বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণাক্ষরে খচিত নাম তুলসী চক্রবর্তী, টলিউড থেকে দেওয়া হয়নি যোগ্য সম্মান! লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে ভিক্ষে করতে হয়েছিল অভিনেতার বিধবা স্ত্রীকে! এমন এক অজানা কথা কেড়ে নেবে আপনার রাতের ঘুম

স্বর্ণযুগের জনপ্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে একজন হলেন তুলসী চক্রবর্তী। টলিউডের স্বর্ণযুগের এক স্বর্ণ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি নিজেই জানতেন না তাঁর কতটা দাম। পরশপাথরের এই অভিনেতা নিজেই যে এক পরশপাথর সেটুকু বুঝতে পারেননি তিনি তাঁর কর্মজীবনে। আর সেই জন্যই হয়তো টলিউড তাঁকে তাঁর যোগ্য সম্মানটাও দেয়নি। অভিনেতার বিধবার স্ত্রীকে চূড়ান্ত অর্থকষ্ট সহ্য করতে হয় সেই সময়। দরজার দরজায় ঘুরে ভিক্ষে পর্যন্ত করতে হয়েছিল।

স্বর্ণযুগের কথা বাদ দিলেও বাংলা সিনেমার শুরুর দিনে একটি স্তম্ভ ছিলেন অভিনেতা। বাংলা সিনেমা শুরুর সময় যদি কিছু অভিনেতাদের লিস্ট করা হয় তাঁর মধ্যে প্রথম পাঁচ জনের একজন হবেন তুলসী চক্রবর্তী। ডায়লগের বোধহয় প্রয়োজনই পড়তো না অভিনেতার। চোখে মুখের এমন এক্সপ্রেশন যেন তাতেই মানুষ বুঝে যান যে কি বলতে চাইছেন অভিনেতা। আবার তারই সাথে অভিনয়ের এত দারুন অভিব্যক্তি যা ডায়লগকে প্রাণ দিতে পারে। তাঁর অভিব্যক্তি এতটাই বাস্তব উচিত ছিল যে দর্শক দেখতে দেখতে হারিয়ে যেতেন কল্পনার বাস্তবোচিত পরিবেশে।

অভিনেতা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৩ সালে। প্রথম জীবনে বেশ কিছু নাট্য গোষ্ঠীর সাথে অভিনয়ের সূচনা করেন। এমনকি জোর কদমে নিজের অভিনয় চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও দারিদ্রতা ছিল অভিনেতার জীবনের নিত্য সঙ্গী। ১৯৩২ সালে মুক্তি পায় অভিনেতার প্রথম সিনেমা “পুনর্জন্ম”। এই সিনেমার হাত ধরেই টলিউডের পা রাখেন অভিনেতা। কিন্তু তাতেও তাঁর আর্থিক কষ্টের কোন সুরাহা হয়নি। টলিউড এই মহান অভিনেতার দাম দিতে পারেনি। ইন্ডাস্ট্রিতে একের পর এক চরিত্রের সাফল্যতার মধ্যে দিয়ে অভিনেতা বুঝিয়ে দেন তাঁর জাত।

প্রসঙ্গত পঞ্চাশের দশকে চুটিয়ে কাজ করেছেন এই অভিনেতা। এমনও গেছে যে একটি বছরে ১০ থেকে ১২ টি সিনেমা করেছেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও অভিনেতার দারিদ্রতা কাটেনি। আজীবন তাঁকে ড্রামে বাসে করেই যাতায়াত করতে হয়েছে স্টুডিও পাড়াতে। চরিত্রের কোন বাছ বিচার করেনি অভিনেতা। এমনকি যে চরিত্র নিয়ে অভিনেতার কাছে আসতেন তিনি সেই চরিত্রকেই সার্থকতা দিতেন। চরিত্রের পারিশ্রমিক নিয়ম কখনো দর দাম করেননি তিনি। সর্বদাই অভিনয়ে কে সবার আগে স্থান দিয়েছেন।

যদিও জানা যায় ছোটবেলা থেকেই চরম দারিদ্রতার সম্মুখীন হয়েছেন এই অভিনেতা। আর সেই জন্যই হয়তো নিজের দাম টুকু কখনো বুঝতে পারেনি তিনি। এছাড়াও হয়তো অভিনেতার মনে ভয় কাজ করতো যে তিনি যদি পারিশ্রমিক বাড়ান তাহলে যদি তিনি কাজ না পান। সেই জন্য কখনোই পারিশ্রমিক বাড়াতেন না অভিনেতা। মাত্র ৬২ বছর বয়সেই পরলোক গমন করেন এই পরশ পাথর। কিন্তু হায় নিজের দামটুকু বুঝতে পারলেন না তিনি। তখনই যদি বুঝতে পারতেন তাহলে হয়তো দারিদ্রতা মাথায় নিয়ে পরলোক গমন করতে হত না তাঁকে। এছাড়াও তাঁর বিধবা স্ত্রীকে দুয়ারে দুয়ারে বাটি পেতে ভিক্ষাও করতে হতো না।

জানা যায় সত্যজিৎ রায় কদর করতেন এই অভিনেতার। তিনি জানতেন এই অভিনেতার যোগ্য পারিশ্রমিক কত হওয়ার কথা। অভিনেতাকে পরশপাথর সিনেমার জন্য সত্যজিৎ রায় নিজেই কাস্ট করেছিলেন। আর তারপরে যখন চরিত্রের পারিশ্রমিক সম্পর্কে অভিনেতাকে জানান তখন নাকি তুলসী চক্রবর্তী সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে কেঁদে দিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যজিৎ রায় বুঝতেন তাঁর কদর। আবার এমনও শোনা গেছে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেও যথাযথ পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না অভিনেতাকে। আর তিনি নিজেও কখনো সেসব নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেননি।

অভিনেতা কোনদিনই তাঁর গুণের সঠিক ফলাফল পাননি। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা বঙ্গের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পদ্মশ্রীও তাঁর কপালে জোটেনি। তবে অভিনেতা তাঁর অভিনয়ের জন্য প্রচুর মেডেল জিতেছিলেন। অভিনেতার প্রয়াণের পর তাঁর বিধবা স্ত্রীকে সেসব মেডেল বেচে দিন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। তবে এটুকু বলতেই হবে যে এই দুঃসময়ে তুলসী চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রী এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। এছাড়াও আটিস ফোরাম থেকেও তাঁকে কিছু সাহায্য করা হয়েছিল।

Comments are closed.