আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার পর নিজের ভোট ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ সিপিএমের, বিরোধী ভোট ভাগের সুবিধে পাবে তৃণমূল

২০১৮ সালের ৫ থেকে ৮ ই মার্চ, সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন কলকাতায়। সম্মেলনে পেশ করা সাংগঠনিক রিপোর্টে ‘বিধানসভা নির্বাচন ও পরবর্তী পরিস্থিতি’ অধ্যায়ে সূর্যকান্ত মিশ্র লিখলেন, ‘…তবে এটা ঘটনা যে আমাদের প্রচেষ্টা তৃণমূল কংগ্রেসকে সঙ্গী পেতে দেয়নি। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিজেপি তার শক্তিবৃদ্ধি ঘটানো এমনকী রাজ্যে দ্বিতীয় শক্তি ও তার কাছাকাছি শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেছিল। তা সফল হয়নি। লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপির প্রায় ৭ শতাংশ ভোট হ্রাস পায়’। ‘আমাদের প্রচেষ্টা’ বলতে সূর্যকান্ত মিশ্র বুঝিয়েছিলেন, ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের আসন সমঝোতাকে।
আসলে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পরই দ্রুত বদল হতে থাকে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির। ২০১৪ লোকসভায় বিজেপি রাজ্যে ব্যাপক শক্তিবৃদ্ধি করলে চিন্তিত হয়ে পড়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, যেখান থেকে রাজ্যে আসন সমঝোতার ভাবনা। ২০১৬ সালে বিজেপি রাজ্যে মাত্র ৩ টি আসন জিতলেও, পরিস্থিতি মোটেও অনুকুল ছিল না বামপন্থীদের পক্ষে। তার প্রমাণ মিলতে শুরু করল বিধানসভা ভোটের পর থেকেই। ২০১৬ বিধানসভা ভোটের পর থেকে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ৩ টি লোকসভা কেন্দ্র (কোচবিহার, তমলুক এবং উলুবেড়িয়া) এবং ৫ টি বিধানসভা আসনে (মন্তেশ্বর, কাঁথি দক্ষিণ, সবং, নোয়াপাড়া এবং মহেশতলা) উপনির্বাচন হয়। তাতে প্রথম স্থানের কোনও বদল না হলেও, দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি এবং একাধিক আসনে জামানত জব্দ হয় বাম প্রার্থীদের, যা পুরোপুরি বদলে দেয় বাংলার রাজনৈতিক ভারসাম্য।
২০১৬ সালের শেষে ভোট হয় তমলুক, কোচবিহার এবং মন্তেশ্বর কেন্দ্রে। তিন কেন্দ্রেই বিপুল ভোটে জেতে তৃণমূল। তমলুকে বামেরা কিছুটা মুখরক্ষা করলেও (সিপিএম পেয়েছিল ২ লক্ষ ৮২ হাজার ৬৬ ভোট, বিজেপি ১ লক্ষ ৯৬ হাজার ৪৫০ ভোট), কোচবিহার লোকসভায় বিজেপি ৩ লক্ষ ৮১ হাজার ১৩৪ এবং ফরওয়ার্ড ব্লক মাত্র ৩৩ হাজার ৪৭০ ভোট পায়।
অধিকারীদের ক্ষমতার এপিসেন্টার কাঁথি দক্ষিণে ২০১৭ সালে দ্বিতীয় স্থান দখল করে বিজেপি পায় ৫২ হাজার ৮৪৩ ভোট, বামেরা পায় ১৭ হাজার ৪২৩ ভোট।
সবংয়ে অবশ্য বামেরা সামান্য বেশি ভোট পায় বিজেপির তুলনায় (বাম ৪১ হাজার ৯৮৯ এবং বিজেপি ৩৭ হাজার ৪৮৩ ভোট)।
২০১৮ তে উলুবেড়িয়া কেন্দ্রের লোকসভায় কার্যত ভরাডুবি হয় সিপিএমের। বিজেপি যেখানে পায় ২ লক্ষ ৯৩ হাজার ৪৬ ভোট, সিপিএম পায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৮৯২ ভোট। নোয়াপাড়া এবং মহেশতলা বিধানসভাতেও দু’নম্বরে উঠে আসে বিজেপি।
প্রতিটি উপনির্বাচনের ফল থেকেই স্পষ্ট, নিজের শক্তি অক্ষুন্ন রাখে তৃণমূল। কিন্তু বামেদের ভোটের একটা বড় অংশ চলে যায় বিজেপির দিকে। আর বিরোধী ভোট দু’জায়গায় ভাগ হয়ে গেলে যা হয়, তারই ষোল আনা সুবিধে পায় তৃণমূল। নিজের ভোট ধরে রেখেও জয়ের মার্জিন অনেকটা বেড়ে যায় তৃণমূলের।
২০১৪ সালের পর ফের একটা চতুর্মুখী লড়াইয়ের সামনে বাংলা। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে আজ নিজের ভোট ধরে রাখাই যেখানে সিপিএমের একমাত্র চ্যালেঞ্জ, সেখানে রাজ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী সমস্ত বাম-কংগ্রেস ভোটকে নিজের বাক্সে আনতে মরিয়া বিজেপি। এ এক বিচিত্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি রাজ্যে। উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, যে তিন জেলায় কংগ্রেস শক্তিশালী, সেখানে বামদের সঙ্গে তাদের আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়া পাটিগণিতের অঙ্কে সরাসরি সুবিধে দেবে তৃণমূলকে। উল্টোদিকে, দক্ষিণবঙ্গজুড়ে যে সব আসনে কংগ্রেসের কার্যত দেড়-দু’শতাংশের বেশি ভোট নেই, অথচ এক সময় বামেদের শক্ত ঘাঁটি ছিল, সেখানে এই আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার ডিভিডেন্ড পাবে বিজেপি। আর তাই দক্ষিণবঙ্গের এমন প্রায় ১০ টি আসনে (আসানসোল, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, বনগাঁ, বসিরহাট, দমদম, কলকাতা দক্ষিণ) চমকে দেওয়ার মতো উত্থান হতে চলেছে বিজেপির।
কিন্তু লোকসভার মত বিরাট এলাকায় শুধুমাত্র চমকপ্রদ উত্থানই আসন জেতার জন্য যথেষ্ট নয়। দরকার আরও কিছু ফ্যাক্টরের। তাও যথেষ্টই বুঝতে পারছেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু নিজের সংগঠন বৃদ্ধির ওপর যত না ভরসা করছে গেরুয়া শিবির, তার চেয়ে তাদের বেশি ভরসা সিপিএমের ভোটের ওপর। সিপিএমের যে অংশটা মনে করছেন, তাঁদের দল আর পারবে, তৃণমূলকে ঠেকাতে হবে বিজেপিকে দিয়েই, তাঁরাই আজ গেরুয়া শিবিরের মূল শক্তি দক্ষিণবঙ্গজুড়ে।
তৃণমূল রাজ্যে সরকার গড়ার বছর দু’য়েক পর বাম নেতৃত্বকে নিয়ে বিমান বসু নবান্নে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিমান বসুকে প্রশ্ন করেন, আপনারা নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারছেন না কেন? আপনাদের ভোট কেন বিজেপিতে চলে যাচ্ছে?
আজ লোকসভা ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সূর্যকান্ত মিশ্রর সামনে, যার উত্তর তিনি বের করেছিলেন ২০১৬ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে। কিন্তু আজ আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার পর, শুধু নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নয়, রাজ্যে বিজেপির উত্থান ঠেকাতেও বামেদের ভোট সিপিএমের পাওয়া জরুরি।

(নজর রাখুন আগামী পর্বে)

Comments are closed.