অনুপ্রেরণার অন্য নাম কীর্তা দুরপা, মাওবাদী অধ্যুষিত অবুঝমাঢ়ে প্রথম ওষুধের দোকান খুলে চমক আদিবাসী তরুণীর
খাবার থেকে জল, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগাড় করতেই সেখানে কালঘাম ছুটে যায়। আর শরীর খারাপ হলে, ভরসা বহু দূরের হাসপাতাল কিংবা ওষুধের দোকান। যদিও বেশিরভাগ সময়ই হাসপাতাল পৌঁছনোর আগেই সময় শেষ হয়ে যায়। ছত্তিসগঢ়ের প্রত্যন্ত অবুঝমাঢ় জঙ্গলে ঢাকা এলাকায় ওষুধের দোকান খুলে সবাইকে চমকে দিলেন বছর তেইশের আদিবাসী তরুণী কীর্তা দুরপা।
ছত্তিশগড়ের নারায়ণপুর, বীজাপুর ও দান্তেওয়াড়া জেলা জুড়ে অবুঝমাঢ়ের ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলঘেরা এলাকায় যুগ যুগ ধরে বাস করছেন গণ্ড, মুরিয়া, হালবাসের মতো আদিবাসী মানুষ। যাঁদের সামান্য ওষুধ কিনতেও পেরোতে হয় অন্তত ৭০ কিলোমিটার রাস্তা। এমন প্রত্যন্ত জায়গায় ওষুধের দোকান খুলে যেমন নিজের সাহসিকতার পরিচয় দিলেন কীর্তা দুরপা, তেমনি তাঁর স্বনির্ভর হওয়ার তীব্র ইচ্ছা অনুপ্রেরণা যোগাবে অন্যদেরও।
নারায়ণপুরের ওর্চা গ্রামে প্রতি বুধবার হাট বসে। দূর দূরান্ত থেকে এসে আদিবাসীরা বিকিকিনি করেন সেই হাটে। অভিযোগ, কয়েক মাস আগে মাওবাদী হামলার ঘটনার জেরে গ্রামের একমাত্র ‘জন ওষুধী কেন্দ্র’, যেখানে কম দামে ওষুধ কিনতে পারতেন আদিবাসীরা, সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। চরম সমস্যায় পড়েন এলাকার মানুষ। এই সময়ই মুশকিল আসান হিসেবে এগিয়ে আসেন তরুণী কীর্তা। ওর্চায় একটি ওষুধের দোকান খোলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তিনি।
১৩ ই এপ্রিল ছিল তরুণী কীর্তার স্বপ্নপূরণের দিন। যাত্রা শুরু করে এলাকার একমাত্র ওষুধ দোকান। এর ফলে সরাসরি উপকৃত হবেন আশেপাশের একাধিক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। অর্থাভাবে দ্বাদশ শ্রেণির পর আর পড়াশোনা চালাতে পারেননি কীর্তা। সেটা ২০১৪ সাল। সেই বছরই ছত্তিশগড়ে অপুষ্টি নিয়ে আদিবাসীদের সচেতনতা বাড়াতে একটা প্রচার অভিযান চালাচ্ছিল ইউনিসেফ। সেখানে দোভাষীর কাজ পেয়েছিলেন কীর্তা। প্রায় ৭০ টা গ্রাম ঘুরে ঘুরে ইউনিসেফের প্রচারে অংশ নেন তিনি। দেখেছিলেন মাত্র ২০ টাকার ওষুধ কিনতে কীভাবে সাধারণ মানুষকে মাইলের পর মাইল রাস্তা হেঁটে পেরোতে হয়। কীর্তা উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর নিজের রাজ্যের অসংখ্য মানুষ কীভাবে ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাবে কষ্ট পান। কীভাবে ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়া, ত্বকের অসুখই মহামারির রূপ নেয়। আর সেখানেই কীর্তার স্বপ্ন দেখার শুরু।
কীর্তার পরিকল্পনার কথা শুনে উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁর দাদা সুখরাম দুরপা। কর্মসূত্রে তিনি রায়পুরের এক ক্লিনিকে কাজ করেন। শেষপর্যন্ত দাদা আর গ্রামের মানুষদের সহযোগিতায় একটি পুরোদস্তুর ওষুধের দোকান খুলে ফেলেছেন কীর্তা দুরপা। অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ তো আছেই, তাছাড়া দাদার সাহায্য নিয়ে রায়পুর থেকে অর্ডার মাফিক ওষুধও আনিয়ে দেন কীর্তা। দৈনিক ১২ ঘন্টা খোলা থাকে দোকান, গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন করে ক্রেতা আসেন ওষুধ কিনতে। আশেপাশের আট দশটা গ্রামের মানুষ যেমন উপকার পাচ্ছেন, তেমনি প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার টাকা দোকান থেকে আয় করে স্বনির্ভর হয়েছেন কীর্তা দুরপাও। তাঁর কথায়, দোকান করার পর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও অসুবিধা বা বিপদের মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে। বছর তেইশের আদিবাসী তরুণীর ইচ্ছে, আশেপাশের অঞ্চলে আরও কয়েকটা ওষুধ দোকান খোলার।
Comments are closed.