২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন নতুন করে এলাকা পুনর্বিন্যাসের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। আমি ১৯৮৫ সালের উপনির্বাচন থেকে ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত গড়বেতা পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হতাম। কিন্তু ২০১১ তে গড়বেতা পূর্ব বিধানসভা এলাকাটি পুনর্বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে অবলুপ্ত হয়ে শুধুমাত্র গড়বেতা বিধানসভা কেন্দ্র হয়।
এতদিন কেশপুর এলাকার ২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং গড়বেতা ৩ নম্বর (চন্দ্রকোণা রোড) পঞ্চায়েত সমিতি এলাকার ৬ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা গড়বেতা পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল। তা পরিবর্তিত হয়ে কেশপুরের ২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত কেশপুর বিধানসভায় এবং গড়বেতা ৩ এর ৬ টি গ্রাম পঞ্চায়েত শালবনি বিধানসভার সঙ্গে যুক্ত হল। গড়বেতা ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির ১২ টি এবং গড়বেতা ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির গোয়ালতোড় এলাকার ৪ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে নতুন গড়বেতা বিধানসভা কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল।
গড়বেতা পূর্ব বিধানসভা এলাকার গ্রামগুলিতে প্রতিনিয়তই আমার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ থাকত। তার মধ্যে ৮ টি গ্রাম পঞ্চায়েত বাদ দিয়ে নতুন ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার সংযুক্তি ঘটল আমার কেন্দ্রে। ওই নতুন এলাকার গ্রাম ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর তাগিদে পার্টিগতভাবে বিধানসভা নির্বাচনের ৩-৪ মাস আগেই কিছু কর্মসূচি ঠিক করা হয়। সেই মতো গোয়ালতোড় এলাকার হুমগড় ও আমলাশুলিতে পার্টি লোকাল কমিটি ৪ টি গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রথম পর্যায়ে কিছু কর্মসূচি নির্দিষ্ট করে। অতীতে এই সব এলাকায় কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি বা সরকারি কোনও প্রকল্পের কর্মসূচি ছাড়া পৃথকভাবে বিধায়ক হিসাবে আমার যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সে জন্য যাওয়াও হয়ে ওঠেনি কখনও। এই এলাকাগুলি সবই জঙ্গল এলাকা ও এখানে মাওবাদী আক্রমণের দগদগে ঘায়ের ক্ষত তখনও পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। মানুষের মনের মধ্যে সেই সমস্ত ভয়ঙ্কর স্মৃতি তখনও বিদ্যমান।
লেখার ১৩ তম পর্বে গোয়ালতোড় এলাকায় কমরেড কিরীটী হাজরার মাওবাদীদের প্রতিহত করার একটি ঘটনা উল্লেখ করেছিলাম। সেই লগিনোয়ারি ছিল ওই এলাকার মধ্যেই। ২০১১ সালের মার্চ মাসে, এক রবিবারে ওই এলাকার আমলাশুলির লোকাল কমিটির তখনকার সম্পাদক কমরেড সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে ওখানে যাই। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা এই পর্বের লেখার মধ্যে কিছুটা নিয়ে আসতে চেষ্টা করব। আমলাশুলিতে পার্টির লোকাল কমিটির অফিসে গিয়ে পৌঁছেছি। সেখানে আমাদের কর্মী, সমর্থকরা আমার যাওয়ার কথা জেনে আগেভাগেই উপস্থিত ছিলেন। আমি বললাম, যে গ্রামগুলিতে মাওবাদী আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল, সেই সব এলাকায় প্রথমে যাওয়া দরকার। সকলেই সহমত জানান। কলকাতা থেকে সম্ভবত সোজা সেদিন ওখানে গিয়েছিলাম বলে আমার পৌঁছোতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। সেজন্য লোকাল কমিটির সম্পাদক সুবোধদা বলেন, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে, চলুন আগে একটু খেয়ে নিয়ে তারপর বেরোবেন। না হলে আর দুপুরে খাওয়া সম্ভব হবে না।’ এই বলে সুবোধদা, তাঁর বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে পৌঁছে এক কঠিন, মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম।
প্রায় দেড় বছর পূর্বে ওই এলাকায় মাওবাদী আক্রমণের এক নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৯ সালের ১৭ ই জুন ওই এলাকায় পাথর পাড়ার খড়কাটা গ্রামে মাওবাদীরা অতর্কিতে আক্রমণ করে। আমাদের লড়াকু নেতা ও এলাকার প্রিয় শিক্ষক বাদল আহিরকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে মাওবাদীরা। ঝাড়খন্ড পার্টির স্থানীয় নেতা দুবরাজ সোরেন, তাঁর ছেলে এবং নাতি মাওবাদীদের এই কাজের বিরোধিতা করলে তাঁদেরও একইভাবে খুন করা হয়। তারপর রাতেই পাশের জঙ্গলে মাটিতে গর্ত করে বাদল আহির ও দুবরাজ সোরেনকে এবং আর একটি গর্তে তাঁর নাতি ও ছেলেকে পুঁতে দিয়ে চলে যায় মাওবাদীরা। গ্রামের মানুষ মাওবাদীদের সেই ভয়ঙ্কর আক্রমণ মোকাবিলা করে তাঁদের প্রিয় নেতা বাদল আহিরসহ বাকি তিনজনকে বাঁচাতে পারেনি। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই নৃশংস ঘটনা তখনও গ্রামের মানুষের কাছে দগদগে ঘায়ের মতো।
ঘটনার পরদিন পুলিশের উপস্থিতিতে মাটি খুঁড়ে একই গ্রামের ওই চার জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জানা যায়, কী নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল তাঁদের। বাদল আহির সিপিএম নেতা, তাঁকে খুন করাই ওই অপারেশনে মাওবাদীদের মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু বাকি তিনজন? একই আদিবাসী পরিবারের তিন প্রজন্মকে একই সঙ্গে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনা কেন? আসলে যে কথা বারবার বলে আসছি, ২০১১ সালে মাওবাদীরা রাজ্যে বাম সরকারকে সরাতে চেয়েছিল। সেজন্যই জঙ্গল এলাকায় বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি, এলাকার মানুষের এতদিনের বামেদের প্রতি সমর্থন, সব তছনছ করে দিতে এমনভাবেই আতঙ্ক তৈরি করা হয়। যাতে সাধারণ মানুষ আর বামফ্রন্টের পক্ষে মাথা তুলতে না পারে। সেই উদ্দেশ্যেই এই নৃশংস ঘটনা।
এই ঘটনার পর প্রয়াত বাদল আহিরের স্ত্রী, তাঁর সন্তানদের নিয়ে গ্রাম ছেড়ে ওই এলাকার লোকাল কমিটির সম্পাদকের যেখানে বাড়ি সেই পুঁইছোড়া গ্রামে আশ্রয় নেন। ওখানে গিয়েই প্রয়াত বাদল আহিরের স্ত্রী কৃষ্ণা আহিরের সঙ্গে দেখা। ক্ষেতমজুর পরিবার, সমাজের পিছিয়ে পড়া এলাকা থেকে উঠে আসা বাদল আহির লেখাপড়া শেখার ফলে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ই শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি এলাকায় সংগঠনের ভিত্তি মজবুত করতেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন। বাদল আহিরের মতো অসংখ্য কমরেডকে মাওবাদী আক্রমণে জীবন দিতে হয়েছে। সেদিন বাদল আহিরের স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। অসহায় অবস্থার মধ্যে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে মনে মনে আত্মসমীক্ষার চেষ্টা করছিলাম। সত্যিই কি আমাদের সরকারের কিছু করার ছিল না? আমার দুটো হাত ধরে বাদল আহিরের স্ত্রী চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিলেন, ‘দাদা, আমার স্বামী তো চলে গেছে। তাঁকে আর কোনও দিন ফিরে পাব না। দেখো দাদা, এরকমভাবে যেন আর কাউকে চলে যেতে না হয়। আর আমাদের ছেলেদের নিয়ে যাতে ভেসে না যাই, সেদিকে একটু খেয়াল রেখো।’ আমি শুধু বলেছিলাম, পার্টি সব দিন তোমাদের সঙ্গে থাকবে। কোনও অসুবিধা হবে মা।
কিন্তু আমরা কি সত্যি এই পরিবারগুলোর পাশে থাকতে পেরেছি? কে খবর রাখবে ওই পরিবারের? বাদল আহির কর্মরত অবস্থায় খুন হয়ে যাওয়ার পর তাঁর পরিবারের কারও যে চাকরি পাওয়ার কথা, আজ ৯ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও, তাঁর সন্তানরা তা পায়নি। সম্প্রতি এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক ও আমাদের পার্টি নেতা কৃষ্ণ প্রসাদ দুলের কাছে খবর নিয়ে জানলাম, বাদল আহিরের মৃত্যুর পর এত বছরে এখনও পর্যন্ত চাকরি হয়নি তাঁর পরিবারের কারও। যে সব আর্থিক সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, তাও পেতে তাঁদের ৭-৮ বছর লেগেছে। শুধু বাদল আহিরই নয়, একই অবস্থা আরও বহু পরিবারের। গোয়ালতোড় এলাকার পার্টির নেতা এবং শিক্ষক অজিত ঘোষকে ২০০২ সালে স্কুল থেকে ফেরার সময় রাস্তার ওপর গুলি করে নৃশংসভাবে খুন করে মাওবাদীরা। সেই সঙ্গে খুন করে তাঁর নিরাপত্তা রক্ষীকেও। সাগর, বাসন্ত, নিমাই বিশোই থেকে শুরু করে এলাকার অনেক সিপিএম কর্মী খুন হয়েছেন। মাওবাদী নামক ভাড়াটে খুনে বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে একসঙ্গে গোয়ালতোড় এলাকার চার জনকে খুন করার ঘটনা ওই এলাকায় ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে শেষ অধ্যায়। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় মাওবাদীদের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল। ২০০২ সাল থেকে ২০১১ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত সিপিএমের নেতা থেকে সদস্য-কর্মী, সাধারণ মানুষ, সমর্থক থেকে বাম রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত নয় এরকম ২৭২ জনকে খুন করে মাওবাদীরা। আর এই সময়ের মধ্যে এই জেলাতে ৮৯ জনকে অপহরণ করা হয়। আজও তাঁদের বেশিরভাগেরই কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য ভাড়াটিয়া খুনে বাহিনী মাওবাদীরা এই মারণযজ্ঞ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সংগঠিত করেছিল। যার নজির এই রাজ্য তো বটেই, সারা দেশের কোনও জেলাতেই খুঁজে পাওয়া কঠিন।
রাজ্যের মানুষ, বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহল এলাকার মানুষ একদিন এই ঘটনায় যারা দোষী তাদের জবাবদিহি চাইবেনই। সেটা আজ বা কাল বা পরশু বা অন্য কোনও দিন। ইতিহাস এই শিক্ষাই দেয় যে, মানুষই হল সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তাই মানুষই শেষ কথা বলবে। এত কিছুর পরেও ওই এলাকায় বাম সমর্থনের ভিত্তিকে একেবারে শেষ করে দিতে পারেনি মাওবাদীরা। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী ঝড় গোটা রাজ্যে বাম শক্তিকে তছনছ করে দিলেও, গড়বেতা এলাকার মানুষ বামফ্রন্টের পক্ষেই তাঁদের রায় দেন। গড়বেতা বিধানসভা কেন্দ্রে বামেরা জয়লাভ করে। মাওবাদী আক্রমণের মূল জেলা তথা জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে বামপন্থীরা গোটা রাজ্যের তুলনায় বেশি আসনে জয়লাভ করে।
(সুশান্ত ঘোষের ডায়েরি শেষ)