আমার তুরস্কের স্মৃতিঃ ওখানে বাজারে অলিভ পাওয়া যায় আমাদের আলু, পটলের মতো।

আমার স্বামীর কর্মসূত্রে একবার তুরস্ক দেশে কিছু দিন ছিলাম। তাও এখন থেকে ২০ বছর আগে। ওখানে একটা নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছিল। সেই কাজেই ওনার ওখানে যাওয়া।
এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি তৈরি হচ্ছিল মার্মারা উপসাগরের ধারে। আমারও যাওয়ার অনুমতি থাকায়, দুজনেই রওনা হলাম দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। আমার বিদেশ যাত্রা সেই প্রথম। এমিরেটসের উড়ানে আমরা পৌঁছলাম দুবাইতে। সেখান থেকে এমিরেটসেরই অন্য উড়ানে আমাদের যেতে হবে ইস্তানবুলে।
ইস্তানবুলে নামার আগে বিমান থেকেই দেশটি দেখতে পাচ্ছিলাম। এখানকার ভুপ্রকৃতি কিছুটা অন্যরকম। আমার মনে হয়েছিল, একটু রুক্ষ। বাড়ি-ঘর যা দেখা যাচ্ছিল, সেগুলিও অন্যরকম। ইস্তানবুল বিমানবন্দরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন অত্যন্ত সুশ্রী এক ড্রাইভার।
আমরা থাকব চর্লু বলে একটা শহরে। ইস্তানবুল থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে গাড়ি চলেছে ১৮০ কিলোমিটার গতিতে। পিছনের সিটেও বেল্ট বেঁধে বসেছি। অবশেষে এসে পৌঁছলাম চর্লুতে। জায়গাটি একটি নতুন গড়ে ওঠা শহর। এলাম চর্লুর একটা আবাসনস্থলে। নাম এমলাক কনুট। এখানে বহুতল বিশিষ্ট অনেক বাড়ি রয়েছে। সবই একরকম দেখতে। এইরকম একটি বাড়িতে একটা  ফ্ল্যাট আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আমরা ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখলাম, আসবাব পত্র দিয়ে সুন্দর করে রাখা রয়েছে ফ্ল্যাটটি। দরকারি সব জিনিসই আছে ।
ড্রাইভার ছেলেটি আমাদের পৌঁছে দিয়ে, ফ্ল্যাটের সব কিছু দেখিয়ে চলে গেল। বলল, পরদিন সকাল ৭ টার সময় এসে আমার স্বামীকে ওনার কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যাবে।
এরপর ঠিক করলাম, নিজেরাই বের হয়ে এই নতুন  জায়গাটা দেখে আসি। রাস্তায় বের হতেই সবাই আমাদের দেখছে। বিশেষত শাড়ি পরিহিতা বিদেশিনী সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
তুরস্কের এই ছোট শহরে তুর্কী ছাড়া অন্য ভাষা ওরা ব্যবহার করে না। অতএব বাক্যালাপ কিছুই করা যাচ্ছে না। দেখলাম রাস্তা দিয়ে মিনি বাসের মতন ছোট ছোট বাস চলছে। আমাদের দেখে একটা বাস থামল এবং তুর্কী ভাষায় কিছু জিজ্ঞাসা করল। মনে হল জানতে চায় আমরা যাব কিনা। আমরা তো কিছুই চিনি না, কিন্ত আমরা বাসে উঠে পড়লাম। বলার চেষ্টা করলাম সিটি সেন্টার। বাসের ভাড়া কত কিছুই জানি না। হাতে টার্কিশ লিরা নিয়ে বাস কন্ডাক্টরকে দেখালাম, ও প্রয়োজনীয় ভাড়ার লিরা তুলে নিল।
এবার একটা বাজারের মতন জায়গায় , অনেক দোকান আর মানুষজন দেখে আমরা নেমে পড়লাম। নেমে দোকান-পাট, রাস্তা আর মানুষ দেখছি। এখানে সবাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী মনে হল। বিশেষত মেয়েদের, যদিও বেশির ভাগই ইওরোপীয় পোশাক পরিহিতা। মানুষগুলি সবাই খুব সুন্দর। আমরাও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে ইংরেজিতে আলাপ করলেন। নাম বললেন জাভেদ তুনচের। বললেন, উনি কিছু দিন ইংল্যান্ডে ছিলেন, তাই ইংরেজি ভাষা বলতে পারেন। বললেন, তুরস্কে ইংরেজি বলার চল আছে। যদিও লোকেরা সাধারণত তুর্কী ভাষাতেই কথা বলে। আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ কথাবার্তা হলো আমাদের মধ্যে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম এখানে চা খাওয়া যায় কোথায়? উনিই নিয়ে গেলেন চায়ের দোকানে। অবাক হলাম যে এখানে চা’কে ওরা চায় বলে। খুব সুন্দর চা খাওয়ার কাচের পাত্র, অনেকটা ফুলদানির মতন দেখতে। নানারকম সুগন্ধি চা পাওয়া যায়। লিকার চা। সঙ্গে চিনির কিউব।
এবার আস্তানায় ফিরতে হবে। আমরা বোঝাতে পারছিলাম না আমাদের আবাসনের নাম। তবে জাভেদ বর্ণনা শুনে আন্দাজ করে মিনি বাসের কন্ডাক্টরকে বুঝিয়ে দিলেন। আমরা বাড়ি ফিরলাম।
পরদিন থেকে আমার স্বামীর কর্মক্ষেত্রে যাওয়া শুরু হল। সকাল ৭ টায় গাড়ি এল। আর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ফিরে এলেন। সপ্তাহে একদিন গাড়ি আসত মিগ্রো নামে একটা সুপার বাজারে আমাদের রসদ কিনতে যাওয়ার জন্য। আমাদের আবাসন এমলাক কনুটের আমার স্বামীর অন্য সহকর্মীরাও থাকতেন। ইওরোপের অন্য দেশবাসী। সবাই একসঙ্গে যেতাম। তবে মহিলা আমি একাই।
কয়েকদিন পর থেকে উনি কাজে বের হয়ে গেলে, আমি বাড়ির কাজ শেষ করে বের হতাম, মিনি বাসে করে চলে যেতাম সিটি সেন্টারে। ওখানে খোলা বাজার বসত। আমি ঘুরে ঘুরে দেখতাম। ওখানে অলিভ বিক্রি হয়, আমাদের দেশের আলু-পটলের মতন। পাওয়া যেত রসালো সুস্বাদু আঙুর। সব্জিগুলো একটু অন্যরকম। প্রচুর মাশরুম পাওয়া যেত। মাছের দোকানও ছিল। অচেনা সব মাছ। একরকম মাছ ছিল, অনেকটা তেলাপিয়ার মতন দেখতে, ওরা বলত চুপরা। আমার স্বামীর একজন ইতালিয়ান সহকর্মী চুপরা মাছ গ্রিল করে আমাদের খাইয়েছিলেন।
জাভেদ প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়িতে। অনেক রকমভাবে সাহায্য করতেন। একবার একটা বিরাট ক্যানে করে অলিভ অয়েল এনে হাজির। বলেছিলেন, তিনি যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন, তখন রেস্তোরাঁতে গিয়ে ভারতীয় খাবার খেয়েছেন, ওনার সেই সব খাবার বেশ ভাল লাগত। আমিও নানারকম রান্না করে খাওয়াতাম। একবার জাভেদ ওঁর একজন সাংবাদিক বন্ধুকে নিয়ে এলেন। উনিও ভারতীয় খাবারের খুব প্রশংসা করেছিলেন। বিশেষত বাটার চিকেন খেয়ে। পরের দিন দেখলাম স্থানীয় সংবাদপত্রে আমাদের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রথম পৃষ্ঠায় বের হয়েছে।

জাভেদ একদিন এসে বললেন, একটি টার্কিশ পরিবার ওনার বন্ধু , আমাদের কথা শুনে আমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে চান। জাভেদ কথা দিয়েছে আমাদের নিয়ে যাবে। সেই রকমই ব্যবস্থা হলো, ওঁরা রাত্রিতে খাবার নিমন্ত্রণ করলেন। আমি মাংস খাই না শুনে খুব অবাক, তবুও অনেক কিছু রান্না করেছিলেন। খুব সাজানো গোছানো বাড়ি। খাওয়ার টেবিলে নানারকম খাবারের সঙ্গে পাঁউরুটি কেটে রেখেছে। ওরা ভাতের জায়গায় পাঁউরুটিই খায়। বাড়ির কর্ত্রী খুব আন্তরিক অনেক কথা বলেছিলেন, তুর্কী ভাষায়। আমরা বিশেষ কিছু বুঝছিলাম না। জাভেদ দোভাষীর কাজ করেছিলেন ।
এখানে সবাই আমরা ভারতীয় শুনে ইন্দিরা গান্ধীর নাম করতেন। ওখানে সবাই ইন্দিরা গান্ধীর কথা জানে ।
একদিন ওখানকার একটি স্থানীয় স্কুলের উঁচু ক্লাসের কয়েকজন মেয়ে এল আমার বাড়িতে। বলল, ওরা আমাকে ওদের স্কুলে নিয়ে যেতে চায় । আমি ভারতীয়, তাই ওরা আমার সঙ্গে পরিচিত হতে চায়। আমি গিয়েছিলাম। ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে আমার সঙ্গে অনেক কথা বলল ।
কামাল আতাতুর্ক রিপাবলিক অব টার্কির স্রষ্টা। টার্কির জন্মের সময় বহু বিদেশি অতিথি ওখানে গিয়েছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে গিয়েছিলেন তখনকার উত্তর প্রদেশের বাঙালি মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী সুচেতা কৃপালিনি। ভারতীয় সংসদের দলনেত্রী হয়ে ওখানে গিয়ে ভারত আর টার্কির মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তাই ওনাকে ওই দেশের লোকেরা খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রেখেছে।
কামাল আতাতুর্ক, যাঁর নিজের নাম ছিল কামাল পাশা। এই দেশের খুব সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। উনিই এই দেশের নিরপেক্ষতা এবং উন্নতির জনক। ওনার জন্যই তুরস্ক ইওরোপীয় সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। এখানে আতাতুর্কের ছবি এবং মূর্তি অনেক জায়গায় আছে।
একবার এখানের স্কুলের মেয়েরা আমাকে বলল, ওরা একটা অভিনয় করছে , কামাল আতাতুর্কের ওপরে। সেখানে সুচেতা কৃপালিনি সাজবে একটি মেয়ে। তাই ওরা আমার কাছে শাড়ি চাইতে এসেছে। আমার সঙ্গে তখন একটি মারাঠী মেয়ে বসেছিল। সে বলল, ও মেয়েটিকে শাড়ি পরিয়ে দেবে। আমাকে অভিনয় দেখতে আমন্ত্রণও করেছিল।
আমরা ছুটির দিনে ইস্তানবুল যেতাম। বড় রাস্তায় গিয়ে ইস্তানবুলগামী বাসকে হাত দেখালে থেমে যেত। বাসে উঠে বসলে, কন্ডাক্টর ভেজা তোয়ালে দিত, হাত মুখ মোছার জন্য। জিজ্ঞাসা করত, চা খাব না সরবত। ওরা চা’কে চায় আর সরবত’কে সেরবেত বলত।
এক ঘন্টার মধ্যে ইস্তানবুল পৌঁছে যেতাম। ওখানে মেট্রো রেলে করে যেতাম ইস্তানবুলের দর্শনীয় স্থানগুলিতে। ইস্তাম্বুল ছিল রোমান সভ্যতার কনস্ট্যান্টিনোপল। এখানে দেখার অনেক কিছু আছে। হাগিয়া সোফিয়া গির্জা, ব্লু মস্ক, টোপকাপি রাজপ্রাসাদ। টোপকাপি এখন সংগ্রহশালা। এখানে অটোমান এবং বাইজেন্টাইন সভ্যতার অনেক কিছু সযত্নে রক্ষিত। দামি পাথর বসানো গহনা এবং অস্ত্র-শস্ত্র রাখা আছে। ব্লু মস্কে সব লোক ভিতরে গিয়ে ধ্যান করে। আমিও আমার বিশ্বাস অনুযায়ী করেছিলাম।
ইস্তানবুলে আছে বসফরাস প্রণালী, যা কৃষ্ণ সাগর আর মার্মারা উপসাগরকে যুক্ত করেছে। বসফরাসের ওপর বড় বড় স্টিমার চলে। স্টিমারগুলি বসফরাসের ধারে নানা অঞ্চলের পাশ দিয়ে যায়। খুব মনোরম অবিস্মরনীয় অভিজ্ঞতা। অনেক ছোট ছোট দ্বীপও আছে। আমরা টিকিট কেটে এই সব স্টিমারে করে যেতাম। যেখানে থামত আমরা নেমে জায়গাটা দেখে আসতাম। দ্বীপগুলিতে খাবার দোকানে টাটকা মাছ ব্যাটার ফ্রাই করে বিক্রি করত, যা ওরা পাঁউরুটি সহযোগে খেত। আমরাও খেতাম। এরা পাঁউরুটিকে বলে একমেক। খুব ভাল স্বাদ।
এখানে খুব সুস্বাদু আইসক্রিমও পাওয়া যায়। আমরা একবার একটা দ্বীপে গিয়েছিলাম, যেখানে মোটর গাড়ি বা যানবাহন চলার অনুমতি নেই। সবাই হেঁটে চলাফেরা করে অথবা ঘোড়ার গাড়ি করে ।
বসফরাসের ধারে ইস্তানবুলে অনেক ভাল ভাল রেস্তোরাঁ আছে। আমরাও যেতাম। হরেক রকমের স্যালাড পাওয়া যেত। আর নিতাম পোলাও, মাশরুম সহযোগে বানানো। পোলাওকে ওরা বলে পিলাভ।
ইস্তানবুলে বসফরাসের ওপরে দুটি সেতু আছে। তুরস্ক দেশ দুটি মহাদেশের মধ্যে আছে। ইস্তানবুল আর অন্য কিছু জায়গা ইওরোপের, আর বসফরাসের পূর্ব দিকের অংশ এশিয়া মহাদেশে। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা এশিয়ার মধ্যে পড়ে। বসফরাসের ওপর সেতু দুটি এই দুই মহাদেশকে সংযুক্ত করেছে ।
হেলেন অফ ট্রয় তুরস্কে। গ্রিসের কাছে এগিয়ান সাগরের প্রায় ধারে। আমারাও গিয়েছিলাম ট্রয়-এ। আমার স্বামীর কোম্পানির গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল। গাড়ি করে এগিয়ান সাগরের কাছে গেলাম। গাড়িটা একটা বড় স্টিমারের ভিতর ঢুকে গেল। আমি হতবাক। গন্তব্যস্থানে গিয়ে গাড়ি বের করে নেওয়া হলো। আবার গাড়িতে করে গেলাম ট্রয়তে। দেখলাম কাঠের সেই বিখ্যাত ঘোড়া, যার মধ্যে সেনারা লুকিয়ে ছিল। সেই ঘোড়া দেখার জন্য বেশ ভিড় ।
ইস্তানবুলে এক সন্ধ্যায় তুরস্কের বিখ্যাত বেলি ডান্স দেখলাম। আমার স্বামীর সহকর্মীরা মিলে দেখবে বলে ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে লক্ষ্য করলাম, কোম্পানির অনেক লোক রয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছেন ইউরোপের বহু দেশের লোক আর আমরা দুজন। ওখানে সবাই সবার সঙ্গে গল্প করছিলেন, কৌতুক, হাসাহাসিও হচ্ছিল। আমার সঙ্গে সবাই খুব সম্ভ্রম সহকারে কথা বলছিলেন। মনে হয় শাড়ির জন্য।
এমনিতে ওখানকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। আর অক্টোবর, নভেম্বর থেকে তাপমাত্রা দ্রুত কমে যায়। সেই সময় বরফ পড়ত। বরফের ঝড়ও হতো। বাড়ির ভেতরে কিছু বোঝা যেত না। বাইরে বের হলে পর্যাপ্ত গরম জামা, টুপি, উলের মোজা আর ভারী জুতো পরে বেরোতে হতো। এই ভাবে দেড় বছর থাকলাম তুরস্কে। মার্মারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হল। আমাদের দেশে ফেরার দিনও এসে গেল ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.