দৃষ্টান্ত: ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে আর জি করে একের পর এক চিকিৎসার সরঞ্জাম দান করছেন বৃদ্ধ শিকদার দম্পতি

নিজের চোখের সামনে এক আত্মীয়কে বিনা ডায়ালিসিসে তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছিলেন বরানগরের মধুসূদন শিকদার। তখনই প্রতিজ্ঞা করেন মধুসূদনবাবু, বিনা ডায়ালিসিসে আর যাতে কাউকে মারা যেতে না হয়, তার জন্য নিজের সাধ্যের মধ্যে যা করতে পারেন, করবেন।
সেই থেকে শুরু। স্ত্রী শিবানীদেবীকে নিয়ে তাঁদের জীবনের সব সঞ্চয় উজাড় করে দিয়েছেন মানবতার সেবায়। একের পর এক অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দান করে চলেছেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। ছাত্রজীবনে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজেই ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন মধুসূদনবাবু। কিন্তু অর্থের অভাবে মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। সেই থেকেই ডাক্তারি ও আর জি কর হাসপাতালের প্রতি থেকে গিয়েছিল এক নিবিড় টান। তিনি ৮৮ বছরের বৃদ্ধ মধুসূদন শিকদার। তিনি এবং স্ত্রী শিবানীদেবী টাকা জমিয়ে হাসপাতালে দান করে চলেছেন একের পর এক চিকিৎসার সরঞ্জাম।

২০১৭ সালে প্রথমবার একটি ডায়ালিসিস মেশিন হাসপাতালকে দান করেন শিকদার দম্পতি। তার মূল্য ছিল ৮ লক্ষ টাকা। তারপর একে একে দিয়েছেন ৪ লক্ষ টাকা দামের স্লিট ল্যাম্প ও ৮০ হাজার টাকার অপথ্যালমোস্কোপ। সর্বশেষ সংযোজন ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের জন্য পোর্টেবেল ডায়ালিসিস মেশিন, যার দাম ১৮ লক্ষ টাকা। সম্প্রতি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছেন বরানগরের বৃদ্ধ দম্পতি মধুসূদন শিকদার ও শিবানী শিকদার। রেমিংটন র‍্যান্ড নামক টাইপরাইটার কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মী মধুসূদনবাবু। পুরোটাই করেছেন নিজেদের ফিক্সড ডিপোজিট, গ্র্যাচুইটি ও কিষাণ বিকাশ পত্রের টাকা ভাঙিয়ে।

ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে যে রোগীরা হাঁটাচলা করতে পারেন না, কিন্তু তাঁদের ডায়ালিসিস প্রয়োজন, তাঁরা খুবই উপকৃত হবেন এই নতুন পোর্টেবেল ডায়ালিসিস মেশিনটির মাধ্যমে। হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার ডাঃ মানস কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এই মেশিনটির মাধ্যমে সাস্টেন্ড লো এফিশিয়েন্সি ডায়ালিসিস করা সম্ভব। ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের অধিকাংশ রোগীই হাঁটা-চলা করতে সক্ষম থাকেন না। আগে এই ধরনের রোগীকে আমরা এসএসকেএম-এ রেফার করতাম। কিন্তু এখন তাঁর আর প্রয়োজন পড়বে না। এই মেশিনটির মাধ্যমে সেই রোগীরা খুব সহজেই ডায়ালিসিসের সুবিধে পাবেন।
যন্ত্রটি আনা হয়েছে জার্মানি থেকে। এবং তাঁর জন্য জার্মান চ্যান্সেলরকে চিঠিও লিখেছিলেন মধুসূদনবাবু। মেশিনটি কেনা থেকে শুরু করে ভারতে নিয়ে আসা, সব কিছুরই তদারকি নিজেই করেছেন ৮৮ বছরের এই বৃদ্ধ। উপযুক্ত সঙ্গ দিয়েছেন ৭৭ বছরের স্ত্রী শিবানীদেবী। বয়সের ভার তাঁকে নোয়াতে পারেনি। পায়ের সমস্যার জন্য ওয়াকিং স্টিক ব্যবহার করেন ঠিকই, কিন্তু তাতেও হার মানেননি। বৃহস্পতিবার মেশিনটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার পরদিন শুক্রবার সকালেই হাসপাতালে চলে যান তিনি, তাঁর সাধের ডায়ালিসিস মেশিনটি কেমন আছে তা দেখতে।

শেষ বয়সের জন্য টাকা জমিয়ে রাখতে রাজি নন শিকদার দম্পতি। তা ব্যবহার করতে চান মানবতার সেবায়। ৪৯ বছরের এই দাম্পত্য জীবনে সব সময় একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজেদের এই কাজ নিয়ে বলতে গিয়ে মধুসূদনবাবু জানান, সব সরকারের উপর ছেড়ে দিলে হবে? নিজেদেরকেও তো কিছু করতে হবে।
ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ-এও দুটি ডায়ালিসিস ইউনিট দিতে চান তাঁরা, জানালেন শিকদার দম্পতি। দুই মেয়ের একজন দিল্লি ও অন্যজন চণ্ডীগড়ে থাকেন। শেষ বয়সে চিকিৎসার দরকার পড়লে টাকা কে দেবে? মধুসূদনবাবু ও শিবানীদেবী একযোগে উত্তর দেন, উপায় একটা কিছু ঠিক হবেই।

 

Comments are closed.