লকডাউনে অনলাইন পড়াশোনা, তৈরি হয়েছে নতুন পৃথিবীর নবতম ইতিহাসের এক বিরাট অধ্যায়

করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রায় গত দেড় মাস ধরে চলছে লোকডাউন। এই লকডাউনের জেরে প্রথম দিকে বেশ কিছু অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয়েছিল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। আসলে মাত্র কয়েক মাস আগেও কেউ ভাবতে পারেনি যে, এইরকম এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই শিক্ষকদেরও অল্প সময়ের মধ্যেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কীভাবে ক্লাস নেওয়া যায় তা শিখে নিতে হয়েছে।
জুমের হিসেব বলছে, লকডাউন পর্বে ১ কোটি থেকে ২০ কোটিতে পৌঁছে গেছে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এছাড়াও, গুগল ডুয়ো, গুগল ক্লাসরুমের মতো আরও অনেক প্ল্যাটফর্ম তো রয়েছেই। জনপ্রিয় ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ‘বাইজুস’-এর ভিউয়ার সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে। আগে যা ছিল তিন মিলিয়ন, লকাউন পর্বে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ মিলিয়নের বেশি। বিশ্বের মধ্যে ভারতের ১০ টি শহরেই এর ভিউয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বেড়েছে ‘আনঅ্যাকাডেমি’র ভিউয়ার। এই প্ল্যাটফর্মগুলির মধ্যে অনেকগুলিই রয়েছে একেবারে বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। আবার কিছু প্ল্যাটফর্ম রয়েছে কিনতে হয় মূল্যের বিনিময়ে।
পড়ানোর পদ্ধতিকেও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন রয়েছে ক্লাস শুরুর আগের পর্ব, ক্লাস পর্ব এবং ক্লাস শেষের পর্ব। শুরুতে রয়েছে রোল কলের ব্যবস্থা। প্রতিটি ক্লাসের শেষে ছাত্র-ছাত্রীরা পেয়ে যাচ্ছে পুরো ক্লাসের ভিডিও রেকর্ডিং। অভিভাবকরা পাচ্ছেন ফিডব্যাক ফর্ম। তার মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের ত্রুটিগুলো জেনে বুঝে নিচ্ছেন। প্রশ্নোত্তরের জন্য তৈরি হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ।
চ্যাট করে জেনেছি, সাধারণ ভাবে এই অনলাইন পদ্ধতিটি শিখে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোন অসুবিধে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ছাত্র-ছাত্রীরাও খুব খুশি। অবিভাবকরাও, কীভাবে সিলেবাস শেষ হবে তা নিয়ে কিছুটা চিন্তামুক্ত। তবে এর মধ্যেও ছাত্র-ছাত্রীরা ভুলতে পারছে না ক্লাসরুমকে।

লকডাউনে কোচিং পর্বও চলছে ল্যাপটপ, মোবাইলে। সরাসরি ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না যারা, তাদের জন্য বিষয়ভিত্তিক লেকচারের ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে আপলোড করে দিচ্ছেন শিক্ষকরা। ছাত্র-ছাত্রীরা সেখান থেকেই তাঁদের নোট নিচ্ছে বা পূরণ করছে তাঁদের খামতি। বিভিন্ন বোর্ডের দশম বা দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা বাকি। সেই কারণে অনেকে চোখ রেখেছে ইউটিউবের লেকচার ভিডিওগুলোর দিকে।
বোর্ড পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেল জয়েন্ট। তাই যে বাড়তি সময়টা পাওয়া গিয়েছে, সেটাকেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কাজে লাগাচ্ছে পরীক্ষার্থীরা। এ সুযোগ জীবনে আর আসবে না। বইয়ের সঙ্গে যে অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ মিলেছে তাঁর সঠিক ব্যবহার করলে তা হবে আশীর্বাদ।
আবার এই পরিস্থিতির মধ্যেই বিভিন্ন বোর্ড বা সরকার টিভির পর্দাতেও ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনের মাধ্যমে প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থা থাকছে। এখানেও ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ নিচ্ছে।
বর্তমানে কিছু সংস্থা ছাত্র-ছাত্রী কিংবা অভিভাবকদের জন্য চালু করেছে স্বল্প সময়ের অনলাইন কোর্স। এ মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন, বিভিন্ন আইআইটি, আইআইএম এবং তথ্যপ্রযুক্তির জাতীয় ও বহুজাতিক সংস্থা। যেমন এআইসিটিই তাদের ‘স্বয়ম’ ওয়েব পোর্টালে মার্চ মাস থেকে প্রায় ১১০০ টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির বিষয়। এদের ই-লাইব্রেরিতে প্রচুর বই। ক্লাস নিচ্ছেন অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা। বিনামূল্যে পড়ানো হচ্ছে। সার্টিফিকেটও মিলছে। দেশ-বিদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন চলছে কাউন্সিলিং, অ্যাডমিশন, পড়াশোনা। চলছে প্লেসমেন্ট। শুধু লেখাপড়া নয়, অনলাইনে আছে সাহিত্যচর্চা, বিনোদনের ব্যবস্থা। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে শুরু হয়েছে তা। সমীক্ষা বলছে লকডাউনের প্রথম ২১ দিনে এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকরা।
সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন পৃথিবীর নবতম ইতিহাসের এক বিরাট অধ্যায়। লেখা থাকবে কীভাবে এই সময়েও তরুণ-তরুণীরা থেমে থাকেনি। দেখেছে স্বপ্ন। ওরা যে ভয়ডরহীন। অন্ধকারকে সরিয়ে আলোর পথ দেখানোই ওদের একমাত্র লক্ষ্য।

Comments are closed.