পশ্চিম বর্ধমানে সিপিএমে গোষ্ঠী কোন্দল চরমে। দুর্গাপুরের সিপিএম বিধায়কের ইস্তফা পত্র, অভিযোগ কেন্দ্রীয় কমিটিকে।

নির্বাচনী রাজনীতিতে লাগাতার বিপর্যয়। বিরোধী দলের জায়গাটা প্রায় দখল করেই নিয়েছে বিজেপি। এই অবস্থায় কোথায় সর্বশক্তি দিয়ে হারানো জমি উদ্ধারে লড়বে, তা না, অভ্যন্তরীণ গোলমালেই জর্জরিত সিপিএম। জেরবার অবস্থা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের।
নতুন জেলা পশ্চিম বর্ধমানে সম্পাদকমণ্ডলী গঠনকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে চূড়ান্ত ডামাডোল। জেলা নেতৃত্ব এবং খোদ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সরাসরি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে অভিযোগ জানালেন পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুর এলাকার সিপিএমের একাধিক জেলা কমিটির সদস্য। শুধু তাই নয়, এই জেলারই দুর্গাপুর পূর্বের সিপিএম বিধায়ক সন্তোষ দেবরায় বামফ্রন্টের পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীকে ইস্তফা পত্রও পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি জানিয়েছেন, দুর্গাপুরের সিপিএম নেতাদের যেভাবে হেনস্থা এবং অপমান করা হয়েছে তাতে তাঁর পক্ষে বিধায়ক পদে থাকা সম্ভব নয়। ঘটনার সুরাহা না হলে তিনি পদত্যাগ পত্র বিধানসভার অধ্যক্ষকেও দেবেন বলে সূত্রের খবর।
ঘটনার সূত্রপাত কয়েক দিন আগে। সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের পর গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সব জেলায় নিয়মমাফিক জেলা সম্পাদকমণ্ডলী গঠনের কাজ চলছে। আর এই জেলা সম্পাদকমণ্ডলী গঠনকে কেন্দ্র করেই ক্ষোভে ফুটছেন পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের নেতারা। সম্প্রতি পূর্ব এবং পশ্চিম, দুভাগে ভাগ করা হয়েছে বর্ধমান জেলাকে। পশ্চিম বর্ধমানে সিপিএমের জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রাক্তন বিধায়ক এবং শ্রমিক নেতা গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। মূলত, আসানসোল, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল এবং কাঁকসাসহ কিছু গ্রামীণ এলাকা নিয়ে গঠিত এই জেলা। এবার পশ্চিম বর্ধমানে জেলা কমিটি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ৫০ জন। গত সপ্তাহে ছিল এই জেলার সম্পাদকমণ্ডলী গঠন। সূত্রের খবর, সেখানে ১০ জনের জেলা সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করা হয়েছে। তার মধ্যে কাঁকসা এলাকা থেকে আছেন দুই জেলা কমিটি সদস্য, বীরেশ মন্ডল এবং অলোক ভট্টাচার্য। বাকি ৮ জনই আসানসোল এলাকার। কিন্তু দুর্গাপুর এলাকা থেকে একজন জেলা কমিটির সদস্যকেও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে জায়গা দেওয়া হয়নি। আর এখানেই ক্ষোভের সূত্রপাত। দুর্গাপুর পূর্বর বিধায়ক সন্তোষ দেবরায়, শান্তি চ্যাটার্জি, মহাব্রত কুন্ডু, পঙ্কজ রায় সরকার, লাল্টু দে’র মতো জেলা কমিটির একাধিক নবীন এবং প্রবীন সদস্য রয়েছেন, যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরেই নানা আন্দোলন-সংগ্রামে রয়েছেন। কিন্তু দুর্গাপুর এলাকার একজনকেও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে না নেওয়ায় তাঁরা প্রত্যেকেই সিপিএমের অন্দরে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করেই তাঁরা থামেননি। দুর্গাপুরের একাধিক নেতা জেলা নেতৃত্ব এবং আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের রাজ্য নেতাদের বিরুদ্ধে স্বজনপোষনের অভিযোগ জানিয়ে সরাসরি চিঠি পাঠিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে। সন্তোষ দেবরায় এই ঘটনার প্রতিবাদে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিতে চান বলে চিঠি পাঠিয়েছেন সুজন চক্রবর্তীর কাছে। আর বিধানসভাতেও না যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি।
অবিভক্ত বর্ধমান জেলা সিপিএমে বরাবরই দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। রথীন রায়, অজিত মুখার্জি, দেববত ব্যানার্জিসহ দুর্গাপুরের একাধিক নেতা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে থাকতেন। কিন্তু জেলা ভাগ হয়ে ছোট হলেও দুর্গাপুর থেকে সেখানে কেউ নেই কেন, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে এই দুর্গাপুরের দুটি আসনেই যেখানে তৃণমূল হারে। একটি আসন জেতে সিপিএম, অন্যটি জোট প্রার্থী কংগ্রেসের বিশ্বনাথ পারিয়াল।
সূত্রের খবর, ভোটে ভাল রেজাল্ট সত্ত্বেও দুর্গাপুরের নেতাদের এই বঞ্চনার পিছনে কাজ করছে কংগ্রেসের সঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের জোটের অঙ্ক। আসলে দুর্গাপুরের প্রায় সব সিপিএম নেতাই কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বিরুদ্ধে। যেভাবে জোটের পক্ষে থাকার জন্য এবার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে মানব মুখার্জি, অনাদি সাহু, আভাস রায়চৌধুরী এবং সুমিত দে’কে ঢোকানো হয়েছে, একইভাবে জোটের বিরোধিতা করার জন্যই দুর্গাপুরের নেতাদের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে নেওয়া হয়নি বলে সিপিএম সূত্রের খবর। পাশাপাশি, পশ্চিম বর্ধমানে সিপিএমের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, আভাস রায়চৌধুরী প্রায় ২০ বছর আসানসোলে রাজনীতি করার পর তাঁকে পূর্ব বর্ধমানে আনা হয়েছে এবং সেখান থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু শুধুমাত্র জোটের নীতিগত বিরোধিতার জন্য অন্য নেতাদের বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, তৃণমূল সরকারে আছে, ওদের গোষ্ঠী কোন্দলের তাও মানে বোঝা যায়, কিন্তু সরকারে না থেকেও আমাদের দলের ভেতরে যা অবস্থা তা কর্মীদের মধ্যে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.