করোনাভাইরাসের মারণ কামড়ে জর্জরিত গোটা বিশ্ব। এই অবস্থায়, মারণ ভাইরাসকে প্রতিহত করার একটাই উপায়, ভ্যাকসিন আবিস্কার। করোনা ভাইরাসকে প্রতিহত করতে এমন ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে, যা শরীরের কোষে এই ভাইরাসের বৃদ্ধি রোধ করতে পারে। কিন্তু কবে আসবে Coronavirus Vaccine?
এই প্রসঙ্গেই এবার চাঞ্চল্যকর দাবি করছেন ইতালির বিজ্ঞানী ও গবেষকরা।
ইতালির এক বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা দাবি করেছে যে তাঁরা এই মারণ ভাইরাসের ভ্যাকসিন বানাতে সক্ষম হয়েছে। রোমের স্পালোনজানি ইনস্টিটিউটে এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। গবেষকদের দাবি, তাঁরা ডিএনএ প্রোটিন স্পাইকের জিনের উপর ভিত্তি করে এই anti-corona vaccine বানিয়েছেন।
তাঁরা মনে করেন, তাঁদের তৈরি এই ভ্যাকসিন মানব দেহের কোষে, বিশেষত ফুসফুসের কোষে এই স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে ফাংশনাল অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম। ইন্ট্রামাসকুলার পদ্ধতিতে এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ হবে মানব দেহে। জানা গেছে ইঁদুরের উপর পরীক্ষায় এই ভ্যাকসিনটি করোনাভাইরাস প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন মানব দেহে পরীক্ষা বাকি।
মানব দেহে পরীক্ষায় সফল হলে, তা হবে বিশ্বের প্রথম করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন। কিন্তু সে জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সাধারণত কতদিন লাগে ভ্যাকসিন তৈরি হতে?
কোনও রোগের ভ্যাকসিন আবিস্কার করতে সাধারণভাবে অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগে। তবে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে ৯ মাস থেকে ২ বছরের মত সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন শিল্পপতি বিল গেটস, যাঁর সংস্থা, বিল গেটস ফাউন্ডেশন এই করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
কতদুর এগিয়েছে Coronavirus Vaccine তৈরির প্রক্রিয়া?
ইতিমধ্যে বেশ কিছু জায়গায় শুরু হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল। সফল হলে তা হবে এই সময়ের সবচেয়ে বড় আবিস্কার। এই মারণ ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বেঁচে যাবে মানব সভ্যতা। তবে শুধু ভ্যাকসিন আবিস্কার করলেই চলবে না। বিভিন্ন রকমের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে সেই প্রতিষেধককে। একবার নয়, বারবার। মানুষের ডিএনএ-এর সঙ্গে মিল রয়েছে এমন জীবের উপর প্রথম হবে সেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। সফল হলে মানুষের শরীরে তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হবে। সেই পর্যায়ে সাফল্য এলেই একমাত্র ভ্যাকসিন সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য নিয়ে আসা হবে।
ইজরাইলের একটি ডিফেন্স ল্যাবরেটরিও ইতিমধ্যে দাবি করেছে যে তাঁরা করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী পথ খুলে দিতে পেরেছে। সেখানকার বিজ্ঞানীদের দাবি, তাঁরা এমন একটি অ্যান্টিবডি খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন, যা মানব দেহের শরীরে করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে। যদিও মানব দেহে এর ট্রায়াল শুরু করার আগে এখনও অনেক পরীক্ষা বাকি।
কীভাবে তৈরি হয় কোনও রোগের ভ্যাকসিন?
কোনও ভ্যাকসিনের প্রধান কাজ মানব দেহে সেই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা।
কোনও রোগের ভ্যাকসিন সেই রোগ বহনকারী ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া থেকেই তৈরি করা হয়। এই ভ্যাকসিন তৈরির বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে।
ভাইরাসকে দুর্বল করা
এই পদ্ধতিতে মানব শরীরে প্রবেশ করা ভাইরাসটিকে দুর্বল করে ফেলা হয়। যাতে মানব দেহের মধ্যে প্রবেশ করলেও সেই ভাইরাস সংখ্যা বৃদ্ধি করে গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। সেই দুর্বল ভাইরাস থেকেই ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। মানুষের শরীরে যখন সেই ভ্যাকসিন প্রবেশ করানো হয়, তখন দুর্বলতার কারণে সেই ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। দেহে এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তলে। যার ফলে, ভবিষ্যতে শরীরে এই ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে না। সুতরাং এই ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা মানব দেহে সারা জীবন থাকে।
ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা
এই পদ্ধতিতে ওষুধ ব্যবহার করে শরীরে প্রবেশ করা ভাইরাসটিকে নিস্ক্রিয় করা বা মেরে ফেলা হয়। যার ফলে এই ভাইরাসটি মানব দেহে নিজের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে না। ফলে আক্রান্ত মানুষ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই পদ্ধতিটির ফলে দেহে ভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে।
ভাইরাসের একটি অংশকে ব্যবহার করা
এই পদ্ধতিতে ভাইরাসের একটি অংশকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হয়। ভাইরাসের গায়ের উপরে অবস্থিত একটি প্রোটিনকে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যার ফলে, ওই প্রোটিনের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায় ও ভবিষ্যতে যদি ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তাহলে ভাইরাসের একটি অংশের উপর প্রতিরোধের কারণে শরীরে সেই ভাইরাসের বৃদ্ধি বাধা পায়।
এছাড়াও ডিএনএ ও আরএনএর মতো বেশ কিছু নতুন পদ্ধতিও ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে কোন রোগ ভিত্তিক mRNA (Messenger RNA) সিকোয়েন্স শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এই mRNA থেকেই শরীরে এই রোগের অ্যান্টিজেন তৈরি হয়, যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে মিলে এই রোগকে প্রতিহত করে। এই পদ্ধতিটি খুবই কার্যকারী বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এই ভ্যাকসিনের বাজার মুল্যও অনেক কম হয় এবং ল্যাবরেটরিতে এই ভ্যাকসিন সহজেই বানানো যায়। মূলত সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে এই ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়।
সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা যেভাবে এই রোগের ভ্যাকসিন তৈরি করতে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন, তাতে আশা করা যায় যে অদুর ভবিষ্যতে এই ভাইরাসকে প্রতিহত করার অস্ত্র হাতে পাওয়া যাবে। কিন্তু তাঁর আগে পর্যন্ত অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। যে হারে এই মারণ ভাইরাস সারা পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে এবং যেভাবে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিভিন্ন দেশের সরকার সহ সাধারণ মানুষের কপালেও চিন্তার ভাঁজ বাড়ছে।
শুধু স্বাস্থ্য সঙ্কট নয়, গোটা পৃথিবী এক চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের জীবিকা হারিয়েছেন। এর থেকে নিষ্কৃতি কবে পাওয়া যাবে, তা কেউ জানে না। এই নিরাশার বাতাবরণে তাজা বাতাস ইতালি ও ইজরায়েলের গবেষণা।
Comments are closed.