জানেন, জিরাট পাটুলি’র মঠ বাড়ির বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের সমন্বয়ে পুজোর ইতিহাস? ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারই হল এই মঠ বাড়ি

হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সমন্বয়ের বহু উদাহরণ চোখে পড়ে। কিন্তু বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের সমন্বয়ের ঔজ্জ্বল্য দৃষ্টান্ত যে আজও বর্তমান, তার প্রমাণ রেখেছে ‘আয়মা পাটুলির মঠ বাড়ি’র দুর্গাপূজা। প্রথম থেকেই বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতে এই হিন্দু বাড়িতে পুজোর রমরমা প্রচলিত।

 

ভক্তি, শান্তি ও গা-ছমছমে অনুভূতির সংমিশ্রণ হল ‘পাটুলি মঠ বাড়ির দ্বিভূজা দুর্গাপূজা’ ও তার ইতিহাস। বাড়িটি হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের অন্তর্গত জিরাট সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার এই বংশের সন্তান ছিলেন বলে জানা যায় ‘চট্টোপাধ্যায় বংশের একদেশ কারিকা’ থেকে। স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই মঠ বাড়ির দূর্গামাতা ‘মঠের মা’ নামে প্রসিদ্ধ।

দেবী দুর্গার অনেক রূপ। কোথাও রঙে ভিন্ন, কোথাও সাজে, আবার কোথাও রূপে। দশভূজা, ত্রিভূজা প্রতিমার দেখাও মেলে। তবে এই মঠবাড়ির প্রতিমা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী দ্বিভূজা। এক হাতে তাঁর সর্পরাজ ও অন্য হাতে ত্রিশূল। বাকি আট হাত ঢাকা থাকে চুলে। সিংহের রং সাদা ও মুখটি ঘোড়ার মুখের আকৃতি বিশিষ্ট। বৌদ্ধ বহু রীতিনীতি জড়িয়ে আছে এই পুজোর সঙ্গে। কোনও সন্ধি পুজোর প্রচলন নেই মঠ বাড়িতে। বাড়ির সদস্য সব্যসাচি চট্টোপাধ্যায় জানালেন, একসময় অর্ধরাত্রে এ বাড়িতে নরবলির প্রচলন ছিল। কিন্তু বংশের কোনও এক সন্তান সেই নরবলি তুলে দেন।  সেই শরিক ও তাঁর বংশধরেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যান পরবর্তীকালে। আপাতত নরবলির প্রতিকী হিসেবে চাল গুড়ো করে তা দিয়ে মানুষ আকৃতির মূর্তি তৈরি করা হয়। আলতা মাখিয়ে মানুষ স্বরূপ তাকে বলি দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, বহু বছর আগে বন্য জিনিস, যেমন গর্ভ মোচা, ছাঁচি কুমড়ো, কচু, নারকেল, কাঁচকলা এসব দিয়ে মায়ের ভোগ দেওয়া হতো। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এই চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গা পুজো। প্রথমদিকে হোগলা পাতার মন্দিরে মায়ের আরাধনা করা হোত। ১৩০৭ সালে মণ্ডপ তৈরি করে সেখানে মায়ের বেদী স্থানান্তরিত করা হয়।

এই বাড়ির অন্য আর এক সদস্য সুনীল চট্টোপাধ্যায় বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে জানান, ১১৭৬ সালে ব্রহ্মদেশ (বর্তমানে মায়ানমার) থেকে এসেছিলেন এই বংশের পূর্ব পুরুষরা। প্রথম যিনি এসেছিলেন তিনি হলেন গদাধর সার্বভৌম। দ্বিতীয়জন হলেন রামরাম তর্কালঙ্কার, তৃতীয়জন রাজারাম সিদ্ধান্ত এবং চতুর্থজন গোকুলচন্দ্র বাচস্পতি। গোকুলচন্দ্র বাচস্পতির চার সন্তান ছিলেন লক্ষীনারায়ণ, উমাচরণ, মথুরামোহন ও কৃষ্ণধর। ১৯৩৫ সালে তাঁরা ব্রিটিশ প্রদত্ত জমিদারি লাভ করেন। পরে চার ভাই চার শরিকের একটানা চারটি বাড়ি তৈরি করেন। এই কৃষ্ণধরের বংশধরের মধ্যেই একজন নরবলির সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে তৎকালীন নদিয়ার মহারাজার কাছ থেকে দান হিসেবে ‘আয়মা পাটুলি’ গ্রামটি পান এই  বংশের ২০ তম বংশধর খ্যাতনামা পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তাঁর আমলেই বৌদ্ধতান্ত্রিক মতে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয় মঠ বাড়িতে।

করোনাকালীন আবহাওয়ায় বারোয়ারি পুজোর জমজমাটি ও আয়োজন তুলনামূলক কম করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বনেদি মঠ বাড়ির নির্জন দুর্গা পুজোর কোনও পরিবর্তন প্রয়োজন হবে না বলেই দাবি করছেন বাড়ির সদস্যরা।

 

 

 

Comments are closed.