জানেন, বাংলার প্রথম বারোয়ারি পুজোর ইতিহাস, হুগলির বলাগড়ে কেন তা শুরু হয়েছিল? সেই পুজোর রীতিই বা কী?

বহুদিন আগে থেকেই বারোয়ারি পুজোর জাঁকজমক, সাজসজ্জা, আড়ম্বর, সব কিছুর কাছেই হার মেনেছে বনেদি বাড়ির একচালা দুর্গা পুজো। কিন্তু এই বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই উচ্চবিত্ত-ধনী-জমিদার পরিবারগুলিতে প্রচলিত ছিল দুর্গা পুজো। দুর্গা পুজোর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১১০০ শতকের আগে থেকেই দুর্গা পুজোর প্রচলন ছিল। কলকাতায় আনুমানিক ১৬১০ সালে প্রথম দুর্গা পুজোর আয়োজন করা হয় বলে জানা যায়। এগুলির সবকটিই উচ্চবিত্ত রাজপরিবার, ধনী জমিদার পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাহলে ঠিক কবে থেকে এই উচ্চবিত্ত বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে মায়ের আগমন ঘটে? ঠিক কী প্রয়োজনেই বা বারোয়ারি পুজোর প্রচলন ঘটাতে হল?

 

সর্বপ্রথম বারোয়ারি পুজোর ইতিহাস 

বেঙ্গল গেজেটের তথ্য অনুযায়ী, হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের অন্তর্গত গুপ্তিপাড়া নামক স্থানে আনুমানিক ১১৬৬ সালে সর্বপ্রথম বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হয়। পুজো সমিতির নাম দেওয়া হয় ‘গুপ্তিপাড়া শ্রী শ্রী বিন্ধ্যবাসিনী পূজা সমিতি’। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এই স্থানই বারোয়ারি দুর্গা পুজোর সৃষ্টিস্থান।

 

‘বারোয়ারি’ শব্দের অর্থ কী? 

‘বারো’ ও ‘ইয়ারি’ এই দুই শব্দ মিলে ‘বারোয়ারি’ শব্দের গঠন। হিন্দি ‘ইয়ারি’ শব্দের অর্থ হল বন্ধুত্ব। ধরা হয়, ১২ টি গ্রামের ১২ জন সদস্য মিলে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এই পুজোর প্রচলন করেন বলে এর নাম হয় ‘বারোয়ারি’।

 

বারোয়ারি পুজোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন? 

বারোয়ারি পুজোর প্রচলন সম্পর্কে জানতে গেলে সেকালের সেন বংশের সাথে পরিচিত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলার পাল বংশের রাজা দ্বিতীয় মহিপালের রাজত্বকালে বারেন্দ্র ‘সামন্ত চক্র’র বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে বিজয় সেন বাংলার বিভিন্ন স্থানে তাঁর আধিপত্য স্থাপন করেন। তাঁরা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। এই সময় বাংলায় হিন্দু ধর্ম রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে ও সমাজে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বর্তমান ‘বিন্ধ্যবাসিনী’ পূজা সমিতির সদস্য নিরঞ্জন ভট্টাচার্য মহাশয় জানান, তথাকথিত সময়ে সেন বংশের ও তাঁদের পরিবারের দুর্গা পুজোর রমরমা বহুল প্রচলিত ছিল। আনুমানিক ১১৬৬ সালে সেন বাড়িতে বেশ জাঁকজমকের সাথে দুর্গা পুজোর আয়োজন করা হয়। সেখানকার প্রতিবেশীরা দুপুরবেলা সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে নিয়ে সেনবাড়ির সদর দরজায় উপস্থিত হন প্রতিমা দর্শনের জন্য। কিন্তু দ্বাররক্ষীরা তাঁদের প্রবেশে নিষেধ করেন। বহু কাকুতি-মিনতির পরও তাঁদের প্রতিমা দর্শনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়নি। অপমানিত বোধ করে তাঁরা বাড়ি ফিরে আসেন এবং সকলকে একথা জানান। এক রকমের বিবাদের জেরেই ১২টি গ্রাম মিলে এই পুজো আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দুর্গা পুজোর দিন শেষ হয়ে গেলে তাঁরা দুর্গা মায়ের আরেক রূপ জগদ্ধাত্রী মায়ের পূজার আয়োজনে তৎপর হন। পরবর্তী কালে ১৩৪৬ সালে ঐ স্থানে শ্রী সতীশ চন্দ্র সেন মহাশয় একটি কোঠা মণ্ডপ নির্মাণ করেন। এই থেকেই বারোয়ারি পূজার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলার বিভিন্ন স্থানে উন্মুক্ত বারোয়ারি পুজোর প্রচলন ঘটে।

বাংলার এই প্রথম বারোয়ারি পুজোতে প্রতি বছর দর্শনার্থীদের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। এখানকার বিশেষত্ব হল, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমীর পুজো এক দিনে হয়। ভোগ বিতরণ, বাজি পোড়ানো ইত্যাদির আয়োজন করা হয় সেই দিন। পরের দিন প্রতিমা বিসর্জন হয় বেয়ারার কাঁধে চড়ে। কিন্তু এবছর করোনা পরিস্থিতিতে বাজি পোড়ানো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভোগ বিতরণ হবে খুবই সাবধানতার সাথে। করোনা প্রকোপ থেকে বাঁচতে যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করবেন বলে জানিয়েছেন নিরঞ্জন ভট্টাচার্য।

Comments are closed.