বড়দিনের জন্য সেজে উঠছে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, জানেন প্রায় ১৫০ বছর চার্চের এক অজানা গহ্বরে কফিনবন্দি ছিলেন প্রথম বিশপ

এই শহর কলকাতার অন্যতম বৃহৎ স্থাপত্য সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চ (St Pauls Cathedral)। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পূর্ব দিকে অবস্থিত এই বৃহৎ চার্চটি। চার্চের পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস। ইতিহাস বলছে, প্রায় ১৭২ বছর আগে এই চার্চটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম এপিস্কোপাল চার্চ হিসাবে বিখ্যাত সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল।

সালটা ১৮৩৯, যখন এই চার্চের কাজ শুরু হয়েছিল। আর প্রায় আট বছর পর ১৮৪৭ সাল নাগাদ এর কাজ সম্পূর্ণ হয়। চার্চের বিশপ ড্যানিয়েল উইলসনের তত্ত্বাবধানে এই চার্চের নির্মাণকার্য শুরু হয়েছিল। আকৃতিগত দিক দিয়ে এটি প্রায় ২৪৭ ফুট লম্বা, ১১৪ ফুট চওড়া এবং ১৭৫ ফুট এর উচ্চতা। নির্মাণ করতে খরচ হয়েছিল তৎকালীন সময়ে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে ইংল্যান্ডের নরউইচ চার্চের সঙ্গে এই সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বিংশ শতকের গোড়া থেকে কলকাতায় ব্রিটিশদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এই বৃদ্ধি পাওয়া জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি চার্চের। সেই উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রেখেই নির্মাণ করা হয় সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। অবশ্য ইতিহাস বলছে, ১৮১৯ নাগাদ বিশপ মিডলটনের উদ্যোগে সেন্ট জনস গির্জার পাশাপাশি আরও একটি গির্জা তৈরির পরিকল্পনা এসেছিল খ্রিস্টান সমাজপতিদের মাথায়। ভাবনা আসার অনেক পরে সেই কাজকে বাস্তবায়িত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন চার্চের বিশপ ড্যানিয়েল উইলসন।

তবে ইতিহাস যাই বলুক না কেন, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের (St Pauls Cathedral) ঐতিহ্যটাই আলাদা। এই বৃহৎ চার্চের নকশা প্রস্তুত করেছিলেন মেজর উইলিয়াম ফোর্বস সাহেব, আর তাঁকে সাহায্য করেছিলেন তাঁর সহকারি রবার্টসন। নকশা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্মাণ কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইন্দো-গথিক স্থাপত্য হিসেবে অধিক পরিচিত সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চ। এই চার্চ আদপে ভিক্টোরিয়ান এজের প্রথম অ্যাঙ্গলিকান ক্যাথিড্রাল। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের নির্মিত স্থাপত্যগুলি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ফিলিপ ডেভিস তাঁর রচিত ‘Splendours of the Raj: British Architecture in India, 1160-1947’,  গ্রন্থে যথার্থই বলেছিলেন, “The building was constructed in a peculiar brick especially prepared for the purpose, which combined lightness with compressional strength; the dressings were of Chunar stone, and the whole edifice was covered inside and out with polished chunam.”।
এবার না হয় আসা যাক ভারতবর্ষে আগত পঞ্চম বিশপ হিসেবে খ্যাত ড্যানিয়েল উইলসনের কথায়। উইলসন সাহেব ১৭৭৮ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। এর পরে অবশ্য অক্সফোর্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। উইলসনের জীবনী সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের অনেকটাই নির্ভর করতে হয় তাঁর জামাইয়ের রচিত লেখার উপর। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন বাস্তবদ্রষ্টা ও নিয়মমাফিক মানুষ ছিলেন। ভারতবর্ষের জটিল জাতি ব্যবস্থা প্রসঙ্গে উইলসন সাহেবের যথার্থ উপলব্ধি ছিল এই প্রকার জাতি ব্যবস্থা ক্যান্সারের স্বরূপ। ঢাকা কলেজ নির্মাণের ক্ষেত্রে উইলসন সাহেবের যথেষ্ট ভূমিকার কথাও জানা যায়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান থেকে আমরা জানতে পারি, কলকাতার বিশপের সহযোগিতায় ঢাকা কলেজ নির্মিত হয়েছিল। এর পাশাপাশি, রেঙ্গুন, শ্রীলঙ্কাতেও চার্চ নির্মাণের ক্ষেত্রে উইলসন সাহেবের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ইতিহাস আবার বলছে, এই উইলসন সাহেবের দেহ কফিনবন্দি অবস্থায় এই চার্চের কোথাও একটা রাখা রয়েছে, তবে ঠিক কোন জায়গায় ঠাহর করা মুশকিল। অবশ্য সম্প্রতি সেই কফিন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। একটি ইংরেজি দৈনিকের  প্রতিবেদন অনুযায়ী, “Historians and church authorities have claimed for years that Bishop Wilson, who died 150 years ago, lies in rest “somewhere in the belly” of the cathedral but no one knew exactly where. Last week, when structural engineers dug a small hole into the floor of the damaged altar to assess its strength, they realised it was hollow underneath. A little more prodding revealed what could be a vault and suddenly they were facing the crypt with the coffin inside.” মার্চ, ২০১৯।
এর পাশাপাশি অবশ্য আরেকটি বিষয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে। উইলসন সাহেবের মৃত্যু হয়েছিল ১৮৫৮ সাল নাগাদ। মৃত্যুর ১৫ বছর আগে নির্মিত ভল্টটি তিনি নিজে ইন্সপেকশন করেন, যেখান থেকে তাঁর কফিন পাওয়া গেছে। এক জার্নালে তিনি যথার্থই লিখেছিলেন, “I could not but think as I walked up and down the abode of death how soon I might be called to lay down my pastoral staff and rest in that bed or grave as to my mortal frame, till the Resurrection morn (sic).” শুধু তাই নয় তিনি তাঁর সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ চার্চে দান করে গিয়েছেন এবং তাঁর বইয়ের বৃহৎ সম্ভারও এখন চার্চের নিয়ন্ত্রাধীন। এই সংখ্যা শুনলে আপনি চমকে উঠতে পারেন। প্রায় ৮ হাজারের কাছাকাছি বই ছিল উইলসন সাহেবের।
নির্মিত হওয়ার পরে ১৮৯৭ সালে এবং ১৯৩৪ সাল নাগাদ ঘটে যাওয়া ভুমিকম্পের ফলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল (St Pauls Cathedral)। তবে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই সারিয়ে ফেলা হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলি। চার্চ প্রান্তরে প্রবেশ করলেই ঠিক কেমন শান্ত হয়ে যাবে আপনার মনটা আর চার্চের মূল স্থাপত্যের ভেতরে যদি প্রবেশ করেন তাহলে এক নিস্তব্ধ এবং শান্ত পরিস্থিতিতে আপনাকে মুগ্ধ করবে।
গির্জার অভ্যন্তরের অলংকরণ যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে, একাধিক চিত্রের মাধ্যমে সেন্ট পলস এর জীবনের বিভিন্ন অংশগুলি শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছেন।  তবে হ্যাঁ, প্রবেশ করলে এটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে চার্চের ভেতরে ছবি তোলা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তাই শুধুমাত্র চোখে দেখে মনকে তৃপ্ত করা।  সামনে আবার বড়দিন প্রতি বছর ২৪ ডিসেম্বর মাঝরাতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান এই সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সামনে। আসল উদ্দেশ্য, যিশুর জন্মদিন উপলক্ষে এই চার্চে প্রবেশ করা এবং চার্চ কর্তৃপক্ষ প্রতি বছরই কিছু-না-কিছু উৎসব পালন করেন। তাই বড়দিন উপলক্ষে নতুনভাবে আবার সেজে উঠছে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। এই চার্চ বারবার তার স্থাপত্য, ভাস্কর্যের জন্য বাঙালির কাছে আবেগের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই চার্চ বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। কলকাতার একাধিক উত্থান-পতনের সাক্ষী সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল।

Comments are closed.