আমার ছেলেবেলার দার্জিলিং # পর্ব ২

“পাহাড়িয়া নানী মো, দার্জিলিং মা জন্মেকো, কতি রামড় দেশ মের, সবজনাল হের হের।”

আমি পাহাড়ি বাচ্চা, দার্জিলিংয়ে জন্মেছি, কী সুন্দর আমার দেশ, সবাই দেখ।

অনেক বছর আগের কথা, একটি ছোট মেয়ে দার্জিলিংয়ের মহারানী গার্লস স্কুলে কে জি ওয়ানে যেত। সেই সময় স্কুলের বাৎসরিক উৎসবের একটা অনুষ্ঠানে এই গানটি গেয়েছিল। যদিও আমাদের মহারানী গার্লস স্কুল বাঙালি মেয়েদের স্কুল ছিল, কিন্তু অনুষ্ঠানের একটা অংশ হয়েছিল নেপালি ভাষায়। সেখানেই আমি গানটি গাই।
১৯৫০ সাল, স্কুলে ভর্তি হলাম, চার বছর বয়সে। ছোট বেলায় ছিঁচ-কাঁদুনে ছিলাম। আমার দিদু (সুধীরা চৌধুরী) আমার বাবার পিসিমা হতেন,  তিনি ওই স্কুলের টিচার ছিলেন। মাকে বললেন, মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করে দাও। স্কুলে গেলে ওর ভাল লাগবে। দিদুর কথায় মা-বাবু আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন ।
তখন দার্জিলিংয়ে অনেক ইংরেজি স্কুল ছিল। সবই নাম করা কনভেন্ট স্কুল। কিন্তু মহারানী স্কুল তৈরি করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর মেয়ে শ্রদ্ধেয়া হেমলতা সরকার। তিনি দেখলেন সাধারণ বাঙালি মেয়েরা কনভেন্ট স্কুলে পড়তে যেতে পারে না। কারণ, ইংরেজ আমলে ওই স্কুলগুলি সাধারণ লোকের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল। সেই জন্য বাঙালি মেয়েদের স্কুলের প্রয়োজন তিনি অনুভব করলেন। ১৯০৮ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজ থেকে ১০০ বছরেরও আগে। যেহেতু হেমলতা মাসিমা এবং টিচাররা বেশিরভাগ ব্রাহ্ম ছিলেন, সেই কারণে আমাদের শিক্ষার আরম্ভ হয়েছিল ব্রাহ্ম পরিবেশে। আমরা টিচারদের দিদি বলে ডাকতাম। আর প্রধান শিক্ষিকাকে বড় মাসিমা বলতাম। আমি এই স্কুল থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। তাই স্কুলের প্রভাব আমার জীবনে অনেকখানি ছিল।
সেই সুন্দর দিনগুলির সঙ্গে মিশে আছে আমাদের ছোট বেলার কিছু ঘটনা। যা অ্যালবামের ছবির মতন মনের মধ্যে আঁকা হয়ে আছে।
বর্ষার দিনে রেইন কোট আর গাম-বুট পরে স্কুলে যেতাম। আমার মনে আছে, একটা নীল রঙের ডাকব্যাকের রেইন কোট কেনা হয়েছিল আমার জন্য। আমাদের পাড়ায় সেটা ছিল একটা দ্রষ্টব্য। আমি স্কুলে যাওয়ার সময় পাড়ার মাসিমারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতেন, আর বলাবলি করতেন, তাঁদের ভাগ্যে এই সব ছিল না। সব যুগের পরিবর্তন!
এর পরে অ্যালবামের আর একটি চিত্র। তখন আমার ৭-৮ বছর বয়েস। সেই সময় আমাদের আলাদা আলাদা তোয়ালে থাকত না। একটা তোয়ালে আমরা সব ভাই-বোন ব্যবহার করতাম। কিন্তু কী করে যেন একটা লাল রঙের গামছা বাড়িতে এল। মা আমাকে গামছাটা দিয়েছিলেন। আমি খুব খুশি। আমি এক দিন গামছাটা শুকোনোর জন্য বারান্দার রেলিংয়ে মেলে দিয়েছিলাম। আমাদের বাড়িটা ছিল একটা ছোট পাহাড়ের ওপরে। রেলিঙের নীচে ছিল সেই পাহাড়টা। অনেক সময় জামা-কাপড় সেই পাহাড়ে পড়ে যেত। আমার গামছাটাও পড়ে গিয়েছিল। ওই রেলিংটার শিকগুলির মধ্যে দুটো শিকের ফাঁকটা একটু বেশি ছিল। আমরা সেই রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে নীচে নেমে গিয়ে কাপড় তুলে আনতাম। সেই সময়টা ছিল নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাস। দার্জিলিংয়ে সেই সময় সকালে হালকা গুঁড়ো-গুঁড়ো বরফ পড়ত, আর জমে থাকতো গাছের ওপর, রাস্তার ধারে।

সকালে উঠে দেখতাম, কাছের-দূরের সব পাহাড় এই বরফ পড়ে সাদা হয়ে আছে। আমি সেদিন সকালে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, আমার গামছাটা পাহাড়ে পড়ে আছে। আমি সেই রেলিঙের ফাঁক দিয়ে নামলাম গামছাটা উদ্ধার করতে। গামছাটা নিয়ে তো এলাম, কিন্তু বরফে আমার হাত দুটো তখন অবশ হয়ে গেছে। ঠান্ডাতে আমি কাঁদতে লাগলাম। বাবা বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে। ‘ও বাবু, আমার হাত যে ভীষণ কনাচ্ছে’। বাবা আমাকে অতি আদরে ঘরে নিয়ে গিয়ে ঘর গরম করার আংটার আগুনে হাত-পা সেঁকে দিলেন। সেই ভালোবাসার উত্তাপ আজও আমি পাই ।
আর একটা চিত্র। আমরা পাড়ার সব মেয়েরা একই স্কুলে পড়তাম। আমরা স্কুলে যাওয়ার সময় এক সঙ্গে সবাই যেতাম। সকাল ১০ টার সময় তৈরি হয়ে সবাই সবাইকে ডেকে এক সঙ্গে যেতাম। সেই সময় অ্যালুমিনিয়ামের ছোট ছোট স্যুটকেস থাকত আমাদের বই নেওয়ার জন্য । একদিন সেই স্কুলে যাওয়ার সময় কী করে যেন আমি রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমার হাঁটু ছড়ে রক্ত বেরিয়ে গেল। আমার বন্ধু গৌরী ওর বইয়ের স্যুটকেসটায় আমাকে বসিয়ে, একটা মোজা ওর পকেটে ছিল, সেটা বার করে আমার হাঁটুতে বেঁধে দিল। তার পরে স্কুলে গিয়ে ফার্স্ট এইড রুমে গিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল। আমার সেই বন্ধু গৌরী আর নেই, সে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে পরপারে। সেদিনের কথা মনে হলে আমার চোখে জল আসে।
গৌরীর কথা যখন উঠল, তখন অন্য একটা ঘটনা মনে এল। একবার গৌরীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল পুতুল খেলা নিয়ে। ঠিক হলো আমরা পুতুলের বিয়ে দেব। গৌরীর ছেলে আর আমার মেয়ে। পাড়ায় খুব শোরগোল শুরু হলো এই বিয়ে নিয়ে। আমাদের বড় দিদিরা যারা ছিল,  নীহারদি, গীতাদি, শঙ্করীদি, ওরা লেগে গেল পুতুলের শাড়ি বানাতে। কাপড়ের ওপরে জরি বসিয়ে সুন্দর সুন্দর শাড়ি বানালো। আমি তো খুব খুশি, আমার পুতুলের জিনিস-পত্র দেখে। বিয়ের দিন ঠিক হলো। আমার মা লুচি, তরকারি বানিয়ে দেবেন বিয়ের ভোজের জন্য। যথা সময়ে বর আসবে গাড়ি করে। গৌরীর দাদা হিমু একটা কাঠের চেয়ারে পুতুলকে বসিয়ে বারান্দার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত টানতে টানতে নিয়ে আসতে লাগল। আর পেছনে আমার ভাই ভাস্কর ওর টিনের ঢোল বাজাতে বাজাতে আসতে লাগল। আমাদের একজন মাষ্টার মশাই ছিলেন,  তিনি ঘটনাচক্রে এসে এই সব হুলুস্থুলু দেখে মুচকি হেসে গৌরী আর আমাকে দুটো চার আনার সিকি দিলেন, বর-বউ’কে উপহার স্বরূপ । অতঃপর বিয়ে শেষ হলো লুচি, আলুর দম আর মিষ্টির ভোজ খেয়ে। পরদিন গৌরী বলল, ছেলে বউকে এবারে ওর কাছে নিয়ে যাবে । এই নিয়ে ঝগড়া। আমি কিছুতেই দেব না, আর ও নেবেই। সবাই আমাকে বোঝাচ্ছে, আর আমি কিছুতেই বুঝব না। তারপরে কেউ একজন মধ্যস্থতা করলেন, যার যার পুতুল তার কাছেই থাকবে ।
দার্জিলিংয়ের বোটানিকেল গার্ডেনটা ছিল খুব সুন্দর। আমরা যেখানে থাকতাম, সেখান থেকে খানিকটা নীচে গেলে একটা গেট ছিল বোটানিকেল গার্ডেনে ঢোকার। আমরা মাঝে মাঝে যেতাম ওখানে। বিশেষ করে বাড়িতে কেউ অতিথি এলে তাদের দেখাতে নিয়ে যেতাম। একবার ঠিক হলো, আমরা পাড়ার ছেলে-মেয়েরা ওখানে যাব পিকনিক করতে। বিকেলের দিকে একটা কেটলিতে বাড়ি থেকে চা বানিয়ে কয়েকটা কাপ আর লেড়ো বিস্কুট, আর এক রকমের বিস্কুট ছিল, আমরা বলতাম এস বিস্কুট, চাঁদা করে কিনে নিলাম। এরপরে দল বেঁধে রওনা হলাম। অ্যালুমিনিয়ামের কেটলিটা হাতে ঝুলিয়ে গল্প করতে করতে বোটানিকেল গার্ডেনে পৌঁছলাম। তারপর ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গা ঠিক করলাম। সেখানে একটা বড় পাথর ছিল পাহাড়ের সঙ্গে লাগানো। সেই পাথরে একটা বড় পায়ের ছাপের মতন আর একটা ছোট পায়ের ছাপের মতন গর্ত ছিল। আমরা বলতাম, রাবণ আর সীতার পায়ের ছাপ। রাবণ যখন সীতাকে নিয়ে পালাচ্ছিল, তখন এই পায়ের ছাপ পড়েছিল । ওখানে একটা পরিষ্কার জায়গা নির্বাচন করা হলো পিকনিকের জন্য। কয়েক জন গেল শুকনো গাছের ডাল খুঁজে আনতে, আগুন জ্বালিয়ে চা গরম করার জন্য। আমরা অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। নানারকমের গাছ আর সুন্দর সুন্দর ফুল দেখে, গ্লাস হাউসে গিয়ে নানারকমের ফুল আর অর্কিড দেখলাম। ওখানে এক রকমের গাছ ছিল যার ফলগুলি শুকিয়ে নীচে পড়ে থাকত। ওই ফলগুলি ছাড়ালে ভেতরে বাদাম থাকত। সেই বাদামকে আমরা বলতাম কটটুস। সেগুলি আর পাহাড়ি আখরোট জোগাড় করে নিয়ে আসা হল। অবশেষে কাঠ-কুটো জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে কেটলির চা গরম করে বিস্কুট সহযোগে পিকনিক হলো। অন্ধকার হওয়ার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। তাছাড়া গেটও বন্ধ হয়ে যাবে ।
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল লুইস জুবিলি স্যানেটোরিয়াম। ওটা তখন একটা হোটেলের মতন ছিল। এখন বোধ হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিস্ট লজ হয়েছে। আমরা যখন দেখেছি জায়গাটা খুব সুন্দর সাজানো গোছানো ছিল। ওখানে ফোয়ারা ছিল, সেখানে রঙিন মাছ রাখা ছিল । আমরা ওগুলো দেখতে যেতাম। ওখানে খুব সুন্দর ফুলের বাগান ছিল। অনেক ফুল হতো, বিশেষ করে গোলাপ ফুল। আমরা দল বেঁধে যেতাম,  সঙ্গে ছোট ভাই-বোনদের নিতাম। একদিন ওখানে গিয়ে একটা দুষ্টু বুদ্ধি হলো। দেখলাম, মালি আসে পাশে নেই। আমরা ঠিক করলাম, এই ফাঁকে কিছু গোলাপ ফুল চুরি করব। বেশ কয়েকটা চুরি করা হয়েছে, এমন সময় মালির আবির্ভাব হলো। আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। সকলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমার ভাই তখন ছোট, আমি ওকে কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছি। আমি পিছিয়ে পড়লাম। মালি আমাকে ধরেই ফেলল। উঃ, কী ভয় যে পেয়েছিলাম। ভাই তারস্বরে চেঁচিয়ে কাঁদছে। অন্যরা সব পালিয়ে গেছে ফুলগুলো নিয়ে। আমার কাছে কিছুই ছিল না। মালি প্রচণ্ড শাসিয়ে আমাকে ছেড়ে দিল। মনে হয় ভাইটার কান্নার চোটে ছাড়া পেলাম ।

(দার্জিলিং পর্ব শেষ। আগামী বুধবার শিলিগুড়ি)

Leave A Reply

Your email address will not be published.