কে এই ঝাড়খণ্ডের মাধ্যমিক পাশ নকশাল নেতা রাজকুমার যাদব, যাঁর জন্য কোডারমায় প্রার্থী বদলাতে বাধ্য হল বিজেপি?
বিহারে বিজেপির বিরুদ্ধে বামপন্থী মুখ কানহাইয়া তো ঝাড়খণ্ডে রাজকুমার যাদব। ছোটনাগপুর মালভূমির রুক্ষ কোডারমার মাটিতে লাল পতাকার ঝড় তুলে তিনি বলছেন, বিজেপি বিদায় এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
২০০০ সালের ১৫ ই নভেম্বর, নবগঠিত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিজেপির বাবুলাল মারান্ডি। সেই বাবুলালকে হারিয়েই বিধানসভায় ঢুকেছেন তিনি। লোকে তাঁকে জায়ান্ট কিলার বলে। ২০১৪ য় যখন প্রবল মোদী হাওয়ায় কাঁপছে সারা দেশ, সেই সময়ও কোডারমা লোকসভায় পেয়েছিলেন আড়াই লাখের বেশি ভোট। জয়ী প্রার্থীর একেবারে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে সেবারে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। জানতেন, জয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। একই বছর ঝাড়খণ্ড বিধানসভা ভোটে গিরিডি জেলার ধানোয়াড় কেন্দ্রে তাঁর দাপটের কাছে ধুলোবালির মতো উড়ে গিয়েছিলেন বাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বাবুলাল মারান্ডির মতো হেভিওয়েটকে ধরাশায়ী করে পা রেখেছেন বিধানসভার অন্দরে। এবার তাঁর কথায়, স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনেও, তিনি ময়দানেই আছেন। আর তাঁকে ময়দানে দেখে জয়ী প্রার্থীকে পর্যন্ত বদলাতে বাধ্য হয়েছে বিজেপি। তিনি রাজকুমার যাদব। ঝাড়খণ্ডের কোডারমা লোকসভা কেন্দ্রের সিপিআইএমএল (লিবারেশন) প্রার্থী। তিনি বলছেন, তাঁর জয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাঁর দাপট এতদিন দেখেছে ঝাড়খণ্ড বিধানসভা, এবার লোকসভাও দেখার অপেক্ষা।
কোডারমা কিংবা বেগুসরাই, দু’জায়গাতেই মানুষের অধিকারের পক্ষে লাল ঝাণ্ডা কাঁধে লড়াই করছেন দুই বামপন্থী। দুই জায়গাতেই বাতাসে ভেসে আসছে ইনকিলাব জিন্দাবাদ আর লাল সেলামের প্রতিবাদী কণ্ঠ। তরুণ কানহাইয়া যেমন ওয়ান টু ওয়ান জনসংযোগের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়াতেও ঝড় তুলেছেন, কোডারমার রাজকুমার যাদবের অবশ্য তা না। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এখনও দুরত্ব বজায় রেখেই চলেন। কানহাইয়ার মতো ক্রাউড ফান্ডিংয়েও যাচ্ছেন না। সমমনস্ক মানুষদের অকৃপণ সহায়তায় প্রতিবারের মতো এবারও ভোটে লড়ছেন তিনি। যদিও জনসংযোগে তাঁর সমকক্ষ কারও কথা ভাবতে পারেন না এলাকার লোকজন। তাঁর লড়াই এঁদের নিয়েই। কখনও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, আবার কখনও ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, তো কখনও উচ্ছেদের প্রতিবাদ। লাল নিশান হাতে রাজকুমার যাদবের দেখা মেলে রাস্তায়।
এহেন বামপন্থী নেতার প্রভাব বোঝার জন্য একটি ছোট্ট গল্পই যথেষ্ট। ঝাড়খণ্ড রাজ্য তৈরির বহু আগে থেকেই মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করার লড়াইয়ে নেমেছিলেন রাজকুমার। যোগ দিয়েছিলেন সিপিআইএমএল (লিবারেশনে)। ঝাড়খণ্ড রাজ্য তৈরি হওয়ার পর, বাবুলাল মারান্ডি এবং তারপর অর্জুন মুন্ডা সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক সফল গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে সে সময় সরকারের রোষে পড়েন রাজকুমার যাদব। গ্রেফতার করা তাঁকে। সেটা ২০০৪। কিন্তু জেলে পুরেও প্রতিবাদ দমন করা যায়নি। জেল থেকে লোকসভায় লড়ে রেকর্ড ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ভোট পান রাজকুমার। সেদিনই ঝাড়খণ্ড পেয়ে গিয়েছিল নতুন নেতা, বলছেন রাজকুমারের অনুগামীরা। তারপর বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে মাধ্যমিক পাশ রাজকুমার যাদবের রাজনৈতিক জীবন। ২০০৫ এর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক মুখে খুন হন ওই এলাকার আর এক দাপুটে সিপিআই এমএল (লিবারেশন) নেতা মহেন্দ্র সিংহ। অভিযোগ, রাজনৈতিকভাবে পেরে না উঠে এভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিয়েছিল বিজেপি। এই মহেন্দ্র সিংহের কাছেই রাজনীতির হাতেখড়ি রাজকুমার যাদবের। আচমকা মাঝপথে গুরুকে হারালেও দমেননি রাজকুমার। বরং আরও তেড়েফুঁড়ে নেমেছেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার লড়াইয়ে। আর যতদিন গেছে, তত বেশি মানুষ আসতে শুরু করেছেন রাজকুমারের লাল ঝাণ্ডার নীচে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ, হল্লা বোল আর লাল সেলামের স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। দেশের উচ্চশিক্ষার উপর কেন্দ্রীয় সরকারি জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে উঠে আসা কানহাইয়ার সঙ্গে কোডারমার সিপিআইএমএল (লিবারেশন) প্রার্থীর পার্থক্য একটাই, রাজকুমার এই মাটিতেই বড় হয়েছেন, এই মাটির কথাই বলছেন, এই মাটির মানুষদের জন্যই আন্দোলন করছেন, বলছেন লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
কোডারমা লোকসভায় আগেরবার জিতেছিলেন বিজেপির সেই সময়কার রাজ্য সভাপতি রবিন্দর রাই। ২০১৪ য় যে রবিন্দর রাইয়ের হাতযশে ঝাড়খণ্ডের ১৪ টি আসনের মধ্যে ১২টি আসন দখল করেছিল বিজেপি। কিন্তু সিপিআইএমএল (লিবারেশন) কোডারমা কেন্দ্রে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতেই, কাটা যায় রবিন্দরের টিকিট। তাঁর বদলে পদ্মফুল চিহ্নে এবার কোডারমা থেকে লড়বেন অন্নপূর্ণা দেবী। মাত্র ক’মাস আগেই আরজেডি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তিনি। আর আছেন বিজেপি ছেড়ে ঝাড়খণ্ড বিকাশ মোর্চা তৈরি করা বাবুলাল মারান্ডি। তিনি আবার মহাগটবন্ধন প্রার্থী। কোডারমায় বহুমুখী লড়াইয়ের ময়দান তৈরি। জিততে তৈরি রাজকুমার যাদবও। মৃদু হেসে বলেন, জয়টা শুধু সময়ের অপেক্ষা।