#মিটুঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ক্ষমতার এক মূর্তমান প্রতীক, যেখানে মহিলাদের প্রতিদিন গিলোটিনে চাপানো হয়

#মিটু মুভমেন্ট ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছে। ভারতেও পড়তে শুরু করেছে এর প্রভাব।
কর্মক্ষেত্রে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাও এর থেকে আলাদা কিছু নয়। বাংলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রিত সংবাদপত্র আনন্দবাজার পত্রিকায় এক কমবয়সী মেয়ের যোগ দেওয়া, সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার একরাশ স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করা, সিনিয়রদের অন্ধের মতো বিশ্বাস করা। এরপরই শুরু হয় এক সিনিয়ার পুরুষ সহকর্মীর অভব্য আচরণ, যৌন হেনস্থা, যা থেকে বাঁচতে অসহায় মেয়েটি বাধ্য হয় অভিযোগ জানাতে। কিন্তু কী হয় এই অভিযোগ জানানোর পর, সেই ঘটনাই এই লেখার মূল বিষয়।
এই ঘটনা ২০০৮ সালের। মেয়েটি তখন সদ্য বিবাহিতা, সবে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার জেলা ডেস্কে কাজ করার সেই সময় তাঁর সঙ্গে ঘটে এই ঘটনা। এবং সেই ঘটনা নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া ছিল সংস্থার মালিক এবং পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের, যাঁর সাদা ধুতি পরিহিত চেহারা দেখে অভ্যস্ত রাজ্যের মানুষ, যিনি কলকাতার ‘বাবু’ এবং বাংলার কল্পিত নবজাগরণের অন্যতম মুখ!
আনন্দবাজার পত্রিকার জেলা ডেস্কেই এই মহিলা সাংবাদিকের হেনস্থার ঘটনার সূত্রপাত। জেলা ডেস্কের তদানীন্তন প্রধান সঞ্জয় শিকদার নানা অছিলায় মেয়েটির কাঁধে, গায়ে হাত দেয়, তাঁর স্যানিটারি প্যাড, পোশাক, অন্তর্বাস, যৌন জীবন নিয়ে আলোচনা করে এবং শেষ পর্যন্ত এই অভিযোগ গিয়ে পৌঁছোয় ‘বাবু’র চেম্বারে, যা প্রতিপন্ন হয় চূড়ান্ত এক সামন্ততান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আঁতুড়ঘরে।
একদিন মেয়েটির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, সে জেলা ডেস্কের প্রধানের বিরুদ্ধে এই লাগাতার যৌন হেনস্থা এবং অভব্য আচরণ নিয়ে অভিযোগ জানায় পত্রিকার নিউজ এডিটার হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় মেয়েটিকে পরামর্শ দেন, সঞ্জয় শিকদারের বিরুদ্ধে অফিসে সদ্য গঠিত সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলে অভিযোগ জানাতে। যদিও তিনি ভালোই জানতেন, এই সেলের মাথায় রয়েছেন সংস্থার এইচ আর ডিপার্টমেন্টের প্রধান শিউলি বিশ্বাস, যাঁর সঙ্গে অভিযুক্ত সঞ্জয় শিকদারের খুবই ভালো সম্পর্ক। অভিযোগ জানানোর পরই মেয়েটি ক্রমে বুঝতে পারে, সে আসলে অফিসের বিভিন্ন শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তির পেশাগত রাজনীতির শিকার হতে চলেছে। কারণ, সঞ্জয় শিকদার তারপরও একই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং তাঁর বিরোধী শিবিরের বলে পরিচিত হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলা সাংবাদিককে অভিযোগ জানাতে বলেন আসলে নিজের পেশাগত শত্রুতার জন্য। মেয়েটিকে সুরাহা দিতে নয়। এরপর সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলের কিছু লোক দেখানো মিটিং হয়, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না। বরং মেয়েটির কাছে অফিসের পরিস্থিতি আরও অসহনীয় হয়ে ওঠে।
এরপর একদিন হঠাৎই বাবুর ঘর থেকে ডাক আসে মহিলা সাংবাদিকের। সেটিই ওই ব্যক্তির সঙ্গে তার প্রথম এবং অবশ্যই শেষ সাক্ষাত। নিউজ এডিটার হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলা সাংবাদিককে নিয়ে বাবুর ঘরে যান। ঘরে তখন তিনজন। বাবু, হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিযোগকারী মেয়েটি। দৃঢ়, অবিচলিত গলায় কথা শুরু করেন বাবু। তাঁর প্রথম প্রশ্ন, ‘তুমি কেন অভিযোগ জানিয়েছ?’

মহিলা সাংবাদিকঃ হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে অভিযোগ জানাতে বলেছেন।

বাবুঃ হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ জানাতে বলার কে? উনি কেউ নন। উনি কী বললেন তাতে কী এসে যায়?

মহিলা সাংবাদিকঃ স্যর, উনি আমাদের নিউজ এডিটার। তাঁকে আমি আমার অভিজ্ঞতা জানিয়েছিলাম, তিনি আমাকে অভিযোগ জানাতে বলেন।

বাবুঃ মানে? তোমার নিজের কোনও বোধবুদ্ধি নেই? তুমি ওঁর কথা কেন ফলো করছ?

মহিলা সাংবাদিকঃ স্যর, আমার সঙ্গে যে আচরণ হচ্ছে তা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই আমি ওনার পরামর্শ মতো অভিযোগ জানানো উচিত বলেই মনে করেছিলাম।

বাবুঃ সত্যি?

মহিলা সাংবাদিকঃ হ্যাঁ, স্যর…

বাবুঃ কিন্তু আমি শুনেছি, তোমার কাছে এই অভিযোগের কোনও প্রমাণ নেই।

মহিলা সাংবাদিকঃ স্যর, যৌন হেনস্থার কী প্রমাণ থাকতে পারে?

বাবুঃ (সামান্য হেসে), তবে তুমি কীভাবে এই অভিযোগের বিচার বা সমাধান পাবে আশা করতে পারো?

মহিলা সাংবাদিকঃ (বিস্ময় এবং কান্না চেপে), তবে এই সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল কেন রয়েছে স্যর?

বাবুঃ কারণ, এটা এখনকার দিনে কর্পোরেট বাধ্যবাধকতা। ঠিক যেভাবে আমাদের দেশে ইউজলেস বিচার ব্যবস্থা আছে, সেরকম। আমাদের আইন আছে, আইনজীবী আছে, বিচারক আছে, কিন্তু কতজন মানুষ বিচার পায়? কর্পোরেট সংস্থায় সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলও অনেকটা তাই। আজকের কর্পোরেট দুনিয়ার এটাই নিয়ম, তাই এই সেল করা হয়েছে, মাই ডিয়ার।

এই কথাপকথনের সময় হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, একবারও তাকাননি মহিলা সাংবাদিকের দিকে। বাবুর কথা শুনে মেয়েটির তখন বিধ্বস্ত অবস্থা।

বাবুঃ যদি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে মারপিট হয়, বাবা তোমাকে চড় মারে, তুমি কি থানায় যাও অভিযোগ জানাতে? নিজেদের মধ্যে ঝামেলা তো মিটিয়ে নাও। তবে এখানে অভিযোগ জানাতে গেলে কেন? এটা কি তোমার পরিবার নয়? অভিযোগ তুলে নাও। এবং তাড়াতাড়ি। লিখে দাও, ভুল বোঝাবুঝি একটা হয়ে গিয়েছিল এবং তুমি তা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও না। চাইলে আমি তোমাকে অন্য ডিপার্টমেন্টে বদলি করতে পারি।

মহিলা সাংবাদিকঃ স্যর, আমি যদি অভিযোগ না তুলে নিই। আমি আমার কাজকে খুব ভালোবাসি, আর এই ডিপার্টমেন্টেই আমার সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে চাই।

বাবুঃ তবে তদন্ত চলবে। এবং তদন্তে তুমি একজন মিথ্যেবাদী বলে প্রমাণিত হবে। তখন অভিযোগ জানানো ভুল হয়েছিল বলে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখতে বাধ্য থাকবে তুমি। সেটা কি তোমার পক্ষে সম্মানজনক সমাধান হবে?

এভাবেই সেই মহিলা সাংবাদিকের পিঠ সেদিন দেওয়ালে ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর কাছে সেদিন বিকল্প কোনও উপায়ও ছিল না। মনে মনে ইস্তফা পত্র তৈরিই রেখেছিল সে। সে তখন বাবুকে বলে, ‘সরি স্যর, আমি অভিযোগ তুলবো না, এবং তার কী তদন্ত করবেন তা জানার জন্য অপেক্ষাও করব না।

মহিলা সাংবাদিক তখন দ্রত তার সিটে ফিরে যায়। নিজের পদত্যাগ পত্র টাইপ করে এবং নিউজ এডিটার, এইচ আর হেড এবং ব্যরো চিফকে জমা দেয়। আর এই কাজ করতে করতেই সে শুনতে পায়, হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় নিউজ রুমে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন লোককে বলছেন, ‘বাবু কত ভালোভাবে ওকে বোঝাতে চাইলেন, সমাধান করতে চাইলেন ওর সমস্যা, আর কী সাংঘাতিক অসভ্য মেয়ে, কী অভদ্র ব্যবহারটাই না করল অত বড় মানুষটার সঙ্গে।’
মেয়েটির পদত্যাগের খবর ততক্ষণে পুরো নিউজ রুমে ছড়িয়ে পড়েছে। তার অধিকাংশ সহকর্মী, যাঁদের সে অসম্ভব ভালোবাসত, তাঁরা তার টেবিলের কাছে এসে বলে, ‘তুই যাবি না, তোকে যেতে দেব না এভাবে’। তারা মেয়েটিকে জোর করে পদত্যাগ পত্র তুলে নেওয়ার জন্য। তাকে পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহারের চিঠি লিখতে বাধ্য করে এবং সেই চিঠি নিয়ে এইচ আর ডিপার্টমেন্টে দৌড়োয়। কিন্তু তাঁদের এইচ আর ডিপার্টমেন্ট থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, মহিলা সাংবাদিকের ইস্তফা পত্র ইতিমধ্যেই গৃহিত হয়েছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন নিরাপত্তা রক্ষী মেয়েটির কাছে যায় এবং তার আইডেনটিটি কার্ড নিয়ে নেয়। বাবুর সঙ্গে মিটিংয়ের ৪০ মিনিটের মধ্যে মহিলা সাংবাদিক অফিসের প্রাক্তন কর্মীতে পরিণত হন। মুহূর্তের মধ্যে তার এমপ্লয়ী অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে সে তার অভিযোগের প্রিন্ট আউট, ইস্তফা পত্র, এমনকী পে স্লিপ পর্যন্ত নিতে না পারে।
ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন নিয়ে মেয়েটি বেরিয়ে যায় সাদা বাড়িটি থেকে, যে বাড়িকে তার বন্ধুরা মজা করে বলতো তাজমহল! যেখানে কবরস্থ হয়ে থাকে তার সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন, পেশায় বড় হওয়ার আশা-আকাঙ্খা। যে বাড়ি ক্ষমতা আর দম্ভের এক মূর্তমান প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে প্রতিদিন মহিলাদের গিলোটিনে চাপানো হয় আর বন্ধ করে রাখা হয় তাঁদের প্রতিবাদের সমস্ত রাস্তা।

[আমরা প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য আনন্দবাজার গোষ্ঠীর এইচ আর বিভাগের প্রধান সুমন ব্যানার্জিকে লিখেছি। যখনই তিনি প্রতিক্রিয়া দেবেন, আমরা তা প্রকাশ করব। আমরা হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও লিখেছি। তিনিও প্রতিক্রিয়া দিলে তা প্রকাশ করা হবে।
আমরা সঞ্জয় শিকদারকেও মেসেজ করেছি, তিনি কোনও জবাব দেননি।
আমরা হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথাও বলেছি। তিনি প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য সময় চেয়েছেন। তা পেলেই আমরা এই খবর আপডেট করব।]

Comments are closed.