জন্মদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় জ্যোতি বসুকে নিয়ে প্রচার-ঝড় এবং আজকের সিপিএম নেতৃত্ব।

বিশ্বকাপে বাঙালি যাদের ঝড় দেখার আশায় বসে ছিল, তার মধ্যে জার্মান ও আর্জেন্টিনা প্রথম ও দ্বিতীয় রাউন্ডে সবাইকে হতাশ করে বিদায় নিয়েছে। কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিয়েছে ব্রাজিলও। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়েই গত মাসখানেক ধরে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু বিশ্বকাপের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া মঞ্চে সাম্প্রতিককালে সিপিএম যেভাবে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক প্রচার ও আক্রমণের ঝড় তুলেছে, তা প্রশংসনীয় এবং সিপিএম সমর্থকদের মধ্যে নতুন করে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। কেন্দ্রের জনবিরোধী নানা নীতিকে যেভাবে তুলোধোনা করা হয়েছে, যেভাবে বিভিন্ন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ভার্চুয়াল দেওয়ালে-দেওয়ালে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নানা স্লোগান, তাতে প্রমাণ হয় সিপিএম এখনও কেমন শক্তিশালী, কেমন সংগঠিত। প্রচার ও অভিনবত্বে বিজেপির কুখ্যাত আই টি সেলকে সিপিএম দাঁড় করিয়ে গোল দিতে পারে। বিজেপি আই টি সেলের অধিকাংশ প্রচার মিথ্যা। বিকৃতি ও ফটোশপের উপর দাঁড়িয়ে। সেখানে সিপিএমের অস্ত্র বিভিন্ন রিপোর্ট, বিভিন্ন ব্যক্তির সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে অভিমত, বিভিন্ন পরিসংখ্যান। সেখানে মিথ্যার কোনও জায়গা নেই, বিকৃতির কোনও ছোঁয়া নেই। লোককে ভুল বুঝিয়ে কাছে টানার সস্তা রাজনৈতিক কৌশল নেই। লোকজনকে ধর্মের নামে, জাতের নামে উস্কে, হিংসা সৃষ্টি করে, সেই হিংসা সুকৌশলে ‘হিন্দু বিপন্নতার’বিজ্ঞাপন হিসাবে জাহির করে সাম্প্রদায়িকতা নষ্ট করে রাজনৈতিক মেরুকরণ থেকে ফায়দা তোলার কোনও অসৎ অভিপ্রায় নেই।


বরেণ্য কমরেড জ্যোতি বসুর জন্মদিন উপলক্ষে রবিবার, ৮ জুলাই সকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে প্রচার এরই মধ্যে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করছে। কমরেড জ্যোতি বসু সম্পর্কে অনেক অজানা কথা, তথ্য উঠে এসেছে, ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। জনচেতনার স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি করেছে, আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। কেন্দ্রীয়, রাজ্য, এবং বিভিন্ন জেলা ও বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক ফেসবুক পেজ এবং ট্যুইটারে বিভিন্ন আঙ্গিকে সারাদিন, #JyotiBasuLongLive #জ্যোতিবসুলালসেলাম হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে জ্যোতি বসুকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম-নিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক জ্যোতি বসু। বিজেপিকে বাবরি মসজিদ কাণ্ডের জন্য অসভ্য, বর্বর দল বলেছিলেন এবং বলতে পেরেছিলেন বলেই তিনি তাঁর দলীয় বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষক ও বাহক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও না কোথাও জ্যোতিবাবুর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এই সময় সিপিএম নেতৃত্বের এক দুর্বলতাকে দেখিয়ে দেয়। তাঁর মতো কঠোর নেতার বড়ই অভাব এখন সিপিএমে, যিনি বিজেপি তথা আরএসএসের চোখে চোখ রেখে তাঁদের ভণ্ডামির কথা, তাঁদের মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ বাড়ানো রাজনীতির কথা সর্বসমক্ষে বলবেন। লক্ষ-লক্ষ সংখ্যালঘু পরিবারকে এই কথা বলে আশ্বাস দেবেন, এই পশ্চিমবঙ্গ দাঙ্গাবাজদের নয়, এই পশ্চিমবঙ্গ মিথ্যাবাজদের নয়।
সিপিএম নেতৃত্ব কি ধর্ম-নিরপেক্ষতা রক্ষার্থে জ্যোতিবাবুর অনমনীয় পথ, মতাদর্শ বা অবস্থান আজ ধরে রাখতে পেরেছে? আজকের দিনে সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সেই প্রশ্ন ওঠা উচিতও, কারণ, আজও জ্যোতিবাবুকে নিয়ে পোস্ট গোটা সোশ্যাল মিডিয়ায় এক শিহরণ সৃষ্টি করে। আজও জ্যোতি বসুকে নিয়ে এই উন্মাদনা, মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা দেখিয়ে দিচ্ছে, বিজেপির এই ‘আগ্রাসী হিন্দুত্ব’ দিয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে বঙ্গ জয়ের নিন্দিত কৌশল রুখতে কেবল সোশ্যাল মিডিয়া নয়, মাঠে ময়দানে বিজেপির মোকাবিলায় জ্যোতি বাবুর দৃঢ়চেতা গলায় দেওয়া অদম্য লড়াই বার্তা অনুসরণ করা আশু প্রয়োজন। বর্বর দলের বিরুদ্ধে নরমপন্থী নয়, দরকার রাজনৈতিকভাবে চরমপন্থী অবস্থান, রাজনৈতিক লড়াই ও আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপিকে মানুষ থেকে বিছিন্ন করার রাজনৈতিক পরিকল্পনা।


কমরেড জ্যোতি বসু সোজা ব্যাটে খেলতেন, মেরুকরণ, ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে খেলতে গেলেও কালীপূজা বা সৎ সঙ্গের আশ্রমে গিয়ে বা মসজিদে গিয়ে জনসংযোগ করলে আত্মঘাতী গোল খেয়ে লড়াই থেকে ছিটকে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি। কমরেড জ্যোতি বসুর আদর্শকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাজিয়ে প্রচার অবশ্যই রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি, এবং সেই কাজে তাঁর জন্মদিবসে একশো ভাগ সফল সোশ্যাল মিডিয়ার সিপিএম। কিন্তু জ্যোতিবাবুর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে রক্ষা করতে এবং সেই লড়াইকে এই কঠিন সময় মাঠে-ময়দানে রাজনীতির রূপ দেওয়াতে কতটা সফল হবে সিপিএম নেতৃত্ব সেটাই আজ দেখার। দেখার সিপিএম নেতৃত্ব পেনাল্টি মিস করা ম্যাচ হারানো স্টাইকার হবে, না গোল বাঁচিয়ে ম্যাচ জেতানো গোলকিপার

Leave A Reply

Your email address will not be published.