সততাই ছিল একমাত্র পুঁজি, তিনি প্রথম বাঙালি কোটিপতি; চেনেন ব্যবসায়ী রামদুলাল দে’কে?

৬৭-এ,বি,সি,ডি বিডন স্ট্রিট। লাল রঙের একটি শতাব্দী প্রাচীন বাড়ি। সবাই যে বাড়িকে ছাতু বাবু লাটু বাবুর বাড়ি নাম চেনে। উত্তর কলকাতার দূর্গ পুজো মানেই ছাতু বাবুর লাটু বাবুর বাড়ির পুজো দেখতে যাওয়া ‘মাস্ট’। এই বিখ্যাত বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এবং দূর্গা পুজো শুরু করে ছিলেন যিনি। সে সময়ে যাঁর ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছিল মার্কিন মুলুক। বলা ভালো ১৭৯৫ সাল থেকে বাংলার সঙ্গে আমেরিকার ব্যবসায়িক যোগাযোগের তিনিই ছিলেন একমাত্র যোগসূত্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে নিজের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দাঁড় করিয়েছিলেন। এক কথায় সততাকে পুঁজি করে শূন্য থেকে শিখরে পৌঁছিলেন। তিনি রামদুলাল দে। প্রথম বাঙালি ব্যবসায়ী।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায়, ১৭৫২ সালে দমদমের কাছে রেকজানি গ্রামে জন্ম রামদুলাল বাবুর। এক অতি সাধারণ পরিবারে। ছোটবেলাতেই মা বাবাকে হারান তিনি। বড় হন ঠাকুমার কাছে। এমনটাও জানা যায়, সংসার চালাতে তাঁর ঠাকুমা হাটখোলার দত্ত বাড়িতে রাঁধুনির কাজ নিয়েছিলেন। কিশোর বয়েস থেকেই রামদুলালও জীবিকার সন্ধান শুরু করে দিয়েছিলেন। জনৈক ব্যবসায়ী বলরাম সরকারের কাছে হিসাব রক্ষকের কাজ শেখেন। এরপর সেখান থেকে মামা রামসুন্দর বিশ্বাসের সাহায্যে এক ব্রিটিশ কোম্পানিতে কাজ জুটিয়ে ফেলেন। ওই কোম্পানিতেই আধুনিক বুক কিপিং সহ ব্যবসার নানান খুঁটিনাটি শেখেন। এরপর রামদুলাল সরকার সে সময়ের কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী মদনমোহন দত্তের জাহাজ সরকার বা হিসাব রক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। আর জাহাজ সরকারের কাজই রামদুলালের জীবনের মোর ঘুরিয়ে দেয়।

জানা যায়, সে সময় পুরাতন জাহাজের নিলাম হত। ব্যবসায়রা নিলামে সেই জাহাজ ক্রয় বিক্রিয় করতেন। রামদুলাল এমনই এক জাহাজের নিলাম অংশ নিয়ে মাত্র ১৪ হাজার টাকায় একটি জাহাজ কিনে সে সময় ১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সেই জাহাজ বিক্রি করেন। তবে মুনাফার পুরো টাকাটাই তিনি মদনমোহন দত্তকে নিয়ে এসে ফেরত দেন। আর রামদুলালের এই সততায় মুগ্দ্ধ হয়ে তাঁকে পুরো এক লক্ষ টাকাই ফিরিয়ে দেন মালিক মদনমোহন দত্ত। এবং রামদুলালকে স্বাধীনভাবে ব্যবসার অনুমতি দেন। আর সেই টাকাতেই ব্যবসা করে খুব শীঘ্রই রামদুলাল কলকাতা একজন ধনবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হন। এবং প্রভূত অর্থ রোজগার করেন।

১৭৯৫ সাল থেকে আমেরিকার বণিকরা বঙ্গোপসাগরের পথে বাংলায় আসতে শুরু করে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। ১৮০০ সল্ পর্যন্ত আমেরিকা থেকে আগত সমস্ত জাহাজে মালিকই রামদুলালকে তাঁদের স্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করে। পরে রামদুলাল দে কলকাতায় নিজেস্ব ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডিং এজেন্সি শুরু করে ব্যবসা করেন। এবং শোনা যায়, রামদুলালের দক্ষতা এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে মার্কিন ব্যবসায়ীরাও বাংলায় ব্যবসা করে প্রভূত মুনাফা অর্জন করে। এবং যার প্রতিদান হিসেবে মার্কিন ব্যবসায়ীরা রামদুলালকে আমেরিকার নিয়ে গিয়ে সম্বর্ধনার প্রস্তাব দেন। যদিও ধার্মিক রামদুলাল কালা পানি পেরোতে রাজি হননি। বিকল্প হিসেবে সে দেশের ব্যবসায়ীরা রামদুলালের একটি পোট্রেট আঁকিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া মেরিন সোসাইট মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করে। এমনকী সেখানকার একটি জাহাজের নামকরণও করা হয় রামদুলাল দে’র নামে।

শুধু উপার্জনই নয়, দানধ্যানের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন রামদুলাল দে। তৎকালীন হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক অর্থ দান করেছিলেন তিনি। এছাড়াও উনিশ শতকের গড়ার দিকে কলকাতার সকল ধরণের শিক্ষা মূলক, জনসেবা এবং অন্যান্য সামাজিক কাজে বিপুল অর্থ দান করেছিলেন। এমনকী ১৪ বিঘের জমির ওপর নিজের বসত বাড়ি তৈরির পাশাপাশি ২৫ বিঘে জমির ওপর তৈরি করেছিলেন একটি বিশাল অতিথিশালা। যেখানে রোজই কয়েক হাজার অতিথি আশ্রয় পেতেন। আজ বাঙালি যে ইতিহাস নিয়ে গর্ব করে রামদুলাল দে’র মতো ব্যক্তিত্বরা ছিলেন সেই ইতিহাসের এক প্রধান অংশীদার।

Comments are closed.