দৈনিক বেতন মাত্র ২৩৫ টাকা! লাভজনক বেঙ্গল কেমিক্যালসের বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্তে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে কর্মীরা

উনিশ শতকের শেষে আপার সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে গোড়াপত্তন হয় বেঙ্গল কেমিক্যালসের। মূলধন ছিল মাত্র ৭০০ টাকা। ১৮৮৩ সালে ইন্ডিয়ান মেডিকেল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়, সেই অনুষ্ঠানে বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় উৎপাদিত দ্রব্যের প্রদর্শনী করেন। পরবর্তীকালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র মহাশয় নিজের বেতন থেকে দু’লক্ষ টাকা মূলধন যোগ করেন এবং ১৯০১ সালে পথ চলা শুরু করে বেঙ্গল কেমিক্যালস।
আজ সেই বেঙ্গল কেমিক্যালস এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। গত জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেঙ্গল কেমিক্যালসের বিলগ্নীকরণ করা হবে। অথচ, গত ৬০ বছর ধরে ক্ষতির পর লাভের মুখ দেখেছে এই সংস্থা, ২০১৮-২০১৯ অর্থনৈতিক বছরে ২৫ কোটি টাকার উপর লাভ করেছে বেঙ্গল কেমিক্যালস।
সারা ভারতে এই সংস্থার বেশ কিছু ইউনিটের মধ্যে কলকাতার কাঁকুড়গাছি অঞ্চলের ইউনিটিই সব থেকে প্রাচীন। মূলত ইঞ্জেকশন, তেল, ক্যাপসুল ইত্যাদি উৎপাদিত হয় এই ইউনিটে। এই ইউনিটের কর্মী সংখ্যা প্রায় ২৫০ জন। কর্মীদের গড় বয়স ৪৫। স্থায়ী কর্মী রাজু বণিক বললেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাঙালি তথা ভারতবাসীকে স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এই কোম্পানি তৈরি করেন। আজ কেন্দ্র সরকার সেই ইতিহাসকে নস্যাৎ করে বেঙ্গল কেমিক্যালসকে বিক্রি করতে চাইছে’। সবার মত উনিও জানেন না কী ভবিষ্যৎ তাঁদের।

এছাড়াও বেঙ্গল কেমিক্যালসের কাঁকুড়্গাছি ইউনিটে কাজ করেন ৪০ জন ঠিকা কর্মী। বর্তমানে ২৩৫ টাকা দৈনিক মাইনে এবং খাবারের জন্য ৪০ টাকা ভাতা নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন গত ২০ বছর। কোম্পানির দুঃসময়ে স্থায়ী কর্মীদের সাথে রাত-দিন কাজ করে কোম্পানিকে লাভের মুখ দেখছেন যাঁরা, তাঁরা আজ ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে। ঠিকা কর্মী প্রশান্ত ঘোষ জানালেন’ ‘দু’বছর আগে ৬০ জনের মত ঠিকা কর্মী কাজ করতেন এখানে। এখন সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৪০ জনে। মাসখানেক আগে তাঁদের কাজ থেকে ছাঁটাই করা হয় কোনও কারণ ছাড়াই। এমনকী তাঁদের প্রাপ্য বকেয়া টাকাও ফেরত দেয়নি কর্তৃপক্ষ’। ওনার দুই ছেলে-মেয়ে। মেয়ে সামনের বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে এবং ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। উনি জানেন না কীভাবে ছেলে-মেয়েদের উচ্চশিক্ষা চালাবেন। বছর ৫২ র সোমনাথ পালের বাড়িতে ৫ জন সদস্য। দুই মেয়ে। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এ বছর, বাজারে ২ লক্ষ টাকার উপর ধার। শারীরিক প্রতিবন্ধী সোমনাথবাবু জানেন না বিলগ্নীকরণ হওয়ার পর তাঁর চাকরি থাকবে কিনা! সারা পরিবার তাঁর মতই আতঙ্কিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। একই অবস্থা রাজু হালদার, দীনেশ প্রসাদ, শিবনারায়ণ সাউদের। এই মধ্য-বয়সে এসে তাঁরা জানেন না কীভাবে আবার নতুন কাজ করবেন!
বিলগ্নীকরণের বিরুদ্ধে এবং ঠিকা শ্রমিকদের দাবি নিয়ে গড়ে উঠেছে বেঙ্গল কেমিক্যালস শ্রমিক ঐক্য। স্থায়ী কর্মীরা পাশে দাঁড়িয়েছেন ঠিকা কর্মীদের। সমস্ত রাজনৈতিক শ্রমিক ইউনিয়ন এক সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছেন নিজেদের দাবিতে। শিবনারায়ণ সাউ বললেন, ‘আমাদের আর হারানোর মতো কিছু নেই, তাই লড়াই চলবেই নিজেদের দাবিতে।’

Comments are closed.