‘যতদিন বেঁচে আছি, নিজের বাড়িতেই থাকতে চাই’, আর্তি বাড়িছাড়া বৃদ্ধার! করোনা নিয়ে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা মেয়ের

আমি একজন ব্যাঙ্ক কর্মচারী। এই করোনা পরিস্থিতিতে আমার মাকে নিয়ে যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হল, তা বিস্তারিত বলা প্রয়োজন।
আমার মা সোনালী দাস।  মে মাসের ১৩ তারিখ পড়ে গিয়ে তাঁর পা ভাঙে। আমরা স্থানীয় ডাক্তারবাবুকে দেখাই। ডাক্তারবাবু বলেন অপারেশন করে পায়ে প্লেট না বসালে পা ঠিক হবে না। ১৩ মে মা’কে কোথাও ভর্তি করতে পারিনি, কারণ করোনার জন্য কলকাতার বেশিরভাগ হাসপাতাল বন্ধ।
আমরা অনেক কষ্ট করে ১৪ তারিখ বাইপাসের উপর একটি বেসরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের খবর পাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়, রোগী নিয়ে যাওয়ার পর তারা করোনা সংক্রান্ত সমস্ত পরীক্ষা করবে, যদি দেখা যায় সমস্ত টেস্ট নেগেটিভ, তাহলেই ভর্তি হবে, না হলে রোগী ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেই শর্ত মেনে আমরা মা’কে নিয়ে হাসপাতালে হাজির হই বেলা ১২ টায়। আমাদের হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ২ ঘন্টা ধরে ভিডিও কনফারেন্সে রুগীর শুধু history নেওয়া হয়। আড়াই ঘণ্টা পর ওরা মা’কে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে করোনা বিষয়ক টেস্টিংয়ের জন্য নিয়ে যায়। সিটি স্ক্যান, এক্স-রে করে দেখা হয় মা’র ফুসফুসে কোনও ইনফেকশন আছে কি না। রাত ৮ টায় আমাদের জানানো হয় রোগীর সব টেস্ট নেগেটিভ। আপনারা অপারেশনের জন্য ভর্তি করতে পারেন (ততক্ষণ আমরা হাসপাতালের গেটে রোদে দাঁড়িয়েছিলাম, মা ভিতরেই ছিল)। আমরা মা’কে ভর্তি করে বাড়ি ফিরে আসি। ১৫ মে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ঠিক হয় ১৮ তারিখ মায়ের অপারেশন করা হবে।
১৬ মে বিকেলে হঠাৎ জানতে পারি মা’র করোনা ধরা পড়েছে, কিন্তু মা’র করোনার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমরা বলি এটা হতে পারে না, সুস্থ মানুষ পা ভেঙে হাসপাতাল গেল, কী করে করোনা হতে পারে? আর আমার মা’র প্রেশার, সুগার, আর যা যা আছে সব বেশি, করোনা হলে অবশ্যই ৬৫ বছরের মহিলার করোনা লক্ষণ দেখা যেত। বললাম, এটা সম্ভব নয়, আপনারা আবার টেস্ট করুন। হসপিটাল থেকে জানানো হয়, ঠিক আছে আমরা আবার টেস্ট করছি। কিন্তু যতদিন না মায়ের পর পর ২ টো রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে ততদিন সার্জারি হবে না।
১৮ মে মায়ের আবার করোনা টেস্ট হয়। রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। ২১ মে মায়ের আবার করোনা টেস্ট হয়। সেটাও নেগেটিভ। ২৩ তারিখ মায়ের পায়ের সার্জারি হয়েছে, ২ টো প্লেট বসেছে এবং মা ভালো আছেন।
এখন আমার কিছু প্রশ্ন আছে।

১. আপনারা কি জানেন ২ দিনের মধ্যে করোনামুক্ত হওয়া যায়?
২. ১৬ তারিখ যে রুগীর করোনা ধরা পড়ল ১৮ তারিখ ও ২১ তারিখ সেটা নেগেটিভ কী করে হল?
৩. হাসপাতাল বিল বাড়ানোর জন্য এই কারসাজি করেনি তো?
৪. সংবাদমাধ্যমে প্রায় প্রত্যেকদিন ত্রুটিপূর্ণ কিটের গল্প শুনছি। সেই রকম কোনও খারাপ কিট দিয়ে মায়ের প্রথম টেস্ট হয়নি তো?
৫. আমার মা ১০ দিন শুধু ব্যথার ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে পড়ে বেকার কষ্ট পেলো না তো?

এবার আসি আমাদের উপর মানসিক অত্যাচার আর সাধারণ পাড়া প্রতিবেশীর আতঙ্কের গল্পে।
১৬ তারিখ বিকেল থেকে স্বাস্থ্য ভবন, কর্পোরেশন, থানা সবাই ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে, কে কে মায়ের ডাইরেক্ট কন্ট্যাক্ট-এ এসেছেন। সন্ধের মধ্যে মিউনিসিপালিটির স্বাস্থ্য কর্মীরা আমাদের বাড়ি এসে আমাদের ১৪ দিন কোয়ারেণ্টিনে থাকতে বলে গেছেন। তাঁদের কাজ তাঁরা যথার্থই করেছেন।
কিন্তু এরপর আশেপাশের মানুষজন আমাদের দিকে এমনভাবে আমাদের বাড়ির দিকে উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করেন, যেন আমরা কাউকে খুন করে বাড়িতে লুকিয়ে আছি! আর ফোনের পর ফোন। একটা-দুটো নয়, ১০০, ২০০, ১ হাজার, অগণিত। আমার আর আমার স্বামীকে অগণিত ফোন। সবাইকে একই ঘটনা বলতে বলতে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছিল আমাদের। ফোনগুলো যে বন্ধ করে রাখব তারও উপায় নেই। মা যে হাসপাতালে! হাসপাতাল থেকে যদি হঠাৎ ফোন করে? তাই ফোন খোলা রেখে, ইচ্ছে না থাকলেও সবাইকে এক কথা এক হাজারবার পুনরাবৃত্তি করতে হল।
খালি মনে হচ্ছিল আমাদের করোনা হলো না তো? জ্বর আসছে না তো, গলা ব্যথা করছে না তো? মাঝে মাঝে ইউটিউব খুলে করোনা উপসর্গগুলো দেখছিলাম আর মেলাচ্ছিলাম, আমাদের এরকম কিছু হচ্ছে না তো?
ধন্যবাদ জানাই আমার ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে। তারা ঘটনাটা শোনার প্রায় সাথে সাথে আমাদের প্রাইভেটে টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা করে ১৮ মে সকালেই। কিন্তু টেস্টিং করতে যাব, সেখানেও সমস্যা। একটাও অ্যাম্বুলেন্স, গাড়ি, অটো যেতে রাজি নয়। যেই শুনছে করোনা টেস্ট করাতে যাব, সোজা না বলে দিচ্ছে। অগত্যা আমার স্বামী, যার এই ফেব্রুয়ারি মাসে মোটরবাইকে একটি মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টে ডান হাতের কবজি ভেঙেছে, প্লেট বসানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, এখন এক বছর বাইক চালানোর কথা স্বপ্নেও ভাববেন না, এবার এটা ভাঙলে ডান হাতটা আপনার অকেজো হয়ে যাবে, সে সেই ভাঙা বাইক (অ্যাক্সিডেন্টের পর মেরামত করতে দিইনি আমি) নিয়ে আমাকে আর আমার ৩ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ২০ কিলোমিটার বাইক চালিয়ে দক্ষিণ কলকাতা থেকে সল্টলেকে ভোর ৬ টায় পৌঁছলাম। টেস্টের রিপোর্ট কী আসবে তাই নিয়ে যথেষ্ট টেনশনে ছিলাম। রিপোর্ট এলো নেগেটিভ। আমাদের করোনা নেই। কী শান্তি যে পেয়েছিলাম। ৩ দিনের প্রায় নরক যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
এর মধ্যের জল অনেক দূর গড়িয়েছে। ফেসবুকে অনেক লেখালেখি হয়েছে, সংবাদমাধ্যমে আমার মায়ের নাম প্রকাশিত হয়েছে। পাড়ার অতি উৎসাহী কিছু মানুষজন সেটা ফরওয়ার্ড করে লিখেছে, “ঘরের পাশে করোনা এসে গেছে, আর বোধহয় বাঁচব না।” আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ, আমরা শুধু ভোট দিই। ১০ টা ৫ টা ডিউটি করি, একটু ভালো থাকার চেষ্টা করি। শুধু কয়েকটা প্রশ্ন…
১. ভগবান না করুক আপনাদের বাবা মায়ের এরকম পা ভাঙলে করোনার ভয়ে ঘরে ফেলে রেখে তিলে তিলে মারবেন কি? না হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন?
৩. WHO বলে দিয়েছে, “জ্বর, সর্দি-কাশির মত এখন করোনা নিয়ে আমাদের বাঁচতে হবে।” অর্থাৎ, আজ না হয় কাল করোনা আপনারও হবে, তখন আপনাকে কেউ আপনার বাড়িছাড়া করার কথা বললে আপনার ভালো লাগবে তো? যেখানে আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলছেন বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকুন।
৪. এরকম ভুল রিপোর্টের জন্য আপনার জীবন দুর্বিষহ হলে সহ্য করতে পারবেন তো?

মা’কে ২৭ মে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছে। মা সুস্থ আছে, ভালো আছে। কিন্তু আমাদের যন্ত্রণা এখনও শেষ হয়নি। দুঃখের বিষয়, মা’কে বাড়িতে দিয়ে আসতে পারিনি আমরা। পাড়া থেকে থানায় রিপোর্ট করে এসেছে, পাড়ায় না কি অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন, মা বাড়িতে এলে পাড়ায় করোনা ছড়াতে পারে! মজার ব্যাপার অসহায় বিধবা বৃদ্ধ একলা মানুষটা যখন লকডাউনে একা পড়েছিল, তখন কেউ একবারের জন্য খবর নেননি। থানায় গেলাম, তাঁরা বললেন, দেখুন পাড়ার এতগুলো মানুষের বিরুদ্ধে যেতে পারব না। হাসপাতাল থেকে ছুটির পর ১৪ দিন অন্য কোথাও রাখুন, তারপর আমরা দেখছি। অগত্যা মা’কে আমার শ্বশুরবাড়িতে এনে রেখেছি। এদিকে মা বারবার জিজ্ঞেস করছেন, ‘আমাকে আমার বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে তোর শ্বশুরবাড়িতে আনলি কেন? আমি যে ক’দিন বেঁচে আছি, নিজের বাড়িতেই থাকতে চাই। আমাকে আমার বাড়ি দিয়ে আয়।” আপনারাই বলুন আমি মা কে কী উত্তর দিই!

Comments are closed.