১০ জুলাই কে সি নাগের জন্মদিন, জানেন এই অঙ্কের জাদুকর বই লেখার কথা ভেবেছিলেন সাহিত্যিকদের সঙ্গে মেসের আড্ডায় বসে

কে সি নাগ। বাঙালির কাছে ‘কঠিন’ অঙ্কের সমার্থক এক নাম। কে সি নাগের বই থেকে অঙ্ক কষেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া শক্ত। তেল মাখা বাঁশে বাঁদরের ওঠানামা থেকে চৌবাচ্চার ফুটো জল মাপতে গিয়ে পেটব্যথার অজুহাতে স্কুল বন্ধ হওয়া, আবার গড়গড় করে কে সি নাগের অঙ্ক কষতে পারা পড়ুয়ার ভাবখানাই ছিল আলাদা। শিক্ষকের কাছে সেই পড়ুয়া অচিরে অতিপ্রিয় হয়ে উঠত আর সহপাঠীদের কাছে এক জলজ্যান্ত বিস্ময়! রবিবারের দুপুরে বাবার কাছে বসে ত্রৈরাশিক, ভগ্নাংশের অঙ্ক কষতে গিয়ে কত ছাত্র-ছাত্রীর কত বিকেল যে সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছে, সেও এক কঠিন হিসেব।
এভাবেই মেধাবীর আইকন আর ঢেকেঠুকে পাশ পড়ুয়ার কাছে এক সাক্ষাৎ ‘গব্বর সিং’ হয়ে স্মৃতিতে তাজা হয়ে আছেন কে সি নাগ। পুরো নাম কেশব চন্দ্র নাগ। ১৮৯৩ সালে এই ১০ জুলাই হুগলি জেলার গুড়াপে জন্মেছিলেন তিনি। ১২৭ বছরেও যাঁর স্মৃতি অম্লান বাঙালির কাছে।

 

জন্ম, স্কুল ও কর্মজীবন  

১৮৯৩ সালে ১০ জুলাই, দিনটা ছিল রথযাত্রার। হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশবচন্দ্র নাগ। বাবার নাম রঘুনাথ নাগ ও মা ক্ষীরোদাসুন্দরী। ছোট বয়সেই বাবাকে হারান কেশব। মায়ের কাছেই মানুষ। বাংলা মাধ্যম স্কুল শুনলে যাঁরা নাক সিঁটকোন, বলে রাখা ভালো অঙ্কের দুনিয়ায় প্রবাদপ্রতিম কেশবচন্দ্রের পড়াশোনার শুরু গ্রামের এক অনামী বাংলা মাধ্যম স্কুলে। গুড়াপে তখন ওই একটি মাত্র স্কুল ছিল। তারপর ক্লাস সেভেনে স্কুল পরিবর্তন করে বাড়ি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরের ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন কেশব। মাইলের পর মাইল রাস্তা পার হয়ে স্কুলে যাওয়া, ক্লাস শেষে আবার হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরা, সকাল থেকে সন্ধে গড়াত শুধু স্কুল যাতায়াত আর পড়াশোনায়। সেই সময়ও কি অঙ্ক কিলবিল করত বালক কেশবের মাথায়?
ক্লাস নাইনে আবার স্কুল পরিবর্তন। এবার তিনি ভর্তি হলেন কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে। ১৯১২ সালে ওই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করে রিপন কলেজে (এখন যার নাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে ভর্তি হন কেশব নাগ। শুরু হয় কলকাতার জীবন। সেই সঙ্গে শুরু তীব্র আর্থিক সমস্যারও। কলেজে পড়ার পাশাপাশি প্রাইভেট টিউটর হলেন কেশবচন্দ্র। এভাবেই ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করেন। আরও পড়ার ইচ্ছে থাকলেও পারিবারিক আর্থিক অনটনের মুখে তখন আবশ্যিক কর্তব্য ছিল কিছু রোজগার করা। যে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে একদিন ছাত্র ছিলেন, সেখানেই পেলেন শিক্ষকতার চাকরি। থার্ড মাস্টারের পদ। সংসার নির্ভর করে তাঁর উপার্জনের উপর। কিন্তু অঙ্ক যার মজ্জায় মজ্জায়, নতুন কিছু শেখা ও জানায় যাঁর অসীম আগ্রহ তাঁর কি আর পেটের দায়ে গড়পড়তা চাকরি করে কোনওরকম জীবন চালিয়ে দেওয়া মানায়? ফের পড়াশোনা শুরুর জন্য কিছুদিনের মধ্যে চাকরি ছাড়েন কেশবচন্দ্র নাগ। কিন্তু একটার পর একটা অঙ্ক বই লিখে যিনি আজ বরেণ্য সারা বাঙালি জাতির কাছে, উচ্চশিক্ষায় তিনি বিজ্ঞান নয়, চেষ্টা করেছিলেন যদি কলা বিভাগেও স্নাতক হওয়া যায়! অবশেষে ১৯১৭ সালে অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে জোড়া বিএ পাশ করেন কেশবচন্দ্র। আবার ডাক এল ছেলেবার আর এক স্কুল থেকে। অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে। কিছুদিন শিক্ষকতা করলেন ওই স্কুলে তারপর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল।

 

কর্মজীবনে মোড় 

পড়াশোনা, শিক্ষকতা আর সামান্য রুজিরোজগার নিয়ে সহজ মধ্যবিত্ত জীবন কাটছিল হুগলির যুবকের। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদূর। এর মধ্যে আবার কিছুদিন শিক্ষকতা করলেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে। তাঁর সুখ্যাতি গিয়ে পৌঁছল আর এক ব্যক্তিত্ব স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে। তাঁর ডাকে মিত্র ইনস্টিটিউশন ভবানীপুরে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কেশবচন্দ্র নাগ। শুরু হয় কলকাতার মেস-জীবন। রসা রোডের মেসবাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। ততদিনে জীবনে আধ্যাত্মিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। ১৯১৯ সালে মা সারদা দেবীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন কেশব নাগ। জীবনের কেন্দ্রে কেবল গণিত। এই সময়ে কেশব নাগের গুণগ্রাহী ছিলেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। তাঁর বিশাল লাইব্রেরি কেশব নাগের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। কার্যত সেখানেই গণিতের আসল ধ্যানজ্ঞান ও সাধনা শুরু করেন কেশব নাগ। একদিকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস আর অন্যদিকে গণিতের ইতিহাস, আপাতভাবে দুই বিপরীত বিষয়ে অপার জ্ঞান সঞ্চয় করেন কেশব। ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিয়েছিলেন অঙ্ক ও ইতিহাস!

 

স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও কেশবচন্দ্র নাগ 

১৯০৫ সালে মিত্র ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষকতা করার জন্য এক একটা মণিমুক্তা বাছাই করে আনতেন স্যার আশুতোষ। সেভাবেই কেশবচন্দ্র নাগের মিত্র ইনস্টিটিউশনে আসা। কেশব যেমন ছিলেন আশুতোষের অনুরাগী, আশুতোষও সম্মান করতেন তাঁকে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আবার হয়ে উঠিছিলেন কেশব নাগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কেশব নাগকে রাজনীতির গণ্ডিতে আনতে চেয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, কিন্তু অঙ্কে বুঁদ মধ্যবিত্ত শিক্ষক তা আন্তরিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।
এই মিত্র ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নেন কেশবচন্দ্র।
শিক্ষক জীবনে তেমন কিছু আয়-উপায় করতে পারেননি কেশব নাগ। লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তীর মতো কেশব নাগের জীবনের সিংহভাগ কেটেছে মেসবাড়িতে। কর্মজীবনের একদম শেষে এসে রসা রোডের মেসবাড়ি থেকে উঠে ১৯৬৪ সালে গোবিন্দ ঘোষাল লেনে বাড়ি তৈরি করে থাকতে শুরু করেন। যে বাড়িতে আজও কেশবচন্দ্র নাগ লেখা নেমপ্লেটটি জ্বলজ্বল করে। পাকাপাকিভাবে কলকাতার বাসিন্দা হলেও মনেপ্রাণে ছিলেন মফস্বলের ছেলে। মাটির টানে বারবার ফিরে গিয়েছেন হুগলির গুড়াপে, তাঁর আদি বাড়িতে।

 

লেখক কেশবচন্দ্র নাগ 

বই লেখার কথা সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু এখানেও জড়িয়ে সেই মিত্র ইনস্টিটিউশন। সেখানে কেশবের সহকর্মী ছিলেন কবিশেখর কালিদাস রায়। তাঁর বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা রসচক্র সাহিত্য সংসদ। কে না যেতেন সেখানে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো সাহিত্যিকের নিত্য যাতায়াত সেখানে। কেশবচন্দ্র ছিলেন আড্ডার অন্যতম মুখ। সেই লেখকসঙ্গ বই লেখার ভাবনা মাথায় জেঁকে বসতে সাহায্য করে। তিনের দশকের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয় নব পাটীগণিত। প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স। শিক্ষক কেশবচন্দ্র নাগের সেই কে সি নাগ হয়ে ওঠার শুরু। বছর কয়েকের মধ্যেই বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও অনুমোদিত হয়। কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের রচয়িতাকে লেখক বলে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের অভ্যাসে নেই যে! কে সি নাগকে তাই আমরা লেখক বলিনি। যদিও কে সি নাগের সব অঙ্ক বই মৌলিক ছিল বলেই তা আজও অম্লান।
শোনা যায় কেশবচন্দ্রের মেসে একদিন এসে পড়েছিলেন ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল। টেবিলের উপরে রাখা ছিল কেশবচন্দ্রের বাঁধানো অঙ্কের খাতা। তা উল্টেপাল্টে দেখে উঠে ছিলেন পরেশবাবু। কোন জটিল অঙ্ক কোন উপায়ে করলে সহজেই তা বোধগম্য হবে, তার সব টেকনিক লিখে রাখা আছে পাতার পর পাতায়। কেশব নাগকে সেই খাতা বইয়ের আকারে ছাপার প্রস্তাব দেন তিনি। প্রথমে রাজি হননি কেশবচন্দ্র। প্রশ্ন জেগেছিল, অঙ্কের কি হেল্প-বুক হয়? শেষমেশ কেশবচন্দ্রকে রাজি করাতে সফল হন ওই প্রকাশক। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হল অঙ্কের সহায়িকা ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স। বেরনো মাত্রই বইটির চাহিদা হয়েছিল আকাশছোঁয়া। এরপর একে একে তাঁর আরও বই প্রকাশিত হতে থাকে। ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়। পাকিস্তান বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী লিখেছিলেন পাক ম্যাথমেটিক্স। দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে ব্রেল সংস্করণও। ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির স্নাতক মার্টিন বার্ড স্নাইডার কে সি নাগের বইগুলির বিষয়ে বলেছিলেন, ‘দ্য থিয়োরিটিকাল ট্রিটমেন্ট অব দ্য সাবজেক্ট ইন দিজ বুকস ওয়্যার সুপিরিয়র টু দ্যাট ফাউন্ড ইন সিমিলার বুকস ইন দ্য ইউএসএ’।
এমন এক উজ্জ্বল বাঙালি ব্যক্তিত্বের ১২৭ তম জন্মদিন আজ।

Comments are closed.