিতে গড়িমসি করি তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষের আক্রান্ত হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। তার মধ্যে বহু মানুষের মৃত্যুও হবে। আর তার একমাত্র কারণ সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভেঙে পড়া।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে, বিশ্বের দেশগুলোর করোনাভাইরাসের ব্যাপকতা নিয়ে সুর বদলে গিয়েছে। সপ্তাহের শুরুতে বিশ্বের তাবড় নেতারা বলছিলেন, করোনাভাইরাস সামলে নেওয়া কোনও ব্যাপার না, তাঁরাই সপ্তাহ শেষ হতে না হতেই দেশে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা ডেকে বসে আছেন। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু দেশ আছে, যারা যথেষ্ট করছে না। কিন্তু কেন?

প্রত্যেকটি দেশ একটাই প্রশ্নই জিজ্ঞেস করছে, আমরা এর মোকাবিলা করব কী করে? স্বভাবতই উত্তরটা সবার অজানা।

ফ্রান্স, স্পেন কিংবা ফিলিপিন্সের মতো কয়েকটি দেশ আগেই হেভি লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্যরা, অর্থাৎ আমেরিকা, ইংল্যান্ড অথবা সুইৎজারল্যান্ডকে শুরু থেকেই সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নিয়ে বিভ্রান্ত লেগেছে।

এবার একনজরে দেখে নিন, আজকের প্রবন্ধে ঠিক কী বিষয় নিয়ে এগোবে আলোচনা:

ক. বর্তমান পরিস্থিতি কী?

খ. আমাদের হাতে কী কী উপায় আছে?

গ. এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সময়

ঘ. করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তৈরি পরিকল্পনা কেমন হবে?

ঙ. অর্থনীতি ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে কীভাবে এগোনো সম্ভব?

প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে, আপনি বুঝতে পারবেন, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়া শুরু হয়েছে।
দেশগুলোর কাছে আর মাত্র দুটিই পথ: তারা এর বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে মরিয়া লড়াই করতে পারে, অথবা তারা এই অতিমারির তাণ্ডব চুপ করে বসে দেখতে পারে।
যদি তারা অতিমারিকে বেছে নেয়, তাহলে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে মানুষের মৃত্যু হবে, কয়েকটি দেশে তা পৌঁছবে লাখে।
আর এর পরেও ভাইরাসের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আর যদি আমরা এখন একজোট হয়ে একটা মরিয়া লড়াই দিই, মৃত্যুর সংখ্যা কমবেই।
আমরা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একটু দম ফেলার ফুরসত দিতে পারব।
আমরা আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারব।
আমরা এ বিষয়ে আরও জানতে পারব।
এই দুনিয়া এর আগে এত দ্রুত কোনও জিনিস শেখেনি। এবং আমাদের এটাই দরকার। কারণ আমরা ভাইরাসটি সম্পর্কে খুবই কম জানি।
আর এ সবে একটা জিনিস হবে, যা এই মুহূর্তে প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ, তা হল আমাদের আরও খানিকটা সময় হাতে এনে দেবে। যা এই মুহূর্তে সবচেয়ে কাম্য।
আমরা যদি মরিয়া লড়াই করব বলে সিদ্ধান্ত নিই, যুদ্ধটা শুরু হবে তাৎক্ষণিকতার মধ্যে দিয়ে কিন্তু তা ক্রমশ ধারাবাহিকতার দিকে এগোবে।
আমাদের সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হতে পারে, কিন্তু মাসের পর মাস নয়।
আর তারপর, আমরা আরও বেশি বেশি করে স্বাধীনতা ফিরে পাবো।

এমন নয় যে রাতারাতি স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। কিন্তু এক সময় তা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
অর্থনীতির অবশিষ্ট অংশকে মাথায় রেখেও আমরা এই সব কিছু করতে পারি।
আসুন, করে দেখা যাক।

১.  অবস্থা কী?

এখানে দেখা যাচ্ছে চিনের বাইরে গোটা দুনিয়ায় করোনাভাইরাস আক্রান্তদের পরিসংখ্যান। এই গ্রাফে কেবলমাত্র ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়াকেই আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে। ডানদিকে তলায় যে দেশগুলো, সেখানে সবেমাত্র ভাইরাস পৌঁছেছে। বলতে চাইছি, এই দেশগুলো খুব তাড়াতাড়ি ওই তিন দেশের সঙ্গে পাল্লা দেবে।

আসুন দেখা যাক, তারপর কী হল

যেমন মনে করা হয়েছিল, করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় বিস্ফোরণ হয়েছে একের পর এক দেশে। এখানে আমি শুধুমাত্র সেই দেশগুলোর কথাই তুলে ধরেছি যেখানে অন্তত ১ হাজার জন করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া গিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কয়েকটি বিষয় হল,

ইতালিতে লকডাউনের ঘোষণা হয়, অথচ স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, প্রতিটি দেশেই ইতালির চেয়ে বেশি লোক সেই সময় করোনা আক্রান্ত।

চিনের হুবেই প্রদেশে যখন লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয় তখন অন্তত ১৬ টি দেশে করোনা আক্রান্তের হার হুবেই প্রদেশের চেয়ে বেশি। জাপান, মালয়েশিয়া, কানাডা, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, চেচনিয়া, ব্রাজিল এবং কাতারে করোনা আক্রান্তের হার হুবেইয়ের চেয়ে বেশি কিন্তু ১ হাজারের কম। সুইৎজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্ক, এদের প্রত্যেকটি দেশেই ১ হাজারের বেশি আক্রান্তের বাস।

এই দেশগুলোর মধ্যে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছেন? সবচেয়ে বেশি ভুগেছে চিন আর ইরান। আর ব্রাজিল, মালয়েশিয়াকে বাদ দিলে, বাকি প্রত্যেকটি দেশ বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ হিসেবেই পরিচিত।

তাহলে আপনি কি ভাবছেন, এই ভাইরাসের পাখির চোখ শুধুমাত্র বড়লোক দেশ? নাকি এই ধনী দেশগুলো ভাইরাসটিকে চিহ্নিত করতে বেশি সক্ষম বলে?

ব্যাপারটা মোটেই এরকম নয়, যে ভাইরাসটি গরিব দেশগুলোকে ছুঁয়েও দেখবে না। গরম ও আদ্র আবহাওয়া ভালো হলেও, তা প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ব্যর্থ। তা না হলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা ব্রাজিলের মানুষ আক্রান্ত হতেন না।

সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতামত হল, হয় করোনাভাইরাসের এই দেশগুলোতে পৌঁছোতে কিছুটা বেশি সময় লাগছে, কারণ এই দেশগুলো সর্বাপেক্ষা কম যোগাযোগ সম্পন্ন। অথবা আরেকটি মতামত হতে পারে। করোনাভাইরাস ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে, কিন্তু দেশগুলো পরীক্ষা করার পরিকাঠামো তৈরি করতে পারেনি বলে তা অজানা হয়ে রয়েছে।

এর কোনওটি যদি সত্যি হয়, তাহলে একটা জিনিস পরিষ্কার, বিশ্বের কোনও দেশই করোনাভাইরাসের থাবা এড়াতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা নিতে না পারলে রোগের বিস্ফোরক প্রাদুর্ভাব ঠেকানো কার্যত অসম্ভব।

১. দেশগুলো কী ব্যবস্থা নিতে পারে?

২. আমাদের হাতে উপায় কী কী আছে?

গত সপ্তাহের প্রবন্ধটির পর অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। পরিস্থিতি খানিকটা হলেও বদলানোর প্রক্রিয়াটা অন্তত শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি দেশ ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ শুরুও করে দিয়েছে। এবার দেখে নিন ব্যবস্থা নেওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত কয়েকটি উদাহরণ।

স্পেন ও ফ্রান্সের নেওয়া ব্যবস্থা

এক্ষেত্রে অন্তত স্পেন ও ফ্রান্সের অবস্থান একেবারে দুই গোলার্ধে। প্রথমে দেখা যাক স্পেন কী কী ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছে:
বৃহস্পতিবার, ক্যালেন্ডারে ১২ মার্চ। স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য নিয়ে সতর্কবার্তাকে অগ্রাহ্য করছে, এই সংক্রান্ত পরামর্শ সরাসরি খারিজ করে দেন প্রেসিডেন্ট।
শুক্রবার দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা।
শনিবার ব্যবস্থা নেওয়া শুরু,

কী কী ব্যবস্থা?

ক. মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারবেন না। একমাত্র খাদ্যদ্রব্য কেনা, কাজ, ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক অথবা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে যাওয়ার অনুমতি।

খ. শিশুকে বাইরে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া কিংবা বন্ধুবান্ধব মিলে জটলা পাকিয়ে আড্ডা নিষিদ্ধ। একমাত্র বাড়ির বয়স্ক কিংবা শিশুর দেখভালের লোকেরা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মানার পর যে কোনও বাড়িতে ঢোকার ছাড়পত্র।

গ. সমস্ত বার ও রেস্তরাঁ বন্ধ। একমাত্র রেস্তরাঁ থেকে খাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে।

ঘ. সমস্ত বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ। স্পোর্টস, সিনেমা, মিউজিয়াম, নাগরিক বা সামাজিক উৎসব স্থগিত।

ঙ. বিয়েতে কাউকে নেমন্ত্রণ করা যাবে না। কোনও অতিথি আসবেন না। হাতে গোনা কয়েকজনকে ছাড়পত্র শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানেও।

চ. গণপরিবহণ অবশ্য চালু

সোমবার বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশের স্থলসীমা।

কিছু মানুষ এতেই সন্তুষ্ট। বলছেন যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাকিরা বলে উঠছেন, একেবারেই না। এই দুইয়ের ফারাকেরই তথ্য তালাশ করার চেষ্টা হবে এই প্রবন্ধে।

ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও মোটের উপর ব্যবস্থাবলি একই। তবে পার্থক্য একটাই, ফ্রান্স গোটা প্রক্রিয়াটিকে লাগু করতে অনেকটা বেশি সময় নিয়েছে। কিন্তু এখন তারা আগ্রাসী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফ্রান্সে ছোট ও মাঝারি শিল্পকে বাঁচাতে ইতিমধ্যেই ভাড়া, কর বা অন্যান্য খরচ মকুব করা হয়েছে।

আমেরিকা ও ইংল্যান্ড কী করছে?

আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং সুইৎজারল্যান্ডের মতো দেশ তখনও ব্যবস্থা নেওয়ার পথে পা বাড়িয়েছে কেবল। লাগু কিছুই হয়নি।

এবার দেখুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাইমলাইন

ক. বুধবার ১১ মার্চ ট্রাভেল ব্যান ঘোষণা

খ. শুক্রবার: জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা। কিন্তু সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নিয়ে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নেই।

গ. সোমবার: সরকার মানুষের কাছে আর্জি জানায়, আপনারা দয়া করে বার, রেস্তরাঁ অথবা এমন কোথাও যেখানে অন্তত ১০ জন মানুষের সমাগম, তেমন জায়গা এড়িয়ে চলুন। পরামর্শ হিসেবেই কেবল সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের কথা। প্রয়োগ নেই।

যদিও একাধিক প্রদেশ এবং শহর নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যবস্থা লাগু করছে দেশজুড়ে।

ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেও কার্যত একই অবস্থা। সেখানেও প্রস্তাবের পরিমাণ যত, বাস্তবে প্রতিফলন সামান্য।

(পরবর্তী অংশ আগামীকাল)

Comments are closed.