বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানোর এক প্রাচীন উৎসব চড়ক মেলা, আজও কলকাতা সহ রাজ্যের বহু গ্রামই মেতে ওঠে এই মেলাকে কেন্দ্র করে

চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি আসত গাজন সন্ন্যাসীরা। মহিলা, পুরুষ নির্বিশেষে গেরুয়া বসন পরা, হাতে মালসা এবং ত্রিশূল নিয়ে দোরে দোরে তারা হাঁক পাড়ত, বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে, মহাদেব। বাড়ির বড়রা সাধ্যমতো তারকনাথের চরণে সেবা চড়াতেন। যে যতটুকু পারতেন, দিতেন। ওই গাজন সন্ন্যাসীরা দিনভর উপোস করে থাকত। দিনের শেষে ভিক্ষা করে যা পেত, তা খেত। একমাস ধরে চলত তাদের এই বিশেষ ভিক্ষা। আর চৈত্র সংক্রান্তিতে হত চড়ক উৎসব। এখনও বাংলার গ্রামে গঞ্জে চড়ক উৎসব হয় বেশ আড়ম্বর করে। আগে কলকাতা শহরেরও অনেক জায়গায় চড়ক উৎসব হত। এখনও উত্তর কলকাতার কিছু কিছু জায়গায় এই উৎসব এবং চড়ক উপলক্ষ্যে মেলা হয়। তবে এখন আর শহরে গাজন সন্ন্যাসীদের দেখা মেলে না। গ্রামে এখনও তাদের দেখতে পাওয়া যায়।
ফাল্গুন মাসে বসন্ত উৎসব চলে যাওয়ার পরপরই শুরু হয় বাংলা নববর্ষকে আগমন জানানোর পালা। আর এই নববর্ষকে যে সকল উৎসবের মাধ্যমে আহ্বান জানানো হয়, সেগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গাজন উৎসব। প্রাচীন বাংলার লোককথার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে এই গাজন বা চড়ক উৎসবের কাহিনী। চৈত্র মাস জুড়ে চলে এই উৎসব। আর মাসের শেষ দু’দিনে বসে চড়কের মেলা।
দেবাদিদেব মহাদেবকে উৎসর্গ করেই এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। পুরনো বছরের দুঃখ ও কষ্ট ভুলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে আগামী বছরে সুখ ও সমৃদ্ধির আশাতে মানুষ এই গাজন ও চড়ক উৎসবে সামিল হয়।
মূলত নতুন বাংলা বছরে যাতে ভালো বৃষ্টি এবং ফসল হয়, তার জন্য মহাদেবের কাছে চাষের কাজে জড়িত মানুষেরাই এই উৎসব পালন করে। বাংলার অনেক জেলাতেই গাজন বা চড়কের পূজা ও উৎসব হয়। মেলায় দেখানো হয় হরেক রকমের খেলা। কেউ শিব, দুর্গা, কালী সেজে বাড়ি বাড়ি যায়। মেলায় চলে গাজনের গান। আসর মাতিয়ে তোলেন শিল্পীরা।
উৎসব বা মেলায় যে সমস্ত খেলার প্রদর্শন করা হয়, তার মধ্যে বেশ কিছু খেলা অত্যন্ত বিপজ্জনক ও বেদনাদায়কও বটে। বলা হয়, একটি শিশুর জন্ম দেওয়ার সময় একজন মা যে প্রসব যন্ত্রণা অনুভব করেন, সেই যন্ত্রণা পেতে এই ধরনের ভয়ঙ্কর খেলায় মাতে কিছু মানুষ। তারা মনে করে, মহাদেব তাদের যন্ত্রণার উপশম করবেন।
চাষিরা মাটিতে হাল চালায়, ফসল ফলায়। ফলে মাটিকে তারা নিজের মা বলে মানে। মাটিতে হাল চালানোর, ফসল বোনার সময় মাটি যে কষ্ট পায়, তা অনুভব করতেও এই সাংঘাতিক খেলাগুলিতে মেতে ওঠে আমজনতা।
প্রথমে ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু একটি ডালপালাবিহীন গাছকে চড়ক গাছ হিসেবে পুজো করা হয়। এরপর চড়ক গাছের কাণ্ডের উপরে লাগানো হয় গোল চাকতি। ওই চাকতির চার পাশে দড়ি ধরে মানুষ ঝুলতে থাকে। এ ছাড়াও নানা ধরনের কার্যক্রম জারি থাকে এই গাছটিকে ঘিরে। এটাই চড়কের মেলার প্রধান আকর্ষণ। দেওয়া হয় শিব ঠাকুরের নামে জয়ধ্বনি। প্রচুর সাধু সন্ন্যাসীদেরও সমাগম হয় এই গাজন উৎসব ও চড়কের মেলায়। শিবের এই গাজনে মহাদেবের সঙ্গে হরকালীর বিবাহ হয় এই দিনে।
অনেকে বলেন, এই গাজন উৎসবের সঙ্গে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের পুনরায় হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। মধ্যযুগে যখন ভারতবর্ষে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বৌদ্ধ ধর্ম, সেই সময় এই দেশের বিভিন্ন স্থানে শরণার্থী হিসেবে থাকতে শুরু করেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। বাংলার কিছু জেলাতেও তাঁরা ছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁরা আবার ধর্মান্তরিত হন। তাই এই প্রত্যাবর্তনের উৎসব শিব বন্দনার উৎসবে পরিণত হলেও, বৌদ্ধ ধর্মের কিছু তান্ত্রিক প্রক্রিয়া এখনও এই উৎসবের সময় পালন হতে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন মড়ার খুলি হাতে নিয়ে নৃত্য, শরীরের ভিতরে লোহার শিক ঢোকানো, জিভের মধ্যে ধারালো ফলা ঢুকিয়ে আগুনের মধ্যে লাফানোর মতো বিপজ্জনক খেলা দেখানো হয়।
লোকমুখে শোনা যায়, এই উৎসব প্রথমে ধর্মরাজের গাজন হিসেবে পরিচিত ছিল। সেটা ছিল বৌদ্ধদের উৎসব। পরবর্তীকালে তা হয়ে উঠেছে শিবের গাজন।
এই গাজন উৎসবের আয়োজন প্রধানত গ্রামে বা মহল্লায় শিবের মন্দিরের মধ্যে কিংবা তার সামনে করা হয়। মেলা ও পুজো দেখতে দূর দূর গ্রাম থেকে বহু মানুষ আসে।
এই গাজন উৎসবের সময়েই নীল পুজোরও আয়োজন করা হয়। এই পুজোতে বিবাহিত মহিলারা সারাদিন উপোস থেকে সন্ধ্যাবেলা শিব লিঙ্গের মাথায় জল ঢালেন। অনেকের ধারণা, শিব ও পার্বতীর বিবাহের উৎসব পালন করার জন্যই এই নীল পুজোর আয়োজন করা হয়। সমুদ্র মন্থনের সময় বেরিয়ে আসা বিষ নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন মহাদেব। তাই শিবের আর এক নাম নীলকণ্ঠ। নীলের পুজো মানেও শিব পুজো।

 

Comments are closed.