নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২৫: মিঃ শেঠ, হাউ ক্যান ইউ ডিরেক্ট মি? সিপিএম নেতাকে বললেন অলোক রাজ

আগের পর্ব কী ঘটেছিল: ২০০৮ পঞ্চায়েত ভোটের আগের দিন নন্দীগ্রামে পৌঁছলেন সিআরপিএফের ডিআইজি অলোক রাজ। গ্রামবাসীদের আশ্বস্ত করলেন। তাঁর সঙ্গে ভোটের আগের রাতে গেলাম রাজারামচকে সিআরপিএফ ক্যাম্পে……

 

নন্দীগ্রামের রাজারামচকে সিআরপিএফের ক্যাম্পে শুধু মাত্র কয়েকটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। বাকি যেদিকে চোখ যাচ্ছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঝি পোকা ডাকছে অনবরত। অলোক রাজের  কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে, কালকের ভোটের লড়াইটা স্রেফ সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে আটকে নেই। আসল লড়াইটা তো হচ্ছে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে সিআরপিএফের। এখনও সেটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। মন বলছে, কিছু একটা হবে কাল নন্দীগ্রামে। সেটা কী এবং কত বড়ো ব্যাপার হতে পারে তা আঁচও করতে পারিনি তখন। এদিকে রাত বাড়ছে, কাল ভোট। সকাল সকাল উঠতে হবে। রুট মার্চের কথা মনে করিয়ে দিলাম অলোক রাজকে।

‘হ্যাঁ চালিয়ে,’ বলে উঠলেন সিআরপিএফের ডিআইজি। রাজারামচক হাইস্কুল থেকে বেরিয়ে ডিআইজির নেতৃত্বে সিআরপিএফ কনভয়ের সঙ্গে উত্তর দিকে এগোলাম, যে রাস্তা গড়চক্রবেরিয়া, সোনাচূড়া হয়ে সিপিআইএম দুর্গ খেজুরির দিকে যাচ্ছে। কিছুটা এগিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন অলোক রাজ। নামলেন সিআরপিএফ জওয়ানরা। ডিআইজির নির্দেশে ওই ঘন অন্ধকারে ভারী বুটের আওয়াজ তুলে নন্দীগ্রামের রাস্তায় শুরু হল সিআরপিএফের রুট মার্চ। পুরো শুনশান এলাকা। একটা মানুষের চিহ্ন নেই কোথাও। শ্যামল ছবি তুলতে শুরু করেছে। রাস্তার দু’ধারে কিছু কিছু বাড়িতে বাল্ব, হ্যারিকেন জ্বলছে। খুব সন্তর্পণে দু’একজন ভয়ে ভয়ে বাড়ি থেকে উঁকি মেরে দেখছে, কারা এল এত রাতে।

‘হাম সিআরপিএফওয়ালা হ্যায়। ডরনেকা কুছ নেহি।’ বলে উঠলেন জাওয়ানদের নেতৃত্বে থাকা অফিসার। মিনিট কয়েকের মধ্যেই শ্যামলের ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে। অলোক রাজের কাছে ওঁর মোবাইল নম্বরটা চেয়ে বললাম, ‘হাম চলতে হ্যায়। আপ কাহা পার রেহেঙ্গে?’

‘খেজুরিমে। কুছ খবর মিলনেসে মুঝে বাতানা। ফোন চালু হ্যায় মেরা।’ হ্যান্ডশেক করে নিজের গাড়ির দিকে এগোলেন সিআরপিএফের ডিআইজি। যেতে যেতে অফিসারদের নির্দেশ দিয়ে গেলেন, ‘সবহি সেক্টরকো রাতমেহি নিকালনা পেট্রলিংকে লিয়ে।’ তারপর রওনা দিলেন খেজুরিতে পোর্ট ট্রাস্টের গেস্ট হাউসের দিকে। আমিও গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা দিলাম নন্দীগ্রাম থানা হয়ে চন্ডিপুরের দিকে। চন্ডিপুর মোড়ে একটা ছোট্ট হোটেলে আজ রাতের জন্য আমার ঘর বুক করা আছে। গাড়িতে উঠেই ফোন করলাম পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আমার অত্যন্ত পরিচিত এবং বিশ্বস্ত এক পুলিশ অফিসারকে।

‘এতক্ষণ অলোক রাজের সঙ্গে ছিলাম। মুড তো দেখলাম অত্যন্ত কড়া।’

‘ছাড়ো তো, ওরা এখানকার কী জানে, বোঝে। ভোটের ডিউটি পড়েছে, গ্যালারি শো করছে। কাল যা করার আমরাই করব।’

‘ও কিন্তু পুলিশের কাজে একদম খুশি না।’

‘তাতে কী এসে যায়, সিআরপিএফকে তো রাজ্য পুলিশের আন্ডারেই কাজ করতে হবে। এটাই নিয়ম। তাছাড়া ওরা আবার ভোটের ডিউটির কী বোঝো? কোনও দিন ভোট করেছে নাকি? জাওয়ানগুলোর মাথায় কিচ্ছু নেই। আমরা যেখানে পোষ্টিং করব, সেখানেই ডিউটি করবে।’

‘ঠিক আছে কাল কিছু খবর হলে জানিও বলে আর পাঁচটা কথার পর ফোন রাখলাম।

যা বুঝতে পারছি, একদম যুদ্ধং দেহি পরিস্থিতি। অনেকটা গদা যুদ্ধের আগে বাগযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়েছে পুলিশ এবং সিআরপিএফের মধ্যে। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়বে না। দু’জনেই একে অন্যের সমালোচনা করছে। আগের দিনই এই, হাই ভোল্টেজ ভোটের দিন কী হবে? রাত প্রায় দশটা, ফিরলাম চন্ডিপুরের হোটেলে। ফোন করলাম সিপিআইএমের এক জেলা নেতাকে।

‘কী ব্যাপার বলুন তো? সব ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। চিন্তার কিছু নেই। সব সিটে জিতব আমরা।’

‘কিন্তু সিআরপিএফের স্ট্যান্ড তো খুব কড়া। ‘

‘তাতে কী? সিআরপিএফ তো আর ভোট দেবে না। তাছাড়া তৃণমূলের তো এজেন্টই থাকবে না কোনও বুথে।’ প্রবল আত্মবিশ্বাস সিপিআইএমের নেতার  কথায়।

১১ই মে, পঞ্চায়েত ভোট

 

আর পাঁচ-দশটা দিনের মতোই ১১ মে ভোর হল নন্দীগ্রামে। যখন হোটেল থেকে বেরিয়েছি তখন অবশ্য আলো ফোটেনি পুরোপুরি। প্রায় পৌনে পাঁচটায়। সকাল ছ’টায় আমার লাইভ, গড়চক্রবেড়িয়ার কালীচরণপুর  গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার একটি বুথে। ২০০৭ সালের  ৩ জানুয়ারি এই কালীচরণপুর পঞ্চায়েত অফিসেই  মিটিংকে কেন্দ্র করে প্রথম গণ্ডগোলের সূত্রপাত। এখানকার মানুষই প্রথম পঞ্চায়েত অফিসে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, এখানেই পুলিশকে আটকে রাখা হয়েছিল, এখানেই পুলিশ প্রথম গুলি চালিয়েছিল, পুলিশের জিপ পুড়িয়েছিল এখানকার মানুষ। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। আন্দোলন শুরুর যথার্থই আঁতুড়ঘর গড়চক্রবেড়িয়ার এই গ্রামটি। এই কারণেই লাইভের জন্য কালীচরণপুরকে বাছা।

চন্ডিপুর থেকে অন্তত এক ঘন্টার রাস্তা। হুহু করে গাড়ি ছুটছে গড়চক্রবেড়িয়ার দিকে, গাড়িতে বসেই দেখলাম পূর্ব দিকের আকাশ আস্তে আস্তে লাল হচ্ছে। এর মধ্যেই লোকজন বেরতে শুরু করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। সারারাতের বন্দিদশা কাটিয়ে গরু, ছাগল, মুরগি চড়তে বেড়াচ্ছে মাঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল, আগের বছর নভেম্বর মাসের ১১ তারিখ কলকাতায় বসে সিপিআইএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় হয়েছে। মুক্ত হয়েছে নন্দীগ্রাম। অপারেশন সূর্যোদয়।’

গাড়িতে বসে ভাবছিলাম, আজ ১১ মে নন্দীগ্রামের মানুষের ঐতিহাসিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষার রেজাল্টের ওপরে নির্ভর করছে নন্দীগ্রামের ভবিষ্যৎ। নন্দীগ্রামের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন এবং সিপিআইএমের সংগঠনের মধ্যে টানাপোড়েন, লড়াই, হিংসা, হিংস্রতা, খুনোখুনি চলছে প্রায় দেড় বছর ধরে। আজ পরীক্ষা। পরীক্ষা নিচ্ছে গণতন্ত্র। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘মানুষই ইতিহাস রচনা করে।’ ভাগ্য, দুর্ভাগ্য কোনওটাতেই বিশ্বাস নেই তেমন, কিন্তু  নিঃসংশয়ে এ আমার পেশাগত জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের দিন নন্দীগ্রামের ডিউটির অভিজ্ঞতা। কেউ জানে না আজ কোন ইতিহাস লেখা হবে হলদি নদী তীরের দুই ব্লকে, তার সাক্ষী থাকতে পারছি।

পাঁচটা চল্লিশ-পয়তাল্লিশ, গড়চক্রবেড়িয়া মোড়ে পৌঁছলাম। ভোট শুরু হতে সওয়া ঘণ্টারও বেশি বাকি, কিন্তু এরই মধ্যে অনেক মানুষের ভিড় রাস্তায়। দেখে মনে হচ্ছে, ভোটের উত্তেজনায় সারারাত ঘুম হয়নি কারও। গড়চক্রবেড়িয়া মোড় থেকে পশ্চিমদিকে একটু এগোলেই কালীচরণপুর ১০ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস, তার ঠিক পেছনে স্কুল, স্কুলে ভোটের বুথ। স্কুলের সামনে মোটামুটি বড়ো মাঠ। সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের ওভি ভ্যান। আমরাও আগে পৌঁছে গেছে। বুথের সামনে পৌঁছে যা দেখলাম নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এক ঘণ্টারও বেশি বাকি ভোটের, বুথের দরজাও খোলেনি, পুলিশ আসেনি। অথচ হাজির একশোরও বেশি ভোটার! পুরুষ এবং মহিলারা আলাদা আলাদা লাইন করে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। স্কুলের সামনের মাঠে দুটো লাইন এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছেন অন্তত ৫০-৭০ ফুট! মানুষের ভোট দেওয়ার এত আকাঙ্ক্ষা এবং স্পৃহা?

 

মুহূর্তে মনে পড়ে গেল দু’বছরের পুরনো একটা ঘটনা। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম দফার ভোট ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায়। আগের দিন রাতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম ঝাড়গ্রামে। ভোটের দিনে এমনই সক্কাল-সক্কাল পৌঁছেছিলাম বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বেলপাহাড়ি এলাকায় চাকাডোবার কাছাকাছি একটা বুথে। তখনও ভোট শুরু হতে প্রায় এক ঘণ্টা বাকি ছিল। দেখেছিলাম, এক হাতে নিম ডাল, দাঁত মাজার ব্রাশ, অন্য হাতে ভোটার কার্ড নিয়ে ৭০-৮০ জন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছেন কখন বুথ খুলবে। যে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় মানুষ সহজে বুথমুখো হতেন না, যেখানে ভোটের গুরুত্ব বোঝাতে নির্বাচন কমিশনকে বাড়ি বাড়ি যেতে হোত,  সেই জঙ্গলমহলের বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রে সেইবার ভোট পড়েছিল ৮০ শতাংশেরও বেশি। আগে নির্বাচনগুলোতে বিনপুরে দুপুর পর্যন্ত যেখানে ভোট পড়ত ২০-২৫ শতাংশ, সেদিন সেখানে প্রথম  ৫ ঘণ্টায় ৫০ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছিল। বিনপুর বিধানসভায় সেদিন সক্কাল থেকে মানুষের এই ভোট দেওয়ার তীব্র উৎসাহের কারণ সেই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি। বুঝেছিলাম রেজাল্টের দিন। রাজ্যে ২৩৫ আসন পেয়েছিল বামেরা। শক্ত ঘাঁটি পশ্চিম মেদিনীপুরেও অধিকাংশ আসনেই জিতেছিল সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট। কিন্তু ২০০১ সালে বিনপুর কেন্দ্রে ২০ হাজারেরও বেশি ভোটে জেতা সিপিআইএম প্রার্থী শম্ভু মান্ডি ২০০৬ সালে হেরে গিয়েছিলেন ঝাড়খন্ড প্রার্থী চুনীবালা হাঁসদার কাছে। সেদিনের ভোটও ছিল আমার কাছে এক অমূল্য শিক্ষা।

১১ মে ২০০৮। নন্দীগ্রামে ভোট শুরুর প্রায় সওয়া ঘণ্টা আগে বুথের সামনে ভোটার কার্ড হাতে প্রায় একশো পুরুষ, মহিলার লাইন দেখে হঠাৎই দু’বছর আগের বেলপাহাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু মিল তো শুধু ভোটের লাইনে। এই মানুষগুলোর চোখে-মুখে জেদ, প্রত্যয় আর ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা দু’বছর আগে দেখা বেলপাহাড়ির তুলনায় ঢের বেশি। আরও একটা অমিল, যা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। সেবার এত মহিলা দেখিনি। এখানে তো পুরুষের থেকেও মহিলা বেশি। ভোটের দিন গ্রামের মহিলারা সাধারণত ঘরের কাজ সামলে, রান্নাবান্না সেরে অনেকে একসঙ্গে একটু দেরি করে বুথে যান। কিন্তু এক্কেবারে সাত সকালে, ভোট শুরুর ঘন্টাখানেক আগে বন্ধ বুথের সামনে ৫০-৬০ জন মহিলার অপেক্ষা করতে দেখা বিরল অভিজ্ঞতা । বিরল ঘটনাও।

সকাল ছ’টায় লাইভ দিলাম। লাইভেই ইন্টারভিউ করলাম তিন-চারজন ভোটারের। মূলত মহিলাদের। সবার এক উত্তর, ‘পরে যদি ঝামেলা হয়, ভোট দিতে না পারি তাই ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছি।’ নন্দীগ্রামে কী পরিস্থিতি অথবা ভোটে কী হবে, প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই।

সকাল ছ’টার লাইভ শেষ করে এদিক-ওদিক ঘুরছি। আবার লাইভ সাতটায়। একটু পরে স্কুলের দরজা খুলে ভোটের প্রস্তুতি শুরু হল বুথে। গাড়ি করে পুলিশ এল। সাড়ে ছ’য়টার মধ্যে ভোটারের লাইনটা দু’শো ছাড়িয়ে গেল।

সিপিআইএমের পোলিং এজেন্টরা আসতে শুরু করেছে। প্রায় পৌনে সাতটা বাজে, একটু পরেই ভোট শুরু হবে, তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও পোলিং এজেন্টের দেখা নেই। আমার ধারণা ছিল, তৃণমূল কংগ্রেস পোলিং এজেন্ট দিতে পারবে না। প্রার্থী দিতে পেরেছে, এই যথেষ্ট। তাও দেখছিলাম, যদি বিরোধীদের পোলিং এজেন্ট আসে। এল না। আবার লাইভ সাতটায়, আর কয়েক মিনিট বাদেই। হঠাৎ ফোন এল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আমার  অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক পুলিশ অফিসারের।

‘কোথায় আছ?’

‘গড়চক্রবেড়িয়া।’

‘বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে কাল রাতে, শুনেছো?’

‘না তো। কী হয়েছে?’

‘অলোক রাজের নামে এফআইআর হয়েছে। নন্দীগ্রাম থানায়। মলেস্টেশন কেস। সেই সঙ্গে চুরির অভিযোগও আছে।’

‘মানে? অলোক রাজের নামে শ্লীলতাহানির কেস? কার  শ্লীলতাহানি  করল? কী হয়েছে ঘটনাটা?’ উত্তেজনায় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। সিআরপিএফের ডিআইজি নন্দীগ্রামে মহিলার শ্লীলতাহানি করেছেন?

‘কাল রাতে অলোক রাজ বেরিয়েছিল। ৭ নম্বর জালপাই এলাকায় বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছিল। ভয় দেখাচ্ছিল ভোটারদের। মহিলারা বাধা দেয়। ও মহিলাদের গায়ে হাত দেয়। মারধোর করে। কয়েকজন মহিলা ওঁর বিরুদ্ধে মলেস্টেশনের কেস করেছে। কয়েকটা বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্রও নিয়ে গিয়েছে সিআরপিএফের জওয়ানরা। চুরির কেসও হয়েছে।’ গড়গড় করে বলে থামলেন ওই অফিসার। কেটে দিলেন ফোন।

আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছি না ঘটনাটা। এমনও হতে পারে? এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে কাল রাতে? ওদিকে অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে লাইভের জন্য। আর আমি বুঝতেই পারছি না কী করা উচিত এত বড়ো একটা খবর শুনে। ভাবছি, আমাকে ভুল খবর দিচ্ছে না তো? শুধুমাত্র একজনের কথায় রি-চেক না করে এত বড়ো একটা খবর চালিয়ে দেব? যদিও আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত অফিসার, তবুও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। ওই অফিসারকে আবার ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, অলোক রাজের বিরুদ্ধে এফআইআরের  খবর সিনিয়র অফিসাররা সব জানে?’

‘হ্যাঁ জানে তো। তোমাকেই প্রথম খবরটা দিলাম, তাড়াতাড়ি চালিয়ে দাও।’ সাতটায় লাইভ আর করা হল না, অলোক রাজের খবর নিয়ে কথা বলতে বলতে। বক্তব্য জানার জন্য ফোন করলাম অলোক রাজকে। মোবাইল বেজে গেল। পরপর দু’ বার। ঝুঁকি নিতেই হবে, কিচ্ছু করার নেই। এত বড়ো একটা খবর বেশিক্ষণ ফেলে রাখা যাবে না। অফিসে ফোন করে জানালাম খবরটা। সাড়ে সাতটায় লাইভ দিলাম। এবিপি আনন্দ চ্যানেলে চলতে শুরু করল নন্দীগ্রামে পঞ্চায়েত ভোটের দিন প্রথম সবচেয়ে বড়ো ব্রেকিং নিউজ, ‘সিআরপিএফের ডিআইজির বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ। অভিযোগ নন্দীগ্রাম  থানায়। এফআইআর করলো পুলিশ।’

অলোক রাজের বিরুদ্ধে এফআইআরের খবরে মুহূর্তের মধ্যে তোলপাড় পড়ে গেল রাজ্যজুড়ে। লাইভ শেষ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার কাছে নানান জায়গা থেকে ফোন আসতে শুরু করেছে, ঠিক কী হয়েছে জানতে চেয়ে। আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না, আসলে কী হয়েছে। খবর করছি ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এমন কী করে হতে পারে! আবার ফোন করলাম অলোক রাজকে। এবার একেবারে ফোন ধরলেন। গোটা ঘটনাটা জানালাম, যা পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন। অলোক রাজও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, থানায় তাঁর নামে শ্লীলতাহানির অভিযোগ হয়েছে শুনে। বারবার জানতে চাইছেন, এই কথা আমাকে কে বলেছে, কে অভিযোগ করেছে। ৩৫৪ ধারায় শ্লীলতাহানির অভিযোগ জমা পড়েছে শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। ফোনেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘আপকো লাগতা হ্যায়, ম্যায় অ্যায়সা কার সাকতা হু? ম্যায় ডিআইজি হু  সিআরপিএফ কা।  রাতকো গেস্টহাউস সে নিকালকে নন্দীগ্রামকে অওরাতকো মলেস্ট করেঙ্গে হাম? অ্যায়সা বুড়া জাগা হাম জিন্দেগি মে কাভি নেহি দেখা।’ থামতেই চাইছেন না ফোনে। কিন্তু শুধু ফোনে কথা বলে আমার কোনও লাভ নেই। ইন্টারভিউ করতে হবে তাঁকে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপ কাহা পর হ্যায় আভি, আপকা ইন্টারভিউ করনা পড়েগা। পুলিশ যো আরোপ লাগা রাহা হ্যায়, উসকা জবাব চাহিয়ে।’

‘আপ চলে আইয়ে তেখালি ব্রিজকে পাস। ম্যায় সাতেঙ্গাবাড়িমে যা রাহা হু। তেখালিপে মিলেঙ্গে।’

 

এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম তেখালি ব্রিজের দিকে। প্রায় আটটা বাজে। যেতে অন্তত আধ ঘন্টা-চল্লিশ মিনিট লাগবে। গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু মেইন রোড দিয়েই রওনা দিলাম। যেতে যেতে শুধু ভাবছি, এটা পুলিশ কী করে করল। ভোটের দিন সিপিআইএম করতে পারে না এমন কাজ কমই আছে। আর এটা তো নন্দীগ্রাম। এখানে সিপিআইএম সব করতে পারে। কিন্তু পুলিশ এটা কী করে করতে পারল? এই অভিযোগ যে দু’শো শতাংশ ভিত্তিহীন এবং অলোক রাজের বিরুদ্ধে কেস করা যে আসলে সিআরপিএফ বাহিনীকে ভোটের দিন চাপে রাখার পুলিশি কৌশল মাত্র, তাতে তখন আমার আর বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। পুলিশ এবং সিপিআইএমের এই যৌথ পরিকল্পনাটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছে, এখন সেটাই হদিস করা দরকার। কিন্তু তা পরে হবে, আপাতত দরকার অলোক রাজের একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ।

তেখালি ব্রিজে পৌঁছানোর আগে মহেশপুরের কাছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোককে জিজ্ঞেস করলাম অলোক রাজের কথা। সিআরপিএফের কনভয়ের কথা। কেউ কিছু বলতে পারল না। ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছে পশ্চিমদিকে রাস্তায় নামলাম। দু’একজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলেন, সিআরপিএফের গাড়ি কোন দিকে গিয়েছে। ৪-৫ কিলোমিটার এগোতেই দেখলাম সিআরপিএফের কনভয়। ডিআইজি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। সাধারণ ভোটারের সঙ্গে কথা বলছেন। গাড়ি থেকে নেমে সোজা এগিয়ে গেলাম অলোক রাজের দিকে। বললাম, তাঁর বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম থানায় হওয়া শ্লীলতাহানি এবং চুরির অভিযোগের কথা। ততক্ষণে শ্যামল ছবি তুলতে শুরু করেছে। অলোক রাজের মুখচোখই বলে দিচ্ছে, এমন অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে হয়নি। কী উত্তর দেবেন যেন বুঝেই উঠতে পারছেন না। ইন্টারভিউ দিলেন। বললেন, অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে। তিনি রাতে গেস্টহাউস থেকে বেরোননি। ৭ নম্বর জালপাইয়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আরও বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযোগের জন্য তিনি আদালতের দ্বারস্থ হবেন। ইন্টারভিউ দিয়ে গাড়িতে উঠলেন অলোক রাজ। রওনা দিলেন  তেখালি ব্রিজের দিকে। পিছু নিলাম তাঁর গাড়ির। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, পিকচার আভি বাকি হ্যায়, সবে তো পর্দা উঠেছে।

 

অলোক রাজ এবং লক্ষ্মণ শেঠ

 

এরপর তার কনভয়ের সঙ্গে এলাম তেখালি ব্রিজে। ব্রিজ পার হয়ে খেজুরির দিকে একটু এগিয়ে থেমে গেল তাঁর গাড়ি। গাড়ি থেকে নামলেন। আমিও নামলাম। সিআরপিএফের কয়েকজন ছাড়া আর কেউ নেই। অফিস থেকে বারবার তাড়া দিচ্ছে অলোক রাজের ইন্টারভিউটা পাঠানোর জন্য। কিন্তু আমি তেখালি ব্রিজে, ওবি ভ্যান গড়চক্রবেড়িয়াতে। অন্তত এক ঘণ্টার আগে পৌঁছনো মুশকিল। এদিকে অলোক রাজ তেখালি ব্রিজে নিজের গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কাউকে একটা ফোন করে তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া এফআইআরের কথা জানাচ্ছেন। তাঁকে না বলে যাওয়া ঠিক হবে না। মাথায় একটা প্ল্যান এল। অলোক রাজ ফোন ছাড়তেই বললাম, ‘আপ মেরে চ্যানেলপে এক ফোনো দে দিজিয়ে। ইয়ে ইন্টারভিউ ভেজনে মে থোরা টাইম লাগেগা। তব তক আপকে উপর যো আরোপ হ্যায় উসমে আপকা ফোনো চলেগা।’ একবারেই রাজি হয়ে গেলেন সিআরপিএফের ডিআইজি। অফিসে প্রডিউসার সৌমিক সাহাকে ফোন করে বললাম, ‘অলোক রাজের ইন্টারভিউ পাঠাতে একটু দেরি হবে। অলোক রাজের ফোনো নিয়ে নাও। আমার ফোনে ধরো, অলোক রাজ ফোনো দিয়ে দেবে। সৌমিক সঙ্গে সঙ্গে রাজি। এক মিনিটের মধ্যে আমার মোবাইলে ফোন এল অফিসের স্টুডিও থেকে। ফোনটা রিসিভ করে দিয়ে দিলাম অলোক রাজের হাতে। স্টুডিওতে তখন অ্যাঙ্কারিংয়ে ছিল সুমন দে। সুমন একের পর এক প্রশ্ন করছে, আর অলোক রাজ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জবাব দিচ্ছেন। আমাকে একটু আগে ইন্টারভিউতে যা বলেছিলেন, মোটামুটি একই কথা। ঠিক সেই সময় ঘটল সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা। আমার ফোনে অলোক রাজ ফোনো দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময় তাঁর অন্য হাতে থাকা নিজের মোবাইল সেটটা বেজে উঠল। ফোনো দিতে দিতে আড়চোখে নিজের মোবাইল সেটের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সেটাকে সাইলেন্ট করে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে আবার বেজে ওঠল তাঁর মোবাইল সেট। আবার স্ক্রিনের দিকে তাকালেন, নম্বর দেখলেন এবং ফোনটা কেটে দিলেন। কারণ, একটা ফোন বাজলে অন্য ফোনে কথা বলতে অসুবিধা হয়। তখন সুমনের দু’নম্বর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন লাইভে। এক মিনিট বাদে আবার বাজলো তাঁর মোবাইল এবং এবার দৃশ্যতই  চরম বিরক্ত হলেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বুঝতে পারলাম, কোনও একজন বারবার ফোন করছে। কে জানি না। তৃতীয়বার ফোন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অলোক রাজ ফোনটা দিলেন তাঁর সিকিউরিটির হাতে। ইশারায় বললেন, ফোন ধরে কথা বলার জন্য। সিকিউরিটি অফিসার ফোনটা রিসিভ করে বললেন, ‘সাব আভি বিজি হ্যায়, আপ থোড়া বাদমে কিজিয়ে।’

এরও এক-দেড় মিনিট পর অলোক রাজের ফোনো শেষ হল আমাদের চ্যানেলে। তারপর আমাকে মোবাইল সেট ফেরত দিতে দিতে বললেন,

‘লক্ষ্মণ শেঠ বারবার ফোন কর রাহা থা।’ শুনেই চমকে উঠলাম, লক্ষ্মণ শেঠ ফোন করছেন? নাটক তার মানে আরও বাকি আছে! সঙ্গে সঙ্গে ফের লক্ষ্মণ শেঠের ফোন।

‘ফির ওহি,’ বলে ফোন রিসিভ করলেন ডিআইজি সিআরপিএফ আলোক রাজ। ইশারায় তাঁকে বললাম ফোনটা লাউড স্পিকার মোডে দিতে। দশ হাত দূরে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল শ্যামল। তাড়াতাড়ি ওকে ডেকে বললাম পুরোটা রেকর্ড করতে। ওর ক্যামেরা অন করতে হয়তো ১২-১৫ সেকেন্ড সময় লাগল। তারপর তমলুকের  সাংসদের সঙ্গে সিআরপিএফ ডিআইজির কথোপকথন কোনও নির্বাচনের দিন আমার সাংবাদিক জীবনে দেখা সেরা অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা। শুনছি আর ভাবছি, হচ্ছেটা কী? এমনও হয়? অবশ্য নন্দীগ্রামে সবই হয়!

অলোক রাজঃ হোয়াই দিস ফলস এফআইআর এগেনস্ট মী? নো নো, মিস্টার শেঠ, হোয়াই দিস ফলস এফআইআর এগেনস্ট মী? ডু ইউ থিঙ্ক আই অ্যাম সাচ আ পার্সন, আই উইল গো অ্যান্ড মলেস্ট আ লেডি।

ওদিক থেকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন লক্ষ্মণ শেঠ, পরিষ্কার করে কিছু বোঝা গেল না।

অলোক রাজঃ নো, বাট হোয়াই দিস টাইপ অফ অ্যালিগেশন। ইউ আর এ মেম্বার অফ পার্লামেন্ট। আই রেসপেক্ট ইউ। ইউ আর এ মেম্বার অফ পার্লামেন্ট।

আবার কিছু একটা বললেন লক্ষ্মণ শেঠ।

কিন্তু অলোক রাজের উত্তেজনা তখনও কমছেই না। চিৎকার করছেন ফোনে।

অলোক রাজঃ নো, আই অ্যাম নট একসিডিং মাই লিমিট। প্লিজ, আই এম নট একসিডিং মাই লিমিট স্যার। ইউ আর ট্রায়িং টু প্রেশারাইজ মি অ্যান্ড ব্ল্যাকমেইল মী। লেকেন ইয়ে আদমি কিউ মেরে খিলাফ মিডিয়ামে বোল রাহা হ্যায়। বাতাইয়ে, বাতাইয়ে।

লক্ষ্মণ শেঠঃ আই র‍্যাং ইউ। অ্যান্ড ইউ হ্যান্ড ওভার দ্য টেলিফোন।

অলোক রাজঃ নো স্যার, আই ওয়াজ বিজি ডুয়িং সামথিং। আই অ্যাম টেকিং ইয়োর কল। হ্যাড আই নট ওয়ান্টেড টকিং উইথ ইউ।

লক্ষ্মণ শেঠঃ ইয়োর টেলিফোন ওয়াজ নট ওপেন। ইউ আর দ্য অফিসার।

অলোক রাজঃ আই অ্যাম কিপিং মাই ফোন ওপেন সিনস মর্নিং অ্যান্ড আই হ্যাভ রিসিভড অ্যাট লিস্ট হান্ড্রেড কলস….। নো, নো।

লক্ষ্মণ শেঠঃ আই র‍্যাং ইউ, আই অ্যাম হার্ট।

অলোক রাজঃ নো নো। আই অ্যাম অলসো ভেরি হার্ট স্যার। আই অ্যাম অলসো ভেরি হার্ট। হোয়াই দিস ফলস এফআইআর এগেনস্ট মী। হোয়াই? হোয়াট রং হ্যাভ আই ডান? লিসন স্যার, আই অ্যাম ট্রাইং টু প্রোটেক্ট দিস সিটিজেনস অফ দিস এরিয়া। আই অ্যাম ডুইং মাই ডিউটি, অ্যান্ড দেয়ার ইজ আ ফলস এফআইআর এগেনস্ট মী।

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২৪: ‘পুলিশকো হাম দেখ লেঙ্গে’, বললেন সিআরপিএফের ডিআইজি অলোক রাজ

 

এবার স্পিকার অফ করলেন অলোক রাজ। ওপার থেকে লক্ষ্মণ শেঠ কী বলছেন শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু অলক রাজ বলে যাচ্ছেন।

অলোক রাজঃ ইউ প্লিজ আস্ক ইয়োর পার্সনস, দে হ্যাভ  সিন মি? হোয়েন ওয়াজ দিস? হোয়াট টাইম? হোয়াট টাইম স্যার, হোয়াট টাইম? ফোর থার্টি ইন দ্য মর্নিং? হোয়েন? হোয়েন? ফোর থার্টি ইন দ্য আফটার নুন? আই ওয়াজ সিটিং ইন দ্য পুলিশ স্টেশন। ফোর থার্টি, আই ওয়াজ অ্যাট মাই ক্যাম্প রাজারামচক। দেন আই ওয়েন্ট টু দ্য পুলিশ স্টেশন।

কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন সিআরপিএফের ডিআইজি। বোঝা যাচ্ছে বারবার লক্ষ্মণ শেঠের কাছে জানতে চাইছেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে শ্লীলতাহানির অভিযোগ হয়েছে তা ঠিক কোন সময়ের। আবার মোবাইলের স্পিকার অন করলেন তিনি।

অলোক রাজঃ লিসন টু মি। লিসন টু মি। প্লিজ লিসন টু মি।

লক্ষ্মণ শেঠঃ আই উইল নট লিসন।

অলোক রাজঃ নো, প্লিজ  লিসন টু মি, মিঃ শেঠ। আই ডিড নট গো টু ৭ নম্বর জালপাই। আই ওয়াজ ইন মাই ক্যাম্প রাজারামচক। ফ্রম দেয়ার আই স্ট্রেটঅ্যাওয়ে ওয়েন্ট টু নন্দীগ্রাম পুলিশ স্টেশন। হু এভার ইজ সেয়িং, আই ওয়েন্ট টু ৭ নম্বর জালপাই, ইজ অ্যাবসোলিউটলি রং।

আবার শোনা গেল লক্ষ্মণ শেঠের গলা। একে স্পিকার ফোন, তার ওপর তেখালি ব্রিজে জোরে হাওয়া দিচ্ছে, খুব একটা পরিষ্কার শোনা গেল না। মোটামুটি বোঝা গেল, নন্দীগ্রামে সিআরপিএফের মুভমেন্ট নিয়ে অভিযোগ করছেন তমলুকের সিপিআইএম সাংসদ।

লক্ষ্মণ শেঠঃ আন্ডার ইয়োর কল দে ওয়েন্ট ৭ নম্বর জালপাই। হোয়াই দে আর মুভিং?

তমলুকের সাংসদের কথায় এতক্ষণে স্পষ্ট হল, তিনি অভিযোগ করছেন সিআরপিএফের মুভমেন্ট নিয়ে। ভোটের আগের দিন সন্ধে থেকে নন্দীগ্রামজুড়ে কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর তল্লাশি অভিযান এবং নজরদারি তাঁর না পসন্দ।

অলোক রাজঃ নো স্যর, নো স্যর। লেট মি ক্ল্যারিফাই ইউ। মিঃ এ কে সরকার, আইজিপি  অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, হি হ্যাজ গিভেন মি ইন রাইটিং, দ্যাট সিআরপিএফ উইল অ্যাক্ট অ্যাজ এক্সিসটিং এরিয়া অফ রেস্পন্সিবিলিটি। অ্যান্ড স্যর, আই উইল টেল ইউ, ইট ওয়াজ দ্যাট, উই উইল গো উইথ লোকাল পুলিশ অ্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেট। নাউ অলসো আই অ্যাম উইথ দ্য ম্যাজিস্ট্রেট।

এরপর অলোক রাজ এদিক ওদিক তাকিয়ে চিৎকার করলেন, ‘হোয়ার ইজ দ্য ম্যাজিস্ট্রেট?’ তারপর আবার ফোনে লক্ষ্মণ শেঠকে বলতে শুরু করলেন।

অলোক রাজঃ আই অ্যাম মুভিং উইথ লোকাল পুলিশ অ্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেট। ইউ আর দ্য মেম্বার অফ পার্লামেন্ট। লেট মি ক্ল্যারিফাই ইউ পোলাইটলি, আই অ্যাম নট ওয়ার্কিং আন্ডার ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। লেট ইট বি ভেরি ক্লিয়ার। বাট আই অ্যাম ওয়ার্কিং অ্যাজ আ টিম, আই অ্যাম টেলিং ইউ। বাট আই অ্যাম ভেরি ভেরি হার্ট উইথ দিজ ফলস এফআইআর। অ্যান্ড আই অ্যাম টেলিং ইউ স্যর, আই উইল গো টু অনারেবল কোর্ট। অ্যান্ড আই উইল আস্ক স্যর কোর্ট টু ইন্টারফেয়ার ইন দিজ অ্যান্ড হ্যাভ আ সিবিআই এনকোয়ারি। হোয়াই দিজ ফলস এফআইআর এগেনস্ট মি। ইট’স মাই রাইট। ইট’স মাই ফান্ডামেন্টাল রাইট, হাউ ক্যান টলারেট আ ফলস এফআইআর এগেনস্ট মি? আই অ্যাম নট হার্মিং এনিবডি। আই অ্যাম জাস্ট ডুয়িং মাই পেট্রোলিং, নাথিং এলস।

টানা বলে থামলেন অলোক রাজ। দৃঢ়তার সঙ্গে স্পষ্ট গলায় লক্ষ্মণ শেঠকে জানিয়ে দিলেন তাঁর এক্তিয়ার। অন্য দিকে লক্ষ্মণ শেঠের গলা পাওয়া গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তা থামিয়ে ফের সুর চাড়ালেন ডিআইজি সিআরপিএফ।

আলোক রাজঃ মিঃ শেঠ, হাউ ক্যান ইউ ডিরেক্ট মি দ্যাট আই শুড নট মুভ অ্যান্ড স্টে অ্যাট মাই ক্যাম্প? নো নো, মিঃ শেঠ, ইউ আর কলিং ইন মোবাইল অন রেকর্ড। নো, নো, ইউ ক্যান নট কনফাইন মি ইন ক্যাম্প। সরি।

টানা ১২ মিনিট উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে পর ফোন কেটে দিলেন অলোক রাজ। ডিআইজি সিআরপিএফের সঙ্গে কথা বলে ফোন ছাড়েন, কিন্তু হাল ছাড়লেন না লক্ষ্মণ শেঠ। নন্দীগ্রামে কীভাবে ভোটের বাকি সময়টা সিআরপিএফের টহলদাড়ি বন্ধ করা যায় তার প্ল্যানিং শুরু করলেন। যা এই উত্তপ্ত কথোপথনের রেশ কাটতে না কাটতেই ফের টের পেলাম।

 

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.