৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও ভেলোরের মতো একটা হাসপাতাল আমরা পশ্চিম বাংলায় করতে পারলাম না

এরপর যখন মেডিকেল হাবের লিখিত প্রস্তাব পেলাম, তখন মনে নতুন প্রত্যাশা জাগলো, এতদিনে হয়তো কিছু করার জায়গায় পৌঁছানো যাবে। কিন্তু না, তখনও আমার অনেক অভিজ্ঞতা হওয়া বাকি ছিল।
এরপর মেডিকেল হাবের অনুমোদন পাওয়ার প্রয়োজনীয় আবেদনপত্র তৈরিসহ সবই দ্রুততার সাথে কার্যকর হয়ে গেল। স্বাস্থ্য সচিবও তৎপরতা দেখিয়েছিলেন। প্রকল্পের টেন্ডার হয়ে গেল। কমিটি টেন্ডার সিলেকশন করে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যদার ঘরে পাঠিয়েও দেয় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। এরপর আর কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এনআরআই লোকজন প্রায় প্রতি সপ্তাহে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কাজ দ্রুত শুরু করতে না পারলে প্রকল্পের খরচ (প্রজেক্ট কস্ট) বেড়ে যাবে। কিন্তু না, কোনও কিছুই হচ্ছে না। তখন বাধ্য হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের তৎকালীন জেলা সিপিএম সম্পাদক দীপক সরকারকে বললাম বিষয়টা দেখার জন্য। এরপর গোটা বিষয়টি নিয়ে ওনার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করি। এই প্রকল্পের বাস্তবতা থেকে ভবিষ্যতে এর ফলাফল কী হবে, যা নিয়ে অতীতে অনেক আলোচনা হয়েছিল, তা আবার সবটা খোলাখুলি বুঝিয়ে বলার পর সিদ্ধান্ত হল, জেলা পার্টির প্যাডে জেলা সম্পাদকের বয়ানে একটা চিঠির ড্রাফট করা হবে। ঠিক হয়, জেলা পার্টির সম্পাদক তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে এই
চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করবেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে উনি নিজে যেন বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। যেন দ্রুত বিষয়টির সমাধান করে দেওয়া যায়। উনি আমার অনুরোধ মোতাবেক জেলা সম্পাদক হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠালেন। তাতেও কিছু হল না। এর কিছু পরে দ্বিতীয়বার জেলা সম্পাদক আরও একবার বিষয়টিতে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি পাঠালেন, যাতে মেডিকেল হাবের ছাড়পত্র দ্রুত পাওয়া যায়। এরপরও কোনও খবর নেই। শেষে ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে, বিধানসভার শেষ অধিবেশন যখন শুরু হয়েছে, তখন আমি একদিন নিজেই সরাসরি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘরে গিয়ে তাঁকে বললাম, আপনি মেডিকেল হাবের বিষয়টি সবই জানেন। ফাইলটি এতদিন ধরে পড়ে আছে, আপনি কিছু করুন। তখন উনি আমাকে বললেন, ‘এই প্রজেক্টের জন্য আরও ভালো প্রস্তাব পাওয়া যাবে। তাই এটা বাতিল করে নতুন করে টেন্ডার করতে হবে।’ সেদিন আমি ওনাকে বলি, প্রকল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে, এতদিন ফেলে রেখে এটা করা ঠিক হবে না। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন, যে কোনও দিন নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হয়ে যাবে। আপনি এটার অনুমোদন দিয়ে সময়সীমা বেঁধে দিন যে, উক্ত সময়ের মধ্যে কাজ না হলে সরকার চুক্তি বাতিল করে দেবে। বিনীতভাবে বললাম, নির্বাচনী আচরণবিধি লাঘু হয়ে গেলে আর কিছু করা যাবে না। এত বড় একটা প্রকল্প, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এত মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, সবই তো বানচাল হয়ে যাবে। আর এর জন্য তো সরকারকে কোনও আর্থিক দায়ও বহন করতে হবে না। না, এরপরও কোনও ব্যবস্থা হল না।
এই না হওয়ার কারণ কী, তা আমি আজও আমার বুদ্ধি, বিবেচনা দিয়ে বুঝে উঠতে পারিনি। হয়তো এটা বোঝার জন্য যে যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, তা আমার নেই। তবে এনিয়ে একটা নিজস্ব মূল্যায়ন আমি করেছিলাম। ২০০৬ সালে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর স্বাস্থ্য দফতর থেকে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর একটি পদক্ষেপ হল, রাজ্যের সমস্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলি পরিচালনার জন্য যে ম্যানেজমেন্ট কমিটি ছিল, তা ভেঙে দেওয়া এবং এর পরিচালন সমিতির সভাপতি পদে জেলার কোনও একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, স্বাস্থ্য দফতর, সরকার ও মানুষের মধ্যে সঠিক সমন্বয় রাখা এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোনও সমস্যা সরাসরি ক্যাবিনেট মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সমাধান করা ও সরাসরি সরকারের গোচরে আনা।
আমার বক্তব্য এই জায়গাতেই। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে জেলার ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের পরিচালন সমিতির সভাপতি করা হল। কেবলমাত্র মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে জেলায় থাকা কোনও মন্ত্রীকে এই দায়িত্ব দেওয়া হল না। যিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, পদাধিকার বলে তিনি রাজ্যের সব মেডিকেল কলেজেরই সর্বোচ্চ আধিকারিক। তিনি কেন একটি নির্দিষ্ট মেডিকেল কলেজের সভাপতি হবেন? এতে আইনগত কোনও সমস্যা নেই, এটা ঠিক। কিন্তু সারা রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যাঁর কাঁধে তিনি কেন একটি মেডিকেল কলেজের সভাপতি হবেন? হ্যাঁ, যদি এই জেলায় কোনও ক্যাবিনেট মন্ত্রী না থাকেন তাহলে তাঁকে দায়িত্ব নিতে হয়। আর যদি অন্য কেউ থাকেন তাহলে তাঁকে বাদ দেওয়া হবে কেন? সেটিও কি পছন্দ অপছন্দের কারণে? নাকি অন্যকিছু। আমি এই বিষয়টিতেও আমার মূল্যায়নের কথা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার্টির তৎকালীন সম্পাদককে বলেছিলাম। না, এর কোনও সদুত্তর ওনার কাছ থেকে পাইনি। এছাড়াও স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে এনজিও সংক্রান্ত বিষয় নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলাম, সেগুলিরও কোনও সদুত্তর সেদিন দিতে পারেননি তৎকালীন জেলা সম্পাদক। এসবই ছিল নীতি, নৈতিকতা সম্পর্কিত, যা গভীর উদ্বেগের।

আজও খবর পাই, সব কিছুই প্রায় ধ্বংস। প্রতিদিনই ওই এলাকার পরিকাঠামো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে। বড়বড় বিল্ডিংগুলির ইটও চুরি হয়ে যাচ্ছে। গোটা এলাকাই বেদখল। এলাকার দামি দামি মূল্যবান সব গাছও চুরি হয়ে গেছে। জানি না প্রত্যাশার স্বপ্ন নিয়ে এত মেহনত করে এপ্রকল্পের যে রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল, তা স্বাস্থ্য ভবনে আছে, না তাও বাম আমলের প্রকল্প রিপোর্ট বলে বাতিল কাগজের জায়গায় স্থানান্তর হয়ে গেছে। পুরনো এই বিষয়টি নিয়ে লেখার তাগিদ হয়তো এতখানি অনুভব করতাম না, যদি না ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে নতুন করে আমার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ হত।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভেলোর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য যেতে হয়। পূর্বে বহুবার ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের নাম শুনেছি। আমাদের এলাকার বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য বারেবারে ওখানে যায়। ওখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ওখানকার চিকিৎসকদের আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার খুবই ভাল। চিকিৎসার খরচও খুবই কম। এসব কথা অনেকবার নানাজনের কাছে শুনেছি। এবার যখন স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ওখানে গেলাম, তখন আমার মনে হল, অতীতে অসংখ্যবার যেখানকার ব্যবস্থা নিয়ে এত কথা শুনেছিলাম, একবার কেন তা দেখার জন্য এখানে আসিনি? যা দেখলাম তা বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়। প্রথম যেদিন ওখানে পৌঁছলাম, সেদিন পৌঁছনোর পর থাকার জায়গা পেতে রাত হয়ে যায়। তখনও সবটা বুঝতে পারিনি। তবে খাওয়ার জন্য বেরিয়ে দেখি বেশিরভাগই বাঙালি, লোকজন বাংলায় কথা বলছে। বাংলার সব খাবারই ওখানে পাওয়া যায়। প্রথম দিন হুগলি জেলার কিছু মানুষের সাথে আলাপ হল। তাঁরা আমাকে দেখে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করলেন। তাঁদের কাছে শুনলাম, প্রায় দু’সপ্তাহ আগে এসেছেন এখানে, কাজ শেষ। একদিন পর ফিরে যাবেন। আমায় তাঁরা প্রশ্ন করলেন, আমি কী করতে এসেছি? সব শোনার পর ওনারা আমায় বললেন, ডক্তাররা এত ভালোভাবে দেখবেন যে, সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপর যে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা সেখানে গিয়ে দেখি ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের মেন গেটের ঠিক উল্টোদিকে সেটি অবস্থিত। পরদিন সকাল আটটায় ডাক্তারকে দেখানোর টাইম নির্দিষ্ট ছিল। ভোরেই ঘুম ভেঙে যায়। হোটেলের জানালা খুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি শয়ে শয়ে মানুষের স্রোত। সবই মেডিকেল কলেজের গেটের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরাও দ্রুত তৈরি হয়ে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি শুধু মানুষ আর মানুষ। যার শতকরা ৮০-৮৫ ভাগই বাংলার। সারা রাজ্যের এমন কোনও জেলা নেই যেখানকার মানুষ ভেলোর চত্বরে নেই। এত মানুষ হাসপাতাল চত্ত্বরে অথচ কোনও হই-হট্টগোল নেই। সবাই শৃঙ্খলাপরায়ণ। প্রতিদিন নতুন রোগী আসার সংখ্যাটাও চমকে যাওয়ার মতো। সাথে আছে পুরানো রোগীর চাপ। অথচ কী সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝাঁ চকচকে হাসপাতাল কোথাও নোংরা বা দুর্গন্ধ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সমস্ত অসুস্থ মানুষের পরিচয়, তিনি শুধুমাত্র রোগী। ধনী থেকে দরিদ্র সকলের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা একরকম। বিশেষ বলে কিছু নেই। সর্বোপরি চিকিৎসকদের ব্যবহার। চিকিৎসার প্রয়োজনে বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার খরচও অনেক কম। রাজ্য থেকে আসা মানুষ যাঁদের সাথে ওইদিন কথা বলার সুযোগ হয়েছিল, প্রত্যেকেই ভেলোরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এদের মধ্যে কেউ কেউ সাহস করে আমায় বললেন, পশ্চিমবঙ্গে যদি এরকম একটা হাসপাতাল থাকতো তাহলে আর কষ্ট করে এতদূর আসতে হোত না। আমার এই প্রসঙ্গের অবতারণা এই জায়গাটুকু নিয়েই। আমরা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও এরকম একটা হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। যা সাধারণ মানুষের সাথে আমারও আক্ষেপের কথা। এর জন্য আমার নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, অতীতে যদি একবার এখানে আসার সুযোগ হত, তাহলে মেডিকেল হাবের বিষয়টি আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে একবারও পিছনে ফিরে তাকাতাম না। ৩৪ বছর তো কম সময় না। ক্ষমতার যে সীমাবদ্ধতাই থাকুক, এরকম একটা চিকিৎসা পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা খুব একটা দুঃসাধ্য ছিল না।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে ২০১১ র বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত খুবই ঘটনাবহুল সময়। এই সময় অনেক ঘটনা রাজ্যজুড়ে ঘটে। সে বিধানসভার অভ্যন্তরে ভাঙচুর থেকে শুরু করে, রাজ্যজুড়ে খুন, সন্ত্রাসের ঘটনা, তা একটা লেখার মধ্যে নিয়ে আসা খুবই কঠিন। যে সব ঘটনা ইতিমধ্যেই নানাভাবে মানুষের মধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। যতটা সম্ভব তার বাইরের ঘটনাই আমার লেখার মধ্যে দিয়ে মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। লেখার মধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুর ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ঘটনাই প্রাধান্য পেয়েছে।
এর অন্যতম কারণ, আমার পার্টি জীবনের কাজকর্মের শুরু অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার লোকাল কমিটির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে। সর্বক্ষণের কর্মী থেকেই গণ সংগঠন ও পার্টি সংগঠনের কাজ শুরু। পরবর্তীকালে ১৯৮৪ এর লোকসভা নির্বাচনের পর স্থানীয় বিধায়কের মৃত্যুতে বিধানসভার উপ নির্বাচনে ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে বিধায়ক হিসাবে নির্বাচিত হওয়া ও তার পরবর্তী সময়ে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার পার্টি সংগঠনে হলদিয়ে জেলা সম্মেলন থেকে পার্টি জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়া ও মেদিনীপুর জেলাজুড়ে গণ সংগঠন ও পার্টি সংগঠনে কাজ করার যে সুযোগ হয়, তার থেকেই গোটা জেলার ভৌগলিক অবস্থানের সাথে পরিচিত, কর্মী নেতাদের সাথে পরিচিতি, সব অংশের মানুষের সাথে যোগাযোগ প্রতিদিন বাড়তে থাকে। পরবর্তী কালে ১৯৯৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্য মন্ত্রিসভায় কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে যোগদানের সুবাদে জেলার বাইরেও সারা রাজ্যেই কাজের পরিধি বাড়তে থাকে, মানুষের সাথে যোগাযোগও অনেক বেশি করে হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
জেলা বিভাজনের পরে পার্টিগতভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরে যুক্ত থাকালেও, প্রশাসনে কাজের সুবাদে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সাথে যোগাযোগ থেকে যায়।

(চলবে)

Comments are closed.