আর কয়েকটা ঘন্টা। তার পরেই নতুন বছর। শহর জুড়ে উৎসব। তবে ছুটির দিনে অনেকেই নতুন বছর একটু অন্যরকম কাটাতে চান। ভিড়ের ভয়ে পার্কস্ট্রিট, ভিক্টরিয়া বা চিড়িয়াখানা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু বাড়িতে থাকতেও ইচ্ছে করে না। তাহলে আপনার গন্তব্য হতে পারে হুগলি জেলা। “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু প্রকৃতি”-রবি ঠাকুর এই কবিতার মতোই আপনার ‘ঘরের’ কাছেই রয়েছে এমন কিছু স্থান, যা হয়তো আপনার এখনও ঘুরে দেখা হয়নি। প্রকৃতি, ইতিহাস, প্রাচীন স্থাপত্য। সব কিছুই মিলতে পারে একদিনের ভ্রমণে। আমাদের প্রতিবেদনে সেই হদিসই রইল আপনার জন্য।
এক্কেবারে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ুন। তারপর ঝটপট তৈরি হয়ে পৌঁছে যান হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে ব্যান্ডেল যাচ্ছে এরকম যেকোনও লোকাল ট্রেনে উঠে পড়ুন। ট্রেন সফরের সময়টুকু একটু ভিড় পাবেন বটে। তবে লোকাল ট্রেনে বিক্রি হওয়া লোভনীয় খাওয়ার-দাওয়ারের স্বাদ নিতে নিতে ভিড়ের বিরক্তি ভুলে পৌঁছে যান ব্যান্ডেল। স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখবেন অটো স্ট্যান্ড। সেখানে দরদাম করে একটি অটো বুক করে নিন। তারপর ভাবছেন ব্যান্ডেল চার্চ যাবেন? না ওটা তালিকার শেষের দিকে রাখুন।
অটো করে প্রথমেই পৌঁছে যান হুগলির দেবানন্দপুর। কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থান এই দেবানন্দপুর। ওখানে একটি ছোট্ট সংগ্রহশালা রয়েছে। সেটি ঘুরে দেখুন। এছাড়াও সাহিত্যিকের শৈশবের নানান স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা গ্রাম জুড়ে। সে সঙ্গে মজে যাওয়া স্বরসতী নদী।
কথাসাহিত্যিকের স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম ঘুরে চলে আসুন বাঁশবেড়িয়া। বাঁশবেড়িয়া বিখ্যাত হংসেশ্বরী মন্দিরের জন্য। রাজা নৃসিংহদেব ১৭৯৯ সালে হংসেশ্বরী মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। রাজার মৃত্যু হলে তাঁর স্ত্রী রানী ১৮১৪ সালে মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন। মন্দিরটিতে তেরোটি রত্ন বা মিনার যা প্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায় দেখতে। এ ধরণের স্থাপত্য রীতি পশ্চিমবঙ্গের আর অন্য কোনও মন্দিরে দেখা যায়না।
হংসেশ্বরী মন্দিরের পাশেই রয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো অনন্ত বাসুদেবের মন্দির। বাঁশবেড়িয়া রাজবংশেরই পূর্বপুরুষ রাজা রামেশ্বর দত্ত ১৬৭৯ সালে অনন্ত বাসুদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি তার দেওয়ালের টেরাকোটার কাজের জন্য বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটায় রামায়ণ, মহাভারত এবং কৃষ্ণলীলার ছবি খোদাই করা রয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন দুটি মন্দিরই ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত। এছাড়াও মন্দির চত্বরের উল্টো দিকেই রয়েছে বাঁশবেড়িয়া রাজবাড়ী। রাজবাড়ীর বর্তমান সদস্যরা এখনও এই বাড়িতে থাকেন। তাই প্রবেশের অনুমতি নেই। তবে বাইরে থেকে একবার চাক্ষুস দেখতে পারেন বাংলার ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রাজবাড়ী টিকে।
বাঁশবেড়িয়া ঘোরা হয়ে গেলেই চলে আসুন ব্যান্ডেল চার্চ। পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম এই গির্জাটি ঘুরে দেখুন। ইতিহাস বলছে, ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পূর্তিগীজরা ব্যান্ডেলকে বন্দর হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। এরপর ১৫৯৯ সালে সেখানে চার্চ নির্মিত হয়। যদিও বর্তমান ব্যান্ডেল চার্চ এটি নয়। মাঝে ১৬৩২ সালে মুরেরা হুগলি আক্রমণের সময় প্ৰথম চার্চটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর ১৬৬০ সালে বর্তমান চার্চটি নির্মিত হয়। ব্যান্ডেল চার্চ ঘুরে আশেপাশের হোটেল থেকেই দুপুরের খাওয়ার সেরে নিতে পারেন। পরের গন্তব্য হুগলি ইমামবাড়া।
১৮৪১ সালে মহম্মদ মহসীন ইমামবাড়ার নির্মাণকাজ শুরু করেন। এবং ১৮৬১ সালে প্রাচীন এই ইমামবাড়ার নির্মাণকাজ শেষ হয়। ইমামবাড়া বিখ্যাত তার ঘড়ির জন্য। ১৫০ ফুট উচ্চতার দুটি টাওয়ারের মাঝে রয়েছে ঘড়িটি। টাওয়ারদুটিতে চড়তে গেলে মোট ১৫২টি সিঁড়ি ভাঙতে হবে আপনাকে। সৈয়দ কেরামতি আলী ১৮৫২ সালে সুদূর লন্ডনের মেসার্স ব্যাল্ক এন্ড হুর কোম্পনি, বেগ বেন থেকে ঘড়িটি কেনেন। বিশাল এই ঘড়িটিতে দুটি কাঁটা এবং তিনটে ঘন্টা রয়েছে। সুবিশাল ঘন্টা তিনটের ওজন ৮০ মণ,৪০ মণ, ৩০ মণ। মজার বিষয়, প্রত্যেক সপ্তাহে ঘড়ির কাঁটাগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দু’জন লোকের প্রয়োজন হয়। এবং যে চাবিটি দিয়ে ঘড়িটি ‘দম’ দেওয়া হয় তার ওজন ২০ কেজি। সুউচ্চ টাওয়ারগুলির চূড়া থেকে গঙ্গার দৃশ্য-এ আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। ১৫২ টি সিঁড়ি ভেঙে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ইমামবাড়ার ঘাটে চলে যান। ঘাটে বসে শেষ বিকেলের সূর্যাস্ত দেখুন। তারপর? একরাশ ভালোলাগা নিয়ে চলে আসুন স্টেশনে। তারপর আর কী…বাড়ি।
Comments are closed.