বাংলায় বামপন্থীদের লড়াই চলবে, কিন্তু দুটো আসনের জন্য জোট ভেঙে দেওয়ার মাশুল কংগ্রেসকে কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দেবেন রাজ্যের মানুষ

২০১৪ সাল। তখন সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গে প্রাক সংসদীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। যথারীতি সংবাদমাধ্যম এই নিয়ে তোলপাড়। দেশজুড়ে মোদী হাওয়া। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস তিন বছর হল ক্ষমতায় এসেছে। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েতে তৃণমূল একা লড়ে ভালোই ফল করেছে। মমতার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। টিভি চ্যানেলের আলোচনায় যোগ দিতে যেতাম। সঞ্চালকদের মোটামুটি একটাই সুর, তৃণমূলের আসন কি কমার সুযোগ আছে? আমি বলতাম, না। বাড়বে। কিন্তু এই যে বাম-বিজেপি স্লোগানগুলো এক হয়ে যাচ্ছে, তার ফায়দা পাবে বিজেপি। কারণ, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসতে চলেছে এবং তৃণমূল বিরোধী ভোটের একটাই ঝোঁক থাকবে। যে শক্তিশালী তাকেই ভোট দেবে তৃণমূল বিরোধী জনতা। সেদিন কথাগুলো সবার হজম হয়নি। আমাকে নানাভাবে কটাক্ষ করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফল বেরনোর পর দেখা গেল, আমি খুব ভুল বলিনি। সেবারই প্রথম বিজেপি এই রাজ্যে ১৭ শতাংশ ভোট পেল।
এরপর পরিস্থিতি অনুধাবন করে বামপন্থী নেতারা তাঁদের ভোট কাটাকাটির জটিল অঙ্ক ফেলে রেখে একটি সমঝোতা করতে চাইলেন। সিপিএম পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের প্রায় বিরুদ্ধে গিয়ে তারা কংগ্রেসের সাথে ২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক জোট করলেন। তৃণমূল সরকার তাতে পড়ে গেল না। কিন্তু বিজেপির ভোট কমলো। একটি রাজনৈতিক বার্তা বা সুযোগ তৈরি হল। কিন্তু গোলাপে কণ্টক ছিল। কোনও কোনও মহল থেকে মনে করা হল যে, বামেদের সব ভোট কংগ্রেস পেলেও, কংগ্রেস সমর্থকরা সবাই বামেদের ভোট দেননি। একটি বিশ্বাসভঙ্গের পরিস্থিতি। সিপিএমের শরিক দলগুলি, বিশেষত ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি তাঁদের কংগ্রেস বিরোধিতার অবস্থান তুঙ্গে তুললেন। ফলত, পরবর্তী উপনির্বাচনগুলিতে বাম-কংগ্রেস জোট হতে পারল না। সরকারের সবসময় একটি বিরোধী জনমত থাকে। সেটা থাকা জরুরি এবং স্বাভাবিক। বিরোধী অবস্থান কখনও ফাঁকাও থাকে না। বাম-কংগ্রেস এর বিভ্রান্তি কাটানোর জন্য রাজ্যের তৃণমূল বিরোধী জনতা অনন্তকাল অপেক্ষা করবেন, এমন ভাবাটাই ভুল। সেই জায়গাটা নিয়েছে বিজেপি। এতে বিরাট কিছু দোষের হয়ে যায়নি।
সমস্যা হল, সারা দেশে বিজেপি যে আগ্রাসী নীতিতে চলছে এবং পশ্চিমবঙ্গে তার সামান্য যে ঝলক দেখা গেছে, তাই কাফি। রাম নবমীর মিছিল ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রাণ কেড়েছে মানুষের । সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা ক্রমশই মাথাচাড়া দিচ্ছে। এই অবস্থায় অবশ্যই তৃণমূল বিরোধী জনমতের একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রতিফলন হওয়া উচিত ছিল। যে রাজনীতি মানুষের মঙ্গলের জন্য। সামাজিক বিভাজনের জন্য নয়। বামপন্থীরা অবশ্যই চেষ্টা করেছেন। নিজেদের পার্টি লাইন পাল্টে সচেষ্ট হয়েছেন বৃহত্তর গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির সাথে জোটবদ্ধ হতে। কংগ্রেসের সাথে যাওয়া তার অন্যতম। আসন সমঝোতা উপলক্ষ মাত্র। একটি রাজনৈতিক পারসেপশন গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। সেই জায়গাটা নষ্ট না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই রাজনৈতিক অবস্থানটি বুঝতে অপারগ। তাঁরা এক বিচিত্র বায়না জুড়ে দিলেন। নানাভাবে কেন্দ্রীয় অবস্থান, প্রদেশের অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে জলঘোলা করে সময় নষ্ট করতে থাকলেন। আসলে পুরোটাই একটা খেলা। এর মাঝে একবার মুকুলবাবু এসে কী ফুল ফোটালেন কে জানে! অনেকটা ব্যবসায়ী ঢঙে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন কংগ্রেস নেতারা। আজ এখানে বৈঠক, তো কাল ওখানে। আজ এই স্টাইলে কথা, তো কাল অন্য স্টাইলে। এক বিরোধী দলনেতা আছেন, যিনি গত তিন বছরে কিছুই করে উঠতে পারেননি। একজন আপাদমস্তক অপদার্থ মানুষ। বিরোধী নেতার কাজ হল সর্বদাই সরকারের বিরোধিতা করা। সেটাই তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু তিনি তা পালন করেননি। সরকারি সুযোগ সুবিধাও ছাড়েননি। এই মানুষ আবার জোট নিয়ে কী বলবেন? কতগুলো বোকা বোকা যুক্তি। বললেন, যেখানে কংগ্রেস প্রার্থী দেয়নি, সেখানে তাঁরা কী করবেন? জোট বলা যাবে না, তাহলে কংগ্রেস কর্মীরা কি বসে থাকবেন? মান্নান সাহেবকে মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০০৯ সালে যখন তৃণমূল-এসইউসিআই জোট হয়েছিল, তখন এসইউসিআই সেই জোট স্বীকার করেনি। কংগ্রেস-তৃণমূল জোটও ছিল। এসইউসিআই সর্বত্র কংগ্রেস প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। কংগ্রেসও প্রার্থী দিয়েছিল জয়নগরে। তৃণমূলের সমর্থনে এসইউসিআই প্রার্থী তরুণ মণ্ডল জেতেন। কোনও যৌথ প্রচারের প্রয়োজন হয়নি। এক মঞ্চে যেতে হয়নি। সরকার বিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ওই জয়লাভ হয়েছিল। প্রণববাবুর যোগ্য নেতৃত্বে কংগ্রেসও লাভের গুড় ঘরে তুলেছিল। ছটা আসনে জয়লাভ করে। কংগ্রেসের অপদার্থ নেতারা তা বুঝবেন না। শুধুমাত্র টাকার বিনিময়েই যে রাজনীতি হয় না, সেখানে আন্তরিকতা আর নিজের অবস্থানের যে মূল্য আছে, সেটা সবাইকে বোঝানো সম্ভব নয়।
তবে একটা কথা বললে ভুল হবে না। কংগ্রেসের এই চরম দায়সারা অভ্যাসের মূল্য চোকাতে হবে রাজ্যের শান্তিপ্রিয় মানুষকে। এ রাজ্যে বিজেপির ভোট বাড়বে। ২০১৪ র তুলনায় অনেকগুণ। বিরোধী পরিসর যদি দুর্বল হয়, তার জায়গা নিয়ে নেবে প্রবল সাম্প্রদায়িক শক্তি। এই নির্বাচনে তার অবস্থান হবে রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষের। বিশেষ ধর্মীয় বিষয় মাথাচাড়া দেবে না। তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে ভোট আছে, তা একত্রিত করার চেষ্টা চলবে। একবার সফল হলেই পরের নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি সামনে চলে আসবে। এটাই কংগ্রেসের রাজ্য নেতারা বুঝতে পারলেন না। অথবা বুঝেও কোনও বিশেষ স্বার্থে না বোঝার ভান করলেন।
কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি শুধু ভোট দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় না। বামপন্থা একটি জীবনবোধ। একটি বিশ্ববীক্ষা। জনতার দাবি নিয়ে বাম গণসংগঠনগুলি প্রতিনিয়তই লড়াই চালাচ্ছে। এতে কোনও বিরাম নেই। সেই লড়াই চলবে, ভোটের ফল যাই হোক। কংগ্রেস কিন্তু তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। আজ দুটো আসনের জন্য জোট ভেঙে দেওয়ার মাশুল কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে দেবেন এই রাজ্যের মানুষ ।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.