জানেন, হুগলির শ্রীপুর ও সুখড়িয়ার মিত্র-মুস্তাফি বাড়ির পুজোর ইতিহাস? কেন তাঁরা পেয়েছিলেন মুস্তাফি উপাধি?

কলকাতার দুর্গা পুজো মানেই শহরজোড়া নামী-দামি থিম, আলো, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং আর প্রতিযোগিতা। এসব থেকে বেশ দূরে শান্ত পরিবেশের সাবেকি বাড়ির প্রাচীন দুর্গা পুজোর কথা বললেই হুগলি জেলার বেশ কিছু জায়গার নাম মনে করতে হয়। তার মধ্যেই একটি হল মিত্র-মুস্তাফি বাড়ির পুজো। এই বাড়ির দুর্গা পূজা ও ইতিহাস বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজ্ঞাত। কী এই বাড়ির ইতিহাস ও কেমন দুর্গা পুজো হয় এখানে?

 

মুস্তাফি বাড়ির ইতিহাস

 

মুস্তাফি বাড়ির ইতিহাস জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সপ্তদশ শতকে। ১৬৫৭ সালে শান্তিপুরের প্রখ্যাত উপাধ্যায় মোহন মিত্র নদিয়ার টেকা গ্রাম থেকে হুগলি নদীর পূর্ব তীরে রানাঘাটের কাছে উলা নামক গ্রামে (বর্তমানে বীরনগর) এসে বসবাস শুরু করেন। মোহন মিত্রের পুত্রের নাম ছিল রামেশ্বর মিত্র। তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং সুবা বাংলার কোষাধক্ষ্য ও হিসাব রক্ষক। দিল্লির সিংহাসনে তখন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং বাংলার সুবেদার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তাঁর মামা শায়েস্তা খান। আনুমানিক ১৭০৪ সালে কাজের সুবাদে দিল্লিতে গেলে সম্রাট তাঁকে মুস্তাফি উপাধিতে ভূষিত করেন। দক্ষতা ও পারদর্শিতার জন্য তাঁর এই উপাধি। সাথে স্মারকচিহ্ন ও পুরস্কার হিসাবে সম্রাটের ডান হাতের তালুর ছাপ দেওয়া একটি সোনার পাঞ্জা দান করেন। যা পরবর্তীকালে মিত্র-মুস্তাফি বংশের অহংকার ও প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়। তৎকালীন নদিয়ার রাজার থেকে জমি কেনেন রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফি। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি জমিদারি পরিচালনা করতেন। ভোগবিলাসী তিনি ছিলেন না। কিন্তু হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে শুরু করলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষবাসে মন্দা দেখা দেয়। ফলে সেখান থেকে তাঁরা দূরে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়।

রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফির জ্যেষ্ঠ পুত্র রঘুনন্দন মিত্র মুস্তাফি ১৭০৮ সালে চলে যান শ্রীপুর নামক একটি গ্রামে। তিনিই গ্রামের নামকরণ করেছিলেন শ্রীপুর। বর্তমানে বলাগড়-শ্রীপুর নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন সাধক। বিলাসবহুল জীবনযাপনে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই একটি ছোট বাড়ি বানিয়ে সেখানে শ্রী গোবিন্দের প্রতিষ্ঠা করেন। কাঠের ভাস্কর্যে সমৃদ্ধ চণ্ডি মণ্ডপটি এখনও অক্ষত অবস্থায় আছে। একটি রাসমঞ্চও বর্তমান।

রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফির চতুর্থ পুত্র অনন্তরাম মিত্র মুস্তাফি চলে যান সুখড়িয়া নামক গ্রামে। যা হুগলি নদীর পশ্চিম দিকে সোমড়া বাজার ও বলাগড়ের মাঝে অবস্থিত। সেখানে তিনি ও তাঁর বংশধর মিলে ‘রাধাকুঞ্জ’ নামে একটি আবাসিক তৈরি করেন, যা এখন বিশ্বাস বাড়ি নামে পরিচিত। বাড়িটি বর্তমানে প্রায় ধ্বংসের মুখে। গ্রামটিতে আরও বেশ কয়েকটি মন্দির আছে এই মুস্তাফিদের তৈরি।

 

শ্রীপুর মুস্তাফি বাড়ির দুর্গা পুজো

বাড়িতে শ্রী গোবিন্দের প্রতিষ্ঠা থাকলে সাধারণত সেখানে বৈষ্ণব মতে পুজো সম্পাদিত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কিছু নিয়ম দেখা যায় না। এখানে দেবী দশভূজার পুজো হয় শাক্ত মতে।

সুখড়িয়া বিশ্বাস বাড়ির দুর্গা পূজা

বেশ কিছু বছর আগে থেকে বাড়ির কোন পুত্র বংশধর না থাকায় মেয়েরা ও জামাইরা এসে পুজো সামলাতেন। তাই তা বিশ্বাস বাড়ির পুজো নামে খ্যাত হয়। পূর্বে পুজো মণ্ডপের সামনে পশুবলি রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন ছাঁচি কুমড়ো ইত্যাদিতে সম্পন্ন হয়। বাড়ির দুর্গা দেবী দশভূজা, তবে ঘোড়ার মুখবিশিষ্ট সিংহ হল মায়ের বাহন।

বিশ্বাস বাড়ির পুত্র বধূ বনানী বিশ্বাস জানান, এ বছর করোনাকালীন পরিস্থিতিতে তাঁদের এই বনেদি বাড়ির পুজোর রীতিনীতি বা আয়োজনে কোনও পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আপাতত হয়নি।

 

Comments are closed.