জগদ্ধাত্রীপুজোর জন্য সেজে উঠছে চন্দননগর, জায়গা করে নিয়েছে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কিন্তু দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো থেকে দীপাবলির আলোর রোশনাই, ভাইফোঁটার পর যখন ছুটির আমেজ ছেড়ে বাঙালি ফের কর্মমুখী হয়, টানা ছুটি কাটিয়ে স্কুল-পড়ুয়ারা ফের ইস্কুলমুখী হয়, তখনই আসে জগদ্ধাত্রীপুজো। রাজ্যের সব জায়গায় একই সমারোহে এই পুজো পালিত না হলেও, হুগলির চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর আড়ম্বর ও সমারোহ দুর্গাপুজোকেও ছাপিয়ে যায়। পরিষ্কারভাবে বললে, দুর্গাপুজোর চেয়েও জগদ্ধাত্রীপুজোকেই প্রধান উৎসব হিসাবে গণ্য করে চন্দননগরবাসী।
আগামী ৩ রা নভেম্বর শুরু হচ্ছে জগদ্ধাত্রীপুজো। ৫ এবং ৬ নভেম্বর দু’দিনই এবার নবমী পড়েছে। এবারেও চন্দননগরের সুবিখ্যাত মণ্ডপের প্রতিমা দর্শন এবং আলোর রোশনাই দেখতে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের প্রচুর মানুষ ভিড় জমাবেন সেখানে। ইতিমধ্যেই জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষ্যে প্রস্তুত চন্দননগরও। এলাকার বিভিন্ন বারোয়ারি পুজো কমিটি প্রভাত ফেরির মাধ্যমে জগদ্ধাত্রী পুজোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। তৈরি হচ্ছে পুলিশ প্রশাসনও। জগদ্ধাত্রীপুজো ঘিরে চন্দননগরের মেতে ওঠা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু কীভাবে বৃদ্ধি পেল চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর সমারোহ? কীভাবে এই উন্মাদনা? অনেকের মতে, জগদ্ধাত্রী পুজোর ব্যাপক প্রচলন করেছিলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। কাহিনি বলে, বাংলায় তখন নবাব আলিবর্দি খাঁর রাজত্ব। তাঁর রাজত্বকালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করা হয়। কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তা দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। ছাড়া পেয়ে যখন কৃষ্ণচন্দ্র নদীপথে ফিরছেন, তাঁর কানে আসে বিসর্জনের বাজনা। সে বছর দুর্গাপুজো করতে না পারার আক্ষেপেই নাকি জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন করেন তিনি। জনশ্রুতি, ১৭৬৬ সাল থেকে এইভাবে কৃষ্ণনগরে দুর্গাপুজোর বিকল্প হিসেবে প্রচলিত হয় জগদ্ধাত্রী পুজো।
কৃষ্ণচন্দ্রের পুজোয় অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জের চাউলপট্টিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন করেন। যা পরে এক উৎসবের আকার নেয়। যদিও এই নিয়ে মতভেদ আছে। বিকল্প মত, লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়েপট্টির জগদ্ধাত্রী পুজো হল চন্দননগরে প্রাচীনতম পুজো। ১৭৬৮ সালে চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতভেদের পর কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (অনেকের মতে শশধর) চাঁদা তুলে এই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন করেন। তাই পরে সারা চন্দননগরে উৎসবের রূপ নেয়।
তারপর থেকে আজ পর্যন্ত চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি, কাপড়পট্টি, চৌমাথা, মানকুণ্ডু সর্বজনীন, সার্কাস মাঠ, পাদ্রিপাড়া ইত্যদি বহু জগদ্ধাত্রী মণ্ডপের চোখধাঁধানো আলোকসজ্জ্বা আর ঠাকুর দর্শনের জন্য ভিড় উপচে পড়ে। হালকা শীতের আমেজ মেখে জগদ্ধাত্রী পুজোর আলোর রোশনাইয়ে ভেসে যায় চন্দননগরবাসী।
গত কয়েক বছর ধরে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রীপুজো আকারে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করছেন চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীপুজোর। চন্দননগরের বিধায়ক এবং রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন বাড়তি উদ্যোগ নিয়েছেন এখানকার জগদ্ধাত্রীপুজোকে আরও জনপ্রিয় করার। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পর্যটন দফতরও। জগদ্ধাত্রী পুজোকে কেন্দ্র করে চন্দননগর এখন জায়গা করে নিয়েছে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে।

 

Comments are closed.