দেশপ্রিয় পার্কে সাউথ পয়েন্টের ছেলেটাকে দৌড়তে দেখেছেন এলাকার সবাই। সকাল, বিকেল বা দুপুর, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট হোক কিংবা ব্যাডমিন্টন, ছেলেটা সবেতেই একরাশ উৎসাহ নিয়ে হাজির। খেলাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু পাড়ার খেলায় যা হয়, বড়দের মনে ধরলে তবেই ব্যাট কিংবা বল করার সুযোগ মেলে। ছেলেটার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু পাড়ার দাদাদের কী করে বোঝানো যায়, যে সে যোগ্য? খেলার সুযোগ পেলে তবে না বোঝানো… তাহলে কি এভাবেই বল কুড়িয়ে জীবন যাবে? ভেবে ভেবে মাথা থেকে উপায় বের করল ছেলেটা। পাড়ার বড়দের বোঝানোর মোক্ষম হাতিয়ার হল মুখ! আজ এতদিন বাদে ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অভীকের মনে পড়ে যায়, সেই দিনগুলোর কথা। অভীকের কথায়, ‘পাড়ার মাঠে বল করতে গেলেও সিনিয়রদের ইমপ্রেস করতে হতো।’ কিন্তু স্রেফ কথার জাদুতে ভুলিয়ে কাজ হাসিল করলেও, তা কি আদৌ দীর্ঘস্থায়ী হয়? অভীক বলছেন, না। পাড়ার বড়দের ইমপ্রেস করে বল করার সুযোগ তো পাওয়া গেল, এবার তো নিজেকে বল হাতে প্রমাণ করতে হবে। আবার নিজের ছেলেবেলায় ডুব দেন অভীক। ‘এভাবে দাদাদের ইমপ্রেস করার পর প্রথম বল যেটা করেছিলাম, মনে আছে, স্টাম্প ভেঙে গিয়েছিল, ব্যাটসম্যান ব্যাট নামানোর সুযোগ পায়নি।’ এটাই অভীক রায়। কথা দিয়ে ইমপ্রেস করে কাজ দিয়ে তা প্রমাণ করাই আন্দ্রে গার্সিয়া কর্ণধারের ইউএসপি। ঠিক এভাবেই এল অভীকের জীবনের প্রথম বড় ব্রেক।
সেটা ২০০০ সাল, জার্মানিতে একটি সিগার ফেয়ারে অভীকের সঙ্গে প্রথম দেখা থম্পসন গ্রুপের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ফ্রান্সব্লোর। সিগার দুনিয়ায় রবার্টকে সবাই জানেন বব ফ্রান্সব্লো নামে। অভীকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া কথোপকথনের আগে একটু বলে নিই এই থম্পসন গ্রুপ সম্বন্ধে। শতবর্ষ প্রাচীন এই থম্পসন গ্রুপের হেড অফিস ফ্লোরিডায়। ১৯১৫ সালে ফ্লোরিডার টাম্পা থেকে যাত্রা শুরু করে থম্পসন। তারপর সারা বিশ্বে সিগার ও সিগার অ্যাকসেসারিজ বিক্রির ক্ষেত্রে তারা কার্যত মাইল ফলক। সেই থেকেই সিগার দুনিয়ার রাজধানী বলে পরিচিতি পায় ফ্লোরিডার টাম্পা। সেই জগদ্বিখ্যাত গ্রুপের প্রেসিডেন্ট বব ফ্রান্সব্লো প্রথম যখন শুনেছিলেন ইউরোপ-আমেরিকার বাইরের কেউ সিগার নিয়ে এতটা সিরিয়াস কাজ করার কথা ভাবছেন, একটু অবাক হয়েছিলেন বৈকি। ভারতের সেই তরুণের সঙ্গে কথা বলে অবশ্য তাঁর ধারণা বদলে গিয়েছিল পুরোপুরি। সেদিন সিগার সম্বন্ধে অভীকের প্যাশনের কোনও কূলকিনারা খুঁজে পাননি সিগার দুনিয়ার জীবন্ত কিংবদন্তি বব। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলেন কলকাতার তরুণের সিগার-স্বপ্নের কথা। অভীক ঠেকে শিখেছিলেন, স্রেফ কথায় কাজ হয় না। তাই সেই স্বপ্নকে ছোঁয়ার রাস্তাও অভীক জানতেন খুব নির্দিষ্ট করে। বব সেদিন বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার কাজ শুরু করে ফেলো। তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা আমার কাছে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। তোমার সংস্থার প্রথম প্রোডাক্ট কিনবে থম্পসন সিগার। এ কথা আজই আমি তোমায় বলে গেলাম।’ এই ছিল অভীক রায়ের বিশ্ব জয়ের প্রথম ধাপ। তারপরের সময়টা সিগার ও সিগার কেসেই ডুব দিলেন অভীক। একটি ডিজাইনকে কীভাবে আরও আরও নিখুঁত করা যায়, শুরু হল তার সাধনা। সেই সঙ্গে নতুন আঙ্গিক নিয়ে নিরন্তর গবেষণা। বছর তিনেক বাদে ফের যোগাযোগ করলেন ববের সঙ্গে। ভারতীয় তরুণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভোলেননি থম্পসন প্রেসিডেন্ট। কলকাতায় বরাত এল ১ লক্ষ মার্কিন ডলারের। ভারতীয় মুদ্রায় তা কত, সে হিসেবটা পাঠকের উপরই ছাড়লাম। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল অভীকের বাবা-মাকে নিয়ে। ভবানীপুরের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আচমকা এত টাকা ঢুকতে দেখে তো চোখ কপালে অধ্যাপক অমিয়ভূষণ রায়ের! দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম ওড়ার জোগাড়… ছেলে করছেটা কী! অভীক সেদিন বাবা-মাকে বুঝিয়েছিলেন তাঁর স্বপ্ন ছোঁয়ার পথের কথা, মার্কিন মুলুক থেকে পাওয়া বরাতের কথা। জীবনে কোনও কাজেই অভীককে বাধা দেননি বাবা-মা, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শুরুতেও অভীক পাশে পেয়েছিলেন বাবা-মাকে।
ভবানীপুরের রায় দম্পতির পর এবার অবাক হওয়ার পালা সাগর পাড়ে। অভীকের পাঠানো জিনিস দেখে প্রকৃত অর্থেই চোখ কপালে থম্পসন গ্রুপের। অভীক যেটা করেছেন, তা সিগার-দুনিয়ায় অভূতপূর্ব। অনন্য ডিজাইন সেই সঙ্গে প্রচণ্ড মজবুত, সিগার কেস জগতে এমন যুগলবন্দি শুরু হল ভবানীপুরের নাছোড় ছেলেটার হাত ধরেই। স্রেফ চামড়া মোড়ানো সিগার কেস রাতারাতি অচল হয়ে গেল দুনিয়াজুড়ে। শুরু হল আন্দ্রে গার্সিয়ায় দুনিয়া শাসন।
এমনটা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না, যে কলম্বাসের সময় থেকে চলে আসা রীতি, এক ঝটকায় ভেঙে চুরমার করে দিলেন অভীক। সিগার বহন করতে সিগারকেসের ক্ষেত্রে চামড়ার ব্যবহার আগেও ছিল। কিন্তু অভীক আনলেন সেই আগমার্কা মোড়কে স্প্যানিশ সিডার আর কার্বন ফাইবারের ছোঁয়া। কার্বন ফাইবার সিগার কেসকে দেবে কাঠিন্য আবার স্প্যানিশ সিডারে বজায় থাকবে সিগারের অকৃত্রিম স্বাদ, জাদুকরি আমেজ, যা চলবে জীবনভর। সিগারপ্রেমীরা হামলে পড়লেন অভীকের তৈরি সিগার কেস সংগ্রহ করতে। সেই সিগার কেস এতই শক্ত যে মনের ভুলে তার উপর দাঁড়িয়ে পড়লেও আপনার সাধের সিগারের কিচ্ছুটি হবে না। অভীক বুঝেছিলেন, দামের সঙ্গে আপোস না করে মানের উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই হতে পারে এই লাইনে সেরা হয়ে টিকে থাকার একমাত্র ফর্মুলা। তাই পরবর্তীতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গাড়ির বহিরঙ্গে যে মানের চামড়া ব্যবহার করা হয়, অভীক ঝুঁকলেন সেদিকে। রোলস রয়েজ হোক কিংবা পোর্শে, বিলাসবহুল গাড়িতে ঠিক যে চামড়া ব্যবহার করা হয়, অভীক তাঁর সিগার কেস বানাতে শুরু করলেন সেই চামড়া দিয়েই। আন্দ্রে গার্সিয়াকে বলা হতে লাগল সিগার দুনিয়ার রোলস রয়েজ।
কিন্তু কলকাতায় বসে এত সব কী করে সম্ভব? অভীক বলেন, নিজের প্যাশন নিয়ে যদি কেউ সৎ হয় তাহলে যে কোনও স্বপ্ন তাড়া করতে কোনও সমস্যা হয় না। প্রয়োজন শুধু উদ্ভাবনী ক্ষমতার। আন্দ্রে গার্সিয়ার সিগার কেসের কাঠ (স্প্যানিশ সিডার) আসে মূলত ব্রাজিল থেকে। তারপর আমেরিকায় ভিনিয়ারিংয়ের পর সেই পাতলা কাঠের শিট সোজা চলে আসে কলকাতার ওল্ড আলিপুরে, আন্দ্রে গার্সিয়ার রাজবাড়ি ফ্যাক্টরিতে। সেখানে পাতলা কাঠের শিটকে সিগার কেসের আদল দেওয়ার কাজ করেন সুন্দরবনের কাঠ মিস্ত্রী। যাঁর পারদর্শিতার দুনিয়ায় কোনও তুলনা নেই বলে দাবি অভীকের। কিন্তু এখানেই থামলেন না অভীক। অত্যন্ত স্পর্শকাতর সিগারকে ঠিকমতো রাখতে প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল আরও কিছু বিশেষ কারিগরির। আদ্রতা সিগারের সবচেয়ে বড় শত্রু। কেসে রাখা সিগারে একবার আদ্রতার তারতম্য হলেই সব শেষ। সিগার হারাবে তার রাজকীয় মাধুর্য। অভীক ঠিক করলেন, সিগার কেসে এমন কিছু পরিবর্তন আনবেন যাতে সিগারের আদ্রতা যথাযতভাবে রক্ষা করা যায়। এবার এল অভীকের মাস্টারস্ট্রোক। সিগার কেসেই এমন ব্যবস্থা করলেন যে তার একটি চেম্বার হয়ে উঠল হিউমিডার। অর্থাৎ আপনি যেখানেই যান, সিগার থাকবে একদম সুরক্ষিত। আবার নাড়াচাড়া পড়ে গেল সিগার দুনিয়ায়। হিউমিডার যুক্ত সিগার কেসের পেটেন্ট নিলেন অভীক। আন্দ্রে গার্সিয়া হয়ে উঠল বিশ্বের একমাত্র হিউমিডার সহ সিগার কেস।
সিগার দুনিয়ায় সর্বাধিক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন সিগার আফিসিওনাদো। এর মাঝেই আমেরিকায় তার কর্ণধারের সঙ্গে দেখা করলেন অভীক। নিজের ডিজাইন করা সিগার কেস হাতে তুলে দিয়ে বললেন, পরখ করে দেখুন কেন দুনিয়ার সেরা বলছি। জহুরির চোখ, ঠিক জিনিস দেখে চিনতে ভুল করেননি এম শ্যাঙ্কেন কমিউনিকেশনসের ডেভিড শাভোনা। সঙ্গে সঙ্গে নিজের অভিন্ন হৃদয় এক বন্ধুকে ক্যালিফোর্নিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন নমুনা। যা পরখ করে মুগ্ধ বন্ধু বললেন, লা জবাব! এই ক্যালিফোর্নিয়ার বন্ধু আর কেউ নন, তিনি আর্নল্ড সোয়ারজেনেগার। আন্দ্রে গার্সিয়ার মুকুটে যুক্ত হল আরও একটি পালক। ভক্তকূলে যোগ দিলেন আর্নল্ড সোয়ারজেনেগার। ততদিনে বিশ্বের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছে আন্দ্রে গার্সিয়ার খোশবাই। এরকমই একদিন অভীকের কাছে জার্মানি থেকে ফোন এল জনৈক সার্ভিলিনের। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হল, বাবার জন্মদিনে তাঁকে একটি সিগার কেস উপহার দিতে চাই। আপনি কোনটা সাজেস্ট করেন? বাকিটা ইতিহাস। অভীকের পরামর্শ অনুযায়ী সিগার কেস উপহার দেওয়ার পর বাবা এত খুশি যে তিনি নিজে দেখা করতে চাইলেন এর স্রষ্টার সঙ্গে। ফের ফোন করে জানানো হল অভীককে। জার্মানি গেলে দেখা হবে, জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে জার্মানি গিয়ে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন অভীক। তিনি আর কেউ নন, বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা পোর্শের সিএফও উডো সার্ভিলিন। তিনিও আন্দ্রে গার্সিয়ার অন্যতম ক্রেতা। তাঁর সঙ্গেই অভীকের পোর্শের প্ল্যান্টে যাওয়া এবং দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ গাড়ি কারখানায় প্রথম হাতেনাতে প্রত্যক্ষ করা, কীভাবে তৈরি হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ক্লাস পোর্শে কার।
ততদিনে জেনারেল সিগারের কোহিবা থেকে ডাভিডফ কিংবা ওপাসেক্স, আন্দ্রে গার্সিয়ার সঙ্গে জুড়ি বেধে কাজ করে ফেলেছে পৃথিবীর তাবড় সিগার সংস্থা। ব্রিটেনের জেজে ফক্স থেকে শুরু করে আমেরিকার থম্পসন, ঘর আলো করে শোভা পাচ্ছে আন্দ্রে গার্সিয়া। সিগার কেস দুনিয়ায় এক থেকে দশ, কেবলই আন্দ্রে গার্সিয়া, আর কেউ নেই ধারেকাছে।
সিগার দুনিয়ায় বিজয় পতাকা ওড়ানো সম্পূর্ণ। এবার নিজের দেশের দিকে তাকালেন অভীক। ভারতে যুগযুগান্ত ধরে সিগার নিয়ে আকাঙ্খা আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু এদেশের মানুষ, ভালো জাতের সিগার খেতে এখনও তাকিয়ে থাকেন বিলেতের দিকেই। এই ধারণাকে বদলাতে হবে, ঠিক করলেন অভীক রায়।
(আগামী রবিবার শেষ পর্ব)
Comments are closed.