গত ১৪ ই ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় ৪৪ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু, পুলওয়ামা উত্তর পরিস্থিতি ও পাক ভূখণ্ডে ভারতের এয়ার স্ট্রাইক সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশনা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তীব্র সমালোচনা করল মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট। পুলওয়ামা উত্তর পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ পরিবেশনকে আতস কাঁচের নীচে রেখে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত এই মার্কিন দৈনিকে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে সরাসরি বলা হয়েছে, পুলওয়ামা পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে, তারা বিজেপির প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজ করছে।
প্রতিবেদনটির শুরুতেই লেখা হয়েছে, ১৪ ই ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হানার দায় নেয় পাক জঙ্গি সংগঠন জৈশ-ই-মহম্মদ। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত দাবি করে, ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বিমান বাহিনী পাক ভূখণ্ডে ঢুকে বালাকোট সহ একাধিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে একাধিক জঙ্গি ঘাঁটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেদিনই দুপুরে ভারতের বিদেশ সচিব বিজয় গোখলে সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করেন, হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে বালাকোটে জৈশ-ই-মহম্মদের সব থেকে বড় জঙ্গি ক্যাম্প এবং এই হামলায় মৃত্যু হয়েছে বহু জঙ্গির। কিন্তু সরকারের তরফে সেদিন কোনও মৃতের সংখ্যা জানানো হয়নি।
এরপরই ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদনে ভারতীয় মিডিয়াকে কটাক্ষ করে লেখা হয়েছে, সরকারি তরফে মৃতের সংখ্যা সঠিকভাবে জানা না গেলেও ভারতীয় মিডিয়া দাবি করে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। যদিও, ভারতীয় মিডিয়ার এই দাবিকে স্বীকার করেনি পাকিস্তান। তারা বলেছে, এই হামলা হয়েছে প্রায় জনবসতিহীন ফাঁকা এলাকায়। যেখানে বোমাবর্ষণে কয়েকটি গাছপালার ক্ষতি ছাড়া কেউ হতাহত হননি। উল্লেখ্য, আগেই ভারতের বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রশ্ন তুলেছিল এবং সোশ্যাল মিডিয়াতেও আলোচনা হয়েছে, যেখানে সরকারের তরফে ভারতের এয়ার স্ট্রাইকে হতাহতের সঠিক সংখ্যা কত তা জানানো সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন জঙ্গির মৃত্যুর খবর এলো কোথা থেকে? কোন সূত্রে এই খবর পাওয়া গেল! ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, মিডিয়ার এই ধরনের সংবাদ পরিবেশন আসলে ভুল তথ্য প্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজ করে মানুষের মধ্যে।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, পুলওয়ামা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ পরিবেশন নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট একটি অন্তর্তদন্ত করে। তাতে জানা গেছে, পরিবেশিত তথ্যের অধিকাংশই পক্ষপাতদুষ্ট এবং পরস্পরবিরোধী। সংবাদসংস্থা এএনআই থেকে শুরু করে এনডি টিভি, ইন্ডিয়া টুডে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ফার্স্ট পোস্টের মতো সংবাদমাধ্যমের নাম করে বলা হয়েছে, এরা সরকারি সূত্র, ফরেনসিক এক্সপার্ট, পুলিশ সূত্রের নাম দিয়ে একের পর এক তথ্য পরিবেশন করে গেছে যাচাই না করেই। অথচ পুলওয়ামা কাণ্ডে গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে কোনও উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়নি মিডিয়ার তরফে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রচার ও সংশয়ের জন্য সরকার দায়ী। কারণ, এত বড় ঘটনা এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরাসরি এই বিষয়ে কিছু জানাননি দেশকে। বিদেশ সচিব এবং বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের তরফে যে সাংবাদিক বৈঠক করা হয়েছিল ২৬ তারিখ, সেখানেও সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার কোন সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে বিভ্রান্তি ছড়ায়।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ভারত এবং পাকিস্তানের মতো দুটি প্রতিবেশী দেশ যখন প্রায় জরুরি পরিস্থিতির সম্মুখীন, উত্তেজনার বাতাবরণ চারিদিকে, গোটা বিশ্বের নজর দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের উপর, তখন এই ধরনের পরস্পরবিরোধী তথ্য যাচাই না করে কীভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় মিডিয়া রিপোর্টকে কাটাছেঁড়া করে তারা বুঝতে পেরেছে, পুলওয়ামা কাণ্ড ও তার পরবর্তী ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে খুব কম তথ্যই পৌঁছেছে মানুষের কাছে। একই তথ্য ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরিবেশন করেছে ভারতীয় মিডিয়া। শুধু ভারতের এয়ার স্ট্রাইকে কত জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ই নয়, এমনকী পুলওয়ামা হামলায় কত বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল সেই বিষয়টি নিয়েও পরস্পরবিরোধী এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। কোনও মিডিয়ায় দাবি করা হয়েছে, ২৫ কিলো বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল, কোথাও দাবি করা হয়েছে বিস্ফোরকের পরিমাণ ছিল ৩৫০ কেজি।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এ বলা হয়েছে, এই সংবাদগুলি পরিবেশনের প্রায় দু’সপ্তাহ পরও বিভ্রান্তিকর এবং পরস্পরবিরোধী এই সব তথ্য থেকে গিয়েছে পাবলিক ডোমেইনে। মিডিয়াগুলির তরফে তা সরানো হয়নি।
ভারত-পাক উত্তেজনার মুহূর্তে যেভাবে ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে স্টুডিওকে ওয়ার জোনের মতো সাজিয়ে তোলা হয়েছিল, সাংবাদিকরা সেনা পোশাক পরে সংবাদ পরিবেশন করেছিলেন, তারও সমালোচনা করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যখন দুটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র যুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে, তখন এই ধরনের যুদ্ধের জিগির তুলে কেন সংবাদ পরিবেশন করা হল?
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ভারতীয় মিডিয়া হাউজগুলির মাথায় রয়েছেন মূলত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘনিষ্ঠ মালিকরা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রচার করে থাকে এবং ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এমন অনেক সাংবাদিককে বিভিন্ন সংবাদপত্র, চ্যানেল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে যাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন।
প্রতিবেদনের একদম শেষে বলা হয়েছে, ভারতীয় গণমাধ্যমগুলিতে সাংবাদিকতা না করে যেভাবে হিন্দু ভাবাদর্শের প্রচার করা হচ্ছে তা খুবই উদ্বেগজনক।
Comments are closed.