২ মে, যে ক’জন বাঙালিকে নিয়ে আমাদের গর্ব চিরকালীন, তাঁদের অন্যতম সত্যজিৎ রায়ের ৯৯ তম জন্মদিন।
১৯২১ সালে ২ মে এই সৃষ্টিশীল মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন। আমৃত্যু বাঙালির দুরন্তপনা স্বপ্নের কারিগর তিনি। অঙ্কনশিল্পী থেকে সাহিত্যিক থেকে চলচ্চিত্রকার থেকে কাহিনীকার, সঙ্গীত পরিচালক, লিপিকলাবিদ, শিল্পের সমস্ত শাখাপ্রশাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ।
তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও পরিচিতি চিত্র পরিচালক হিসেবে। ১৯৫৫ সালে প্রথম ছবি পথের পাঁচালী থেকে শেষ ছবি আগন্তুক, প্রায় তিন দশক ধরে মোট ৩৬টি ছবি পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ রায়। এর মধ্যে ২৯টি ছিল কাহিনী চিত্র, পাঁচটি তথ্যচিত্র ও দু’টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি।
সত্যজিৎ রায়ের চিত্র পরিচালক সত্ত্বাকে যদি সরিয়ে রাখা যায়, শুধুমাত্র লেখক-সাহিত্যিক হিসেবেই কি তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য স্থান অধিকার করেন না? যদিও চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক, চিত্রনাট্যকার, গ্রাফিক শিল্পী এবং সঙ্গীত-সুরকার সত্যজিৎ রায় গোল্ডেন লায়ন, গোল্ডেন বিয়ার, সিলভার বিয়ার, অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা অস্কার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে সম্মান পেয়েছেন তা চলচ্চিত্রের জন্যই।
লেখক ও সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায় (Writer Satyajit Ray)

বাঙালির অতি প্রিয় গোয়েন্দা ফেলুদা থেকে বৈজ্ঞানিক প্রফেসর শঙ্কু কিংবা চিরকুমার ও মজলিশি তারিনীখুড়ো, প্রতিটি চরিত্রের একটি কমন জিনিস যদি ধরা যায় তা হল সততা, নির্লোভ ও আর অনুসন্ধিৎসু মনন। সত্যজিতের লেখার ছত্রে ছত্রে থাকে সাধারণ জ্ঞান, ইতিহাস থেকে বিজ্ঞানের সহজপাঠ। খুব সহজ সরল ভাষায় যিনি পাঠককে বুঝিয়ে গিয়েছেন বড় বড় দর্শন।
সত্যজিৎ সৃষ্ট আইকনিক ‘Feluda’ সিরিজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সিরিজ বলা চলে নির্দ্ধিধায়। ১৯৬৫ সালে এই সিরিজের প্রথম গল্প পত্রিকায় প্রকাশ হতেই তা পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ফেলুদা সিরিজের মোট ৩৫ টি সম্পূর্ণ ও চারটি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সিরিজের সমস্ত গল্পে ফেলুদাকে দেখা যায় বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বা মগজাস্ত্রের উপর ভর করে জটিল থেকে জটিলতর রহস্যের জট খুলে দিতে। শুধু কলকাতার মধ্যে নয়, রাজ্যের গন্ডি পেরিয়ে, আবার কখনও দেশের সীমানা পেরিয়ে আবার কখনও অজ পাড়া গাঁয়ে। কলকাতাবাসী শখের গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা তাঁর দুই সঙ্গী তোপসে ও লালমোহন গাঙ্গুলি বা জটায়ুকে নিয়ে যাবতীয় রহস্য সাফ করে যান, সেই চারমিনার হাতে চিন্তাশীল ফেলুদা’তে আজও মজে বাঙালি। ছোটবেলায় পড়া আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসে প্রভাবিত হয়েই Feluda চরিত্রের সৃষ্টি সত্যজিতের। তাই ফেলুদা সিরিজের বিভিন্ন চরিত্রের সাথে অনেক জায়গায় আমরা শার্লক হোম সিরিজের কিছু চরিত্রের মিল দেখতে পাই। সৃষ্টির এতবছর কেটে গিয়েছে, ফেলুদা আজও পাঠকের কাছে সমান সমাদৃত।
আবার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, নির্লোভ, সৎ একজন মানুষ, জীবনের কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি সেই প্রোফেসর শঙ্কু চরিত্রের মাধ্যমে সত্যজিৎ নিত্য নতুন অভিযানের মাধ্যমে পাঠকের সামনে খুলে দেন কল্পবিজ্ঞানের (science fiction) এক অবাধ জগৎ। যত বিখ্যাতই হও না কেন সততা, নির্লোভ মনন যে মানুষের আসল গুণ, ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর মাধ্যমে সেই বার্তাই বারবার স্মরণ করিয়ে যান writer Satyajit Ray. শঙ্কুকে নিয়ে লেখা মোট ৩৮ টি সম্পূর্ণ ও ২ টি অসম্পূর্ণ গল্পে প্রোফেসর বের হন নতুন নতুন অভিযানে। যিনি অদ্ভুত কিছু আবিষ্কার করেন। গিরিডির বাসিন্দা ও স্কটিশচার্চ কলেজের প্রাক্তনী শঙ্কু পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের সকল শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি ৬৯ টি ভাষা জানেন, হায়ারোগ্লিফিক লিপি অবধি পড়তে পারেন। বিশ্বের প্রায় সব দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি ও বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে যাঁর অঢেল জ্ঞান। আবার ভারতের সনাতন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শঙ্কু একইসঙ্গে শ্রদ্ধা করেন সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সাহিত্য ও শিল্পকর্মকে। প্রফেসর শঙ্কু গল্পেরও পটভূমি ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। তাঁর অভিযান কলকাতার বিভিন্ন স্থান থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, মিশর, জার্মানি, জাপান, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন, তিব্বত, সাহারা মরুভূমি থেকে সমুদ্রের তলদেশ, অজানা দ্বীপ ছুঁয়ে যায়। পুরো সিরিজ জুড়ে প্রোফেসরের মোট ৭২ টি আবিষ্কার সম্পর্কে জানা যায়।
তেমনি ষাট পেরোনো তারিণী খুড়ো। যুবক বয়স থেকে নানা ধরনের চাকরি করতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প শোনান তারিণী খুড়ো শোনান বাচ্চাদের। সেখানে আবার writer Satyajit Ray পাঠকের কাছে উজাড় করে দেন ভূতের ও হাসির গল্পের ঝুলি। যার অধিকাংশ গল্পে দেখা যায় উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কীভাবে একের পর আসন্ন বিপদকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন তারিণী খুড়ো। সেখানেও মূল চরিত্র জীবনে অনেক রোজগার করলেও কখনও টাকার পিছনে ছোটেননি। কাজের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগলে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন স্থানে, নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন অন্যভাবে।
Satyajit Ray Books
তিনি এই তিনটি চরিত্র ছড়াও বহু ছোট উপন্যাস ও ছোট গল্প রচনা করেছেন। সত্যজিতের লেখার মূল লক্ষ্য ছিল কিশোর তরুণ পাঠক বর্গ, যদিও তিনি আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে বড্ড প্রিয়। সাহিত্যিক হিসেবে এরচেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে!
আবার মোল্লা নাসিরুদ্দিন মধ্যপ্রাচ্যের সিরিজ হলেও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাকে বাংলা পাঠকমহলের কাছে পরিচিতি দেওয়ার ভার নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। হাস্যরসাত্মক চরিত্র হিসেবে পরিচিত মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে দেখা যায় একদিকে একজন প্রাজ্ঞ মানুষ ও দার্শনিক হিসেবে। আবার কোনও গল্পে তিনি হদ্দ বোকা। তাঁর কথাবার্তা যেমন হাসায় তেমনি ভাবায়ও। সত্যজিৎ রায়ের মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সিরিজও অন্য সব সিরিজের মতোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ছোটগল্প, উপন্যাস বাদ দিলে কবি সত্যজিৎ কিন্তু সত্যিই ‘আন্ডাররেটেড’। তিনি বেশ কিছু বিদেশি কবিতা অনুবাদ করেছেন। লিমেরিক (Limerick) রচনা করেছেন। যার সংকলন ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে সুকুমার পুত্রের লেখায় অনেকটা বাবার ছায়া দেখতে পান অনেকে। যখন তিনি লেখেন,
‘এক যে সাহেব তার যে ছিল নাক
দেখলে পরে লাগত লোকের তাক
হাঁচতে গিয়ে হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ
নাকের মধ্যে লাগল প্যাঁচ
সাহেব বলে, ‘এইভাবেতেই থাক।’…
তাই চিত্র পরিচালনা তো বটেই, এই সত্ত্বা সরিয়ে রাখলেও শুধু সাহিত্য রচনা দিয়েও শিল্প সাহিত্যে writer Satyajit Ray -এর ভূমিকা এতটুকুও কম নয়। তাই জন্মদিনে ফিরে দেখা তাঁর অমর সাহিত্য সৃষ্টির ভাণ্ডার।