শ্রীরামপুরে গোস্বামী বাড়ির ৪১৫ বছরেরর পুজোয় দশমীতে দেবী দুর্গাকে পান্তা ভাত ও কচুর শাক খাইয়ে বিদায় জানানো হয়

মাথার উপর শরতের ধবধবে সাদা মেঘ ও পূৰ্ব দিকে বহমান গঙ্গাকে সঙ্গে নিয়ে বাদশাহি সড়ক ধরে বেরিয়ে পড়া হল হুগলি জেলার এক প্রাচীন পুজোর সন্ধানে। আজকের গন্তব্য, শ্রীরামপুরের গোস্বামী বাড়ির দুর্গা পুজো। লোকমুখে আজও যা বুড়ি দুর্গার পুজো নামে পরিচিত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই পুজোর বয়স ৪১৫ বছর।

সালটা ১৫৯৫, শেওড়াফুলির রাজার প্রদত্ত জমিতে বসতি স্থাপন করেন রামগোবিন্দ গোস্বামী। রাজা জমিটি দান হিসেবে দিতে চাইলেও অব্রাহ্মদান হওয়ায় তা নিতে অস্বীকার করেন রামগোবিন্দ গোস্বামী। শেষে একটি কড়ির  বিনিময়ে গোস্বামীরা শ্রীরামপুরের বিস্তীর্ণ জমি কিনে নেন রাজার কাছ থেকে,  ওই বছরই গোস্বামীরা শ্রীরামপুরে একটি কুঠি বাড়ির পত্তন করেন। ড্যানিস ম্যাপে আজও যা গোস্বামী কোর্ট ইয়ার্ড হাউস নামে উল্লেখ রয়েছে। ১৫৯৫ সালেই রামগোবিন্দ গোস্বামী এই দুর্গা পুজোর সূচনা করেন।

এই পরিবারের বর্তমান সদস্য সব্যসাচী গোস্বামী ও পিয়ালী পাঠক  জানালেন পুজোর নানান রীতিনীতি। মূলত দেবী পুরাণ অনুযায়ী এখানে মা দুর্গার পুজো হয়ে থাকে। প্রতিপদাদি কল্পারম্ভঃ, অর্থাৎ প্রতিপদ থেকেই গোস্বামীদের বাড়ির পুজো শুরু হয়ে যায়।  বাড়ির প্রবীণ সদস্য সব্যসাচী গোস্বামী নিজে পুঁথি ধরে পুজো করে থাকেন এবং চন্ডিপাঠ করেন। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত পংক্তি  ভোজনের আয়োজন করেন গোস্বামীরা। এই প্রসাদ খাওয়ানোর বিষয়ে একটি চমকপ্রদ ঘটনার কথা জানালেন পিয়ালী পাঠক। এই বাড়ির পূৰ্বপুরুষ শরৎচন্দ্র গোস্বামী পাটের ব্যবসা করে প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হন। পুজোর দিনগুলো তিনি নিজে প্রতিবেশীদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতেন এবং কোনও বাড়িতে উনুন জ্বলতে দেখলে তাতে জল ঢেলে দিতেন। গোটা শ্রীরামপুরেই গোস্বামীদের পূর্বপুরুষদের এমন নানান ঘটনা ছড়িয়ে রয়েছে। এই বাড়ির আর এক পূর্বপুরুষ রঘুরাম গোস্বামী তখনকার দিনে ১২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ড্যানিসদের কাছ থেকে শ্রীরামপুর কিনে নিতে চান , যা পরে ইংরেজরা কিনে নেন সাড়ে ১২ লক্ষ টাকায়।

 

ফেরা যাক পুজোর কথায়। গোস্বামী বাড়ির একচালা দেবী দুর্গাকে কুলোর আকারের একটি মাটির ছাঁচে বসানো থাকে, যার পোশাকি নাম খোপ বাংলা। উল্লেখ্য, পুজোর শুরুর সময় থেকেই মূর্তির কাঠামোর মূল অংশেরও কোনও পরিবর্তন হয়নি। পুজোর নবমীর দিন একটি  সঙ্গীতানুষ্ঠান  হয়ে আসছে বহুবছর ধরে। তৎকালীন সময়ে অ্যান্টনি কবিয়াল এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেছিলেন। দশমীর দিন মাকে পান্তা ভাত ও কচুর শাক খাইয়ে বিদায় জানানো এই বাড়ির রীতি।

 

এবারে করোনা পরিস্থিতিতে এই সংগীতানুষ্ঠানের পরিবর্তে কোভিড যোদ্ধাদের সম্মান জানানোর আয়োজন করেছেন বাড়ির সদস্যরা।  পরিবর্তন এসেছে পুজোর প্রসাদ বিতরণ পর্বেও। এবারে বসে প্রসাদ গ্রহণের বদলে প্যাকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুরক্ষাবিধি মেনেই সাধারণের জন্য প্রবেশাধিকার থাকছে হুগলি জেলার প্রাচীন এই পুজোয়।

শ্রীরামপুর স্টেশন থেকে মাত্র দশ মিনিটের হাঁটাপথ গঙ্গার ধারে গোস্বামীবাড়ির এই পুজো। কলকাতার হই-হুল্লোড় থেকে একটু ছুটি নিয়ে ছুঁয়ে দেখেবেন নাকি ৪১৫ বছরের জীবন্ত এই ইতিহাস?

 

Comments are closed.