দ্য হ্যামার অ্যান্ড দ্য ডান্সের বিশেষত্ব কী? করোনা মোকাবিলায় কেন এই পদ্ধতির কথা বলছেন টমাস পুয়ো?

(২০ মার্চ, ২০২০ টমাস পুয়োর করোনা সংক্রান্ত এই গবেষণামূলক  প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় medium.com এ। জানা যাচ্ছে, প্রকাশিত হওয়ার পর ৫ দিনে গোটা বিশ্বে ১ কোটি মানুষ এই লেখা পড়েন। ৩৭ টি ভাষায় মূল লেখাটি অনুবাদ হয়েছে। হুবহু অনুবাদ করে আমরা তা প্রকাশ করছি তিন পর্বে। আজ তৃতীয় তথা শেষ পর্ব। অনুবাদ করেছেন অনির্বাণ দাশ।)

দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে কাজ করে মিটিগেশন ও সাপ্রেশন পদ্ধতি। এই পর্বে দ্য হ্যামার অ্যান্ড দ্য ডান্সের বিশ্লেষণ।

একটি ব্যবস্থা গ্রহণে খরচ কত হতে পারে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের পর সমস্যা সমাধান হবে কিনা সেটাই আসল প্রশ্ন। ফলে দীর্ঘমেয়াদে কোন পথ অনুসরণ করা হবে তা ঠিক করা শক্ত ব্যাপারই বটে।

হাতে কয়েকটা সপ্তাহই যথেষ্ট, তাদের নিয়ে পড়াশোনা করে তাদের বোঝার জন্য, অগ্রাধিকার স্থির করার জন্য, এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে কোন পথ নেওয়া হবে।

আক্রান্তের সংখ্যা কম করা, পুরো সমস্যাটি কী তা স্পষ্টভাবে বোঝা, মোকাবিলার হাতিয়ার ভাণ্ডার তৈরি করা, ভাইরাসটিকে আরও ভালও করে বোঝা, বিভিন্ন পথের খরচাপাতির হিসেব এবং অবশ্যই জনসাধারণকে এবিষয়ে শিক্ষিত করে তোলা। এগুলো ভাইরাস মোকাবিলার সবচেয়ে গুরুত্বপূ্র্ণ তূণ এবং আমাদের আরও কয়েকটি সপ্তাহ হাতে চাই, যাতে গোটা প্রক্রিয়াটি সুগঠিত করা সম্ভব হয়। অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুর সামনে পড়লে কী অবস্থা হতে পারে আন্দাজ আছে নিশ্চয়ই। তাই সফল হতে চাইলে চূড়ান্ত যুদ্ধের আগে প্রস্তুতি নেওয়া অনিবার্য।

The Hammer and the dance

এতক্ষণে বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই, যে মিটিগেশন স্ট্র্যাটেজি একটি ভয়ঙ্কর কৌশল এবং সাপ্রেশন স্ট্র্যাটেজির অসাধারণ স্বল্পমেয়াদী সুবিধা আছে।

কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এনিয়ে কতগুলো প্রশ্ন আছে:

১. কতদিন ধরে চলবে?

২. কত খরচ হতে পারে?

৩. আচ্ছা, ভাইরাসের প্রত্যাবর্তন এমন হবে না তো যেন মনে হয় আমরা কিছুই করিনি?

এবার আমরা দেখব, সত্যিকারের একটি সাপ্রেশন স্ট্র্যাটেজি দেখতে ঠিক কেমন। আমরা একে   The Hammer and the dance বলতে পারি।

The Hammer

প্রথমত, পদক্ষেপ হবে দ্রুত এবং আগ্রাসী। যত দ্রুত সম্ভব ভাইরাসের আগুনে জল ঢালতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, কতদিন চলবে?

যে ভয় জনমানসে ছাপ ফেলেছে তা হল, আমাদের টানা মাসের পর মাস ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে। উপরন্তু অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানসিক স্বাস্থ্য। এই আইডিয়া উচ্চকিত প্রশংসা পেয়েছে ইম্পিরিয়াল কলেজের পেপারে।

এই চার্টটির কথা মনে পড়ে? হালকা নীল এলাকাটি অর্থাৎ যা মার্চের শেষ থেকে অগাস্টের শেষ পর্যন্ত সময় ধরা হয়েছে, তাকে হ্যামার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে ইম্পিরিয়াল কলেজের পেপারে। প্রাথমিক সাপ্রেশনের মধ্যেই কড়া সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং অন্তর্ভুক্ত।

আপনি যদি একজন রাজনীতিবিদ হন এবং দেখেন, প্রথম উপায় হিসেবে হাজার, হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু মিটিগেশন প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে এবং অন্যটি হল অর্থনীতিকে ৫ মাসের জন্য স্তব্ধ করে দিয়ে সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করা, যখন ভাইরাসের প্রকোপে বহু মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হবেন এবং মৃত্যু হবে। কোনওটাই বিশেষ ভরসাযোগ্য হচ্ছে না, তাই তো?

কিন্তু ব্যাপারটি যদি তেমন না হয়? এই পেপারটি, যা নিয়ে আলোচনা চলছে, তা তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে মূলত বুনিয়াদি কিছু খামতির কারণে। পেপার তৈরি করতে গিয়ে কন্টাক্ট ট্রেসিং (দক্ষিণ কোরিয়া, চিন অথবা সিঙ্গাপুর) এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে কিংবা ট্রাভেল ব্যান (চিনে যে পদক্ষেপ প্রশ্নের মুখে পড়েছে), বড় জমায়েতের কুপ্রভাব সম্পর্কে অসচেতন থাকা।

হ্যামারের জন্য প্রয়োজন কয়েক সপ্তাহ মাত্র। মাস নয়।

এই গ্রাফে দেখা যাচ্ছে ৬ কোটি জনসংখ্যা বিশিষ্ট হুবেই এলাকায় ২৩ জানুয়ারি থেকে নতুন করে আক্রান্ত হওয়াদের। দু’সপ্তাহের মধ্যে চিন কাজে ফেরার কথা অবধি ভাবতে শুরু করেছিল। ৫ সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বোতলবন্দি করে ফেলা হয় ভাইরাস সংক্রমণ। ৭ সপ্তাহ পর নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রায় নেই বললেই চলে। ভুলে যাবেন না, চিনে এই এলাকা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল।

মনে রাখবেন, এগুলো সেই কমলা রেখা। ধুসর রেখা অর্থাৎ সত্যি আক্রান্তদের সংখ্যা অনেক আগে থেকেই কমতে শুরু করেছে। (চার্ট 9 দেখুন)

তারা যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছিল, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সও একই পথের পথিক। তা হল, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, মানুষকে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে না দেওয়া, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ, পরীক্ষা আরও বেশি হাসপাতালের বেড, ট্রাভেল ব্যান।

চিনে অত্যন্ত কড়াভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে কোনও বাড়ি থেকে মাত্র একজনকেই তিনদিন বাদে বাদে খাবার কিনতে বের হওয়ার অনুমতি। চিনে নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করতে প্রশাসন চেষ্টার কসুর করেনি। বলতে দ্বিধা নেই, চিনের এই মরিয়া লড়াইয়ের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে মহামারি।

ইতালি, ফ্রান্স এবং স্পেনে এতটা কঠোরভাবে ব্যবস্থা লাগু হয়নি। মানুষ এত কিছু সত্ত্বেও রাস্তায় হাঁটতে পেরেছেন, অনেকেই তার মধ্যে আবার মাস্ক ছাড়া। অর্থাৎ ধীর গতির হ্যামার চালানো হয়েছে। এর ফল হয়েছে, গোটা পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে বেরিয়ে গিয়েছে আরও কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ সময়।

অনেকেই রসিকতার ছলে বলছেন, গণতন্ত্রের পক্ষে আক্রান্তের সংখ্যা এতটা কমিয়ে দেখানো সম্ভব নয়। এটা একেবারেই ভুল কথা।

গত কয়েক সপ্তাহধরে, চিনের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়াতে মহামারি হাহাকার ফেলেছে। কিন্তু এখন তা বলতে গেলে আয়ত্বে চলে এসেছে। এবং তারা এটা করে ফেলল মানুষকে ঘরবন্দি না করেই! দক্ষিণ কোরিয়া আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সার্বজনীন পরীক্ষার পথে গিয়েছে, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছে। প্রয়োজন মোতাবেক, কোয়ারেন্টিন এবং আইসোলেশনের ব্যবস্থা করেছে।

নীচের টেবিল একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কোন দেশ ঠিক কোন পথ অবলম্বন করেছে এবং তাতে কী ফল হয়েছে। এই চার্টের কাজ স্বভাবতই এখনও চলছে। তাই পরামর্শ আহ্বান করছি সর্বস্তরে।

এই তালিকা দেখলে পরিষ্কার হবে, কোন দেশ কীভাবে মহামারি প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখছে, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং ব্যবস্থা, সুস্বাস্থ্যের শিক্ষার প্রসার কেমন, আগে থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা সম্ভব কিনা। যাতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সময় সমস্যায় না পড়তে হয়।

উল্টোদিকে ইতালি, স্পেন কিংবা ফ্রান্স, এই কাজগুলো কার্যকরীভাবে লাগু করতে ব্যর্থ হয়। অর্থাৎ হ্যামারের শেষ পর্যায়ে তাদের কড়া ব্যবস্থা নিতেই হবে।

আর এসবের একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড। বিশেষ করে আমেরিকা। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ান যে ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে যে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিল, এই দেশগুলো তা এখনও করে উঠতে পারেনি। আর মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার। হয় ওই দেশগুলো অবাক হয়ে চেয়ে মহামারির তাণ্ডবলীলা দেখবে কিংবা দেরিতে হলেও, ভুল বুঝতে পেরে আরও কড়া হ্যামারের পথে যাবে, যাতে পূর্বের ক্ষতিপূরণ হয়। এর থেকে পালানোর কোনও রাস্তা নেই।

কিন্তু এটা করা সম্ভব। যদি দক্ষিণ কোরিয়ায় মহামারি ভয়ঙ্কর আকার নেওয়ার পরেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংয়ের কড়াকড়ি না করেও তা করা যায়, তাহলে পশ্চিমের দেশগুলো, যারা ইতিমধ্যেই কড়াভাবে হ্যামার কৌশল প্রয়োগ করছে, তাদের পক্ষেও তা করা আলবাৎ সম্ভব। আর এতেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মহামারি আয়ত্বে চলে আসবে। এটা আসলে শৃঙ্খলা, যথাযত প্রয়োগ এবং জনসংখ্যার কত শতাংশ নিয়ম পালন করছে, তার উপর নির্ভরশীল।

ঠিকমতো হাতুড়ি মেরে দিতে পারলে রোগের ছড়িয়ে পড়া আটকানো যাবে। এবার শুরু নাচ। The Dance।

The Dance

করোনাভাইরাসের উপর হাতুড়ি চালিয়ে আপনি প্রথমে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা আয়ত্বে নিয়ে এলেন। এবার আপনি গোটা ব্যাপারটি পর্যালোচনা করার জন্য হাতে অনেকটা সময় পেয়ে গেলেন। এবার আসবে, দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে ভ্যাকসিন না বাজারে আসা পর্যন্ত ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায়।

এই ধাপে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভুল করেন মানুষ। তা হল, এই প্রক্রিয়ায় মনে হয় মাসের পর মাস ঘরবন্দি থাকতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটি আদৌ তা নয়। বরং বলা যেতে পারে, আমাদের জীবন আবার পুরনো খাতে বওয়ার প্রক্রিয়া।

সফল দেশগুলোয় নাচের (দ্য ডান্স) প্রভাব

দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং জাপানে অনেকটা সময় ধরে মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও দেশেই লকডাউন করতে হয়নি। কীভাবে সম্ভব তা?

এই ভিডিওয়, দক্ষিণ কোরিয়ার বিদেশমন্ত্রী বলছেন কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করল তাঁর দেশ। পথটা বেশ সহজ। কার্যকরী পরীক্ষা, দক্ষ চিহ্নিতকরণ, ট্রাভেল ব্যান, সঠিক আইসোলেটিং এবং কোয়ারেন্টিন। এই হল রহস্য।

এই পেপারটিতে সিঙ্গাপুরের নেওয়া ব্যবস্থা লিপিবদ্ধ রয়েছে।

জানতে চান, ঠিক কোন ম্যাজিকে অসাধ্য সাধন করে দেখাল সিঙ্গাপুর? দক্ষিণ কোরিয়ার দেখানো পথেই হেঁটেছে সিঙ্গাপুর। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে সিঙ্গাপুর প্রশাসন কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের এবং ট্রাভেল ব্যানে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

রোগের প্রাদুর্ভাব হয়ে গিয়েছে এমন দেশে এই মডেল প্রয়োগ করা সম্ভব নাকি বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে? উত্তর হল, না। হ্যামার বা হাতুড়ি প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি সুযোগ বেড়ে যাচ্ছে। যত বেশি সময় নষ্ট হবে, তত শক্তিশালী হ্যামার প্রয়োগ করতে হবে। তবে তাতে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলাই বাহুল্য।

কিন্তু কোনও উপায়ই কাজ না করলে?

R-এর নৃত্য

হ্যামার এবং ভ্যাকসিন আবিস্কার অথবা কার্যকরী চিকিৎসা শুরুর মধ্যের মাসাধিককাল ব্যাপী সময়টিকে আমি বলছি The Dance। কারণ এটা সেই সময় যখন ব্যবস্থাগুলোর কড়াকড়ি কমে আসতে পারে। কয়েকটি এলাকায় রোগের নতুন করে প্রাদুর্ভাব হতে পারে, আবার বাকি জায়গায় তা হবে না দীর্ঘদিন। আক্রান্ত রোগীর পরিমাণের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আমাদের স্থির করতে হবে কোথায় সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ে আরও একটু কঠোর হতে হবে অথবা আলগা দিতে হবে। একে বলে R-এর নৃত্য। যে নাচের মাধ্যমে একটি ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও আমরা এলাকা বুঝে ভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারব। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া।

নাচ কাজ করে কীভাবে?

গোটা ব্যাপারটাই R কে কেন্দ্র করে ঘুরছে। মনে করুন, একে সংক্রমণের হার বলা হয়েছিল। আগে একটি অপ্রস্তুত দেশে, R হতো ২ এবং ৩ এর মধ্যে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, কেউ একজন আক্রান্ত হলেন। সেই ব্যক্তির কাছ থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল গড়ে ২ বা ৩ জন মানুষের মধ্যে।

R যদি ১ এর উপর হয়, তাহলে সংক্রমণ লাগামছাড়া বৃদ্ধি মহামারি ডেকে আনতে পারে। আর এটা ১ এর কম হলে তা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

হ্যামার পর্ব চলাকালীন মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব R কে শূন্যের যত কাছে আনা যায়। উহানে দেখা গিয়েছে প্রাথমিকভাবে R ছিল ৩.৯ কিন্তু লকডাউন, এবং কেন্দ্রীভূত কোয়ারেন্টিন R কে টেনে নামিয়েছে ০.৩২ তে।

কিন্তু আপনি যেই ডান্স স্তরে প্রবেশ করবেন, এটা করারই কোনও দরকার নেই। আপনাকে শুধু R-কে ১ এর নীচে ধরে রাখতে হবে। একটা কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, কড়া সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের কতগুলো খারাপ দিকও আছে। যেমন কেউ চাকরি হারাতে পারেন। কারও ব্যবসা ডুবতে পারে। আবার কেউ নিজের প্রিয় এবং স্বাস্থ্যকর স্বভাব ত্যাগ করতে বাধ্য হতে পারেন।

কয়েকটি সাধারণ ব্যবস্থা নিলেই অনায়াসে R কে ১ এর নীচে রাখা সম্ভব।

এটি একটি বিশেষ গ্রাফ যেখানে বোঝা যাচ্ছে, কোন অবস্থার রোগী কীভাবে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং অবশ্যই তাঁদের সংক্রমণের মাত্রা। এই কার্ভের আসল চেহারা কেমন হবে তা অজানা। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জোগাড় করা তথ্যের সাহায্যে আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি।

প্রতিদিন যখনই তারা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসছে, তাদের রোগ সংক্রমণের প্রবণতা বাড়ছে। মনে করা হয়, শরীরে কোনও উপসর্গ না থাকার অর্থ এটা নয় যে শরীরে ভাইরাস নেই। শরীরে ভাইরাসের জমিয়ে বসতে খানিক সময় লাগে ঠিকই কিন্তু সেই সময়ও ওই ব্যক্তি সংক্রমণ ছড়িয়ে চলেছেন, নিজের অজান্তেই। এরপর উপসর্গ দেখা দিলে সাধারণত মানুষ ডাক্তারের কাছে ছোটেন, চিকিৎসা শেষে সুস্থ হন।

কারণ ভাইরাসটি যত বেশি সময় আপনার শরীরে থাকবে, ততবেশি সংক্রমণ ছড়াবেন আপনি। এরপর উপসর্দ দেখা দিলে আপনি কাজে বেরোনো বন্ধ করবেন, বিছানায় শুয়ে থাকবেন, মাস্ক পড়বেন, অথবা ডাক্তারের কাছে দৌড়বেন। উপসর্গ যত বড় হবে, আপনি ততো বেশি নিজেকে সমাজ থেকে সরিয়ে নেবেন। তাতে ভাইরাসের লাগামছাড়া ছড়িয়ে পড়াও থামানো যাবে।

একবার আপনি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলে, আপনি যত সংক্রামক অবস্থাতেই থাকুন না কেন, আপনি আইসোলেশন পর্বের মতো বেশি মাত্রায় ভাইরাস ছড়াতে পারবেন না।

আর এখানেই সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে তার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

ক. যদি বিপুল সংখ্যায় পরীক্ষা করা যায়, তাহলে উপসর্গের জন্য অপেক্ষা করার দরকার পড়বে না। সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে তাকে কোয়ারেন্টিন করা সুবিধাজনক হবে। ফলে সেখান থেকে আর ভাইরাস সংক্রমণ ছড়াতে পারছে না।

খ. যদি মানুষকে এমন প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, যেখানে নিজেরাই উপসর্গ চিনে নেওয়া যাবে, তাহলে সামগ্রিক সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

গ.  যদি মানুষের উপসর্গ দেখা দিলেই তাকে আইসোলেট করা যায়, তাহলে কমলা পর্যায়ে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে।

ঘ.  যদি মানুষকে দুরত্বের ব্যাপারে শিক্ষিত করে তোলা যায়, মাস্ক পড়া, হাত ধোয়া কিংবা একটি জায়গার জীবানুমুক্তি শেখানো যায়, তাহলে গোটা প্রক্রিয়াতেই তুলনামূলক কম ভাইরাস ছড়াবে।

একমাত্র যখন এইসব পদক্ষেপ ব্যর্থ হবে, তখনই আমাদের আরও কঠোর সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের কথা ভাবতে হবে।

সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের ROI

এত কিছু করেও যদি দেখা যায় R এর মান ১ এর চেয়ে ঢের বেশি, তাহলে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে যতজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তার পরিমাণ কমাতে হবে।

আর এগুলো করার কতগুলো বেশ সহজ উপায় আছে। যেমন নির্দিষ্ট সংখ্যকের চেয়ে বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা, অথবা মানুষকে যদি সম্ভব হয়, অফিসে না গিয়ে বাড়ি থেকে কাজ করার কথা বলা।

অন্যান্য উপায়গুলো সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ, যেমন স্কুল, কলেজ বন্ধ করে দেওয়া, সবাইকে বাড়িতে থাকতে বলা অথবা ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া।

এই চার্টটি তৈরি করতে হয়েছে, কারণ বাস্তবে এমন কোনও তালিকার অস্তিত্ব নেই। কেউ এনিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ গবেষণা করে উঠতে পারেননি।

এটাই অদ্ভুত যে এই চার্টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত রাজনীতিবিদদের জন্য। কারণ তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেন। এটা বলে তাঁদের মাথার ভিতরে ঠিক কী চলছে।

হ্যামার পর্বে, রাজনীতিবিদরা R এর মান যতো পারেন কমিয়ে দেখান। বিভিন্ন ব্যবস্থার নিরিখে মানুষের কাছে যতোটা গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। হুবেইয়ে যে মান নেমে এসেছিল ০.৩২ তে। আমাদের অত করার প্রয়োজন নেই। ০.৫ থেকে ০.৬ এর মধ্যে মান ধরে রাখলেই হবে।

কিন্তু ডান্স অফ R পিরিয়ড চলাকালীনই তা ১ এর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা ১ এর কমই থাকবে। যা কড়া ব্যবস্থা ছাড়াও রোগ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সক্ষম।

এর অর্থ হল, নেতারা বুঝুন কিংবা না বুঝুন, নিজের অজান্তের তাঁরা করে ফেলছেন,

১. R কে কম রাখতে যে সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার তালিকা

২. প্রয়োগের পর তাৎক্ষণিক সাফল্য: R এর হার কমা

৩. অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নৈতিক ব্যয় নিরুপণ

৪. খরচের অঙ্ক অনুযায়ী উদ্যোগের ক্রমতালিকা প্রকাশ

৫. সবচেয়ে কম খরচে R কে ১ এর নীচে রাখতে পারে এমন উদ্যোগকে বেছে নেওয়া

প্রাথমিকভাবে এই নম্বরগুলোর উপর আস্থা কম থাকবে। কিন্তু এটাই উপায়।

এবার কাজ একটাই, প্রক্রিয়াটিকে চূড়ান্ত করা। এবং অতি অবশ্যই এটা বোঝা যে, গোটাটাই নম্বরের খেলা। যত আগে আমরা বুঝে উঠতে পারব, R-এর মান কমানোর উদ্যোগও নেওয়া সম্ভব হবে।

একমাত্র তখনই তারা কোন পথ নেওয়া হবে, তা নিয়ে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

উপসংহার: শুধু একটু সময় চাই…

করোনাভাইরাস এখনও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। ১৫২ টি দেশে করোনা আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। আমাদের যুদ্ধ ঘড়ির কাটার বিরুদ্ধে। কিন্তু এর প্রয়োজন নেই। এজন্য একটি পৃথক রাস্তা আছে।

কয়েকটি দেশ, যেখানে এখনও পর্যন্ত করোনার থাবা এসে পড়েনি, তারা ভাবছে, এটা কি আমার সঙ্গেও হবে? উত্তর হল, সম্ভবত ইতিমধ্যেই হওয়া শুরুও হয়ে গিয়েছে। আপনি খেয়াল করেননি। আর যখন বুঝতে পারবেন, তখন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে, বিশ্বের ধনী দেশগুলোতে তাই হয়েছে। অথচ সেই দেশগুলোতে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অত্যন্ত ভালো। বিপদে পড়ার আগে সাবধান হওয়া তাই ঢের ভালো। সময় থাকতেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

যে দেশগুলোতে করোনাভাইরাস ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে, সেখানে মোকাবিলার পদক্ষেপও খুব স্পষ্ট।

একদিকে দেশগুলো মিটিগেশনের মাধ্যমে চেষ্টা করে দেখতে পারে, যেখানে অতি বিপুল মহামারি হতে দেওয়া হবে, অতিরিক্ত চাপের মুখে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তেও দেওয়া হবে এবং অবশ্যই ভাইরাসটিকে আরও মিউটেট করার সুযোগ দেওয়া হবে।

আর অন্যদিকে, দেশগুলো লড়াই করতে পারে। তারা কয়েক সপ্তাহের জন্য লকডাউন জারি করে খানিকটা সময় আমাদের হাতে তুলে দিতে পারে। তারপর সুগঠিত অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী এই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ, যতক্ষণ না ভ্যাকসিন আবিস্কার হচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ, যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ড রয়েছে, তারা মিটিগেশন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।

এর অর্থ হল, লড়াই না করেই আত্মসমর্পণ। তারা দেখছে অন্যান্য দেশ কীভাবে সফল হচ্ছে। কিন্তু তাদের মুখে একটিই বাণী, আমরা পারব না।

ভেবে দেখুন, যদি চার্চিল একই কথা বলে বসতেন? ঠিক এই কাজটিই দুনিয়ার একাধিক দেশ করে চলেছে। তারা আপনাকে লড়াই করার একটা সুযোগ পর্যন্ত দিচ্ছে না। লড়াইয়ের অধিকার আপনাকেই দাবি করতে হবে। (শেষ)

Comments are closed.