ইংল্যান্ডে পরপর দুটো টেস্ট হারেই এত হইচই কেন?
আপনি ট্যুইটারে অভ্যস্থ থাকলে লিখুন #IndvsEng, তারপর দেখতে থাকুন। প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে টিনএজার- কে নেই আলোচনায়! সকলের ট্যুইট, রিট্যুইট, লাইক পড়তে আর গুনতে থাকলে মনে হবে ভারতের আর কোনও সমস্যা নেই। বিচিত্র!
ইংল্যান্ডে প্রথম দুটো টেস্ট ভারতীয় দল হেরেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে এমন বোধয় এই প্রথম হোলও। আগেও ইংল্যান্ডে ঘটেছে, এখনও ঘটছে। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, এমনকী ওয়েস্ট ইন্ডিজেও ঘটেছে। তাতে এতোগুলো বছরে কিছু বদলেছে?
আমি বলবো, হালে বদলেছে। এই সব সোশ্যাল নেটওর্য়াকের প্ল্যাটফর্মে, একাধিক কোচ-ক্যাপ্টন-বোর্ডকর্তার হদিশ তো মিলেছে!
অথচ ভারত বিদেশের মাটিতে গিয়ে হারছে, এটা নতুন ঘটনা নয়। ঠিক এক্ষুনি রুটের ইংল্যান্ড এদেশে ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামলে, তাদেরও একই হাল হোত, তা নিয়েও বিশেষ সংশয় নেই। রুটরা বে-রুট হোত।
পরিসংখ্যান উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। ক্রিকেটপ্রেমী-ক্রিকেটবিরোধী যে কেউ মোবাইলে গুগল ঘেঁটে দেখলেই পেয়ে যাবেন। এখানে একবার সেই নমুনা পরপর বসিয়ে দেখা যাক এই আলোচনা প্রসঙ্গিক কিনা।
ফেলে আসা ১০ টি বছরে ভারতীয় ক্রিকেট দল, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া নিজের দেশে আর বিদেশে টেস্টের লড়াইয়ে কী পেয়েছে?
নিজের দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার ১৫ টি জয়, ১ টি হার, ৪ টি ড্র। বিদেশের মাটিতে ৩ টি জয়, ১৪ টি হার, ৩টি ড্র। নিজের দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের ১৫টি জয়, ৩টি হার, ২টি ড্র। আর বিদেশের মাটিতে ২ টি জয়, ১৪ টি হার, ৪টি ড্র। আর ভারতীয় দল? নিজের দেশের মাটিতে ১৩ টি জয়, ৩ টি হার, ৪ টি ড্র। আর বিদেশের মাটিতে ২ টি জয়, ১৪ টি হার এবং ৪টি ড্র।
এর থেকে কী বোঝা গেল? এই তিন দলের মধ্যে কি কোনও ফারাক আছে? না, সব দলই ঘরে বাঘ, বাইরে বেড়াল।
২০১১ তে ধোনির অধিনায়কত্বের সময় থেকে যাচাই করা যাক ভারতের পারফরমেন্স।
ভারত: ২০১১ জানুয়ারি থেকে…..
ইংল্যান্ডে ১১টি টেস্টঃ ১টি জয়, ৯ টি হার, ১ টি ড্র
অস্ট্রেলিয়াতে ৮ টি টেস্টঃ জয় নেই, ৬ টি হার, ২ টি ড্র
দক্ষিণ আফ্রিকায় ৬টি টেস্টঃ ১টি জয়, ৩ টি হার, ২টি ড্র
নিউজিল্যান্ডে ২টি টেস্টঃ জয় নেই, ১ টি হার, ১টি ড্র
মোট ২৭ টি টেস্টঃ ২ টি জয়, ১৯ টি হার, ৬টি ড্র
আজ ২০১৮। ৭ বছরে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ২ টি জয়। তাহলে, বার্মিংহাম-লর্ডস নিয়ে এখন হঠাৎ এত হইচই কেন?
একটা ব্যাখ্যা আছে। সমস্যাটা প্রচারমাধ্যমের। যারা টিভি স্বত্ব কিনেছে, তারা বেকায়দায়। দুটো টেস্টই পাঁচ দিন গড়ায়নি। তিন দিনেই ভারতীয় দলের তেকাঠি তেড়ছে গেছে। স্পনসর যে স্লট বুকিং করেছিল, তা বেকার হয়ে যাচ্ছে। হেরে যাওয়া টেস্ট ম্যাচের রিপিট টেলিকাস্টের ভিউয়ারশিপ প্রায় শূন্য। খরচ করে যে সব মিডিয়া কোম্পানি রিপোর্টার-ক্যামেরাম্যান পাঠিয়েছে, তাদেরও রাতের ঘুম গেছে। সাফল্যে সকলের মন চনমনে থাকে। যা দেখাবেন, মানুষ তাই দেখবে। আসলে সফর শুরুর আগে হাওয়াটা তোলা হয়েছিল, ‘নাউ, অর নেভার’। ফলে বিদেশ সফরে দু-মাসের প্যাকেজ… কী করা যায় এখন? কারও একটা মুণ্ডু চাই, কাঠগড়া চাই। বিচার চাই-তাই কড়া সমালোচনা চাই।
আচ্ছা, মানতে তো হবে, সেওয়াগ এই দলে নেই। যিনি শুরু থেকে মেরে-মেরে ‘ডিউক’ বলের পালিশ তুলবেন। নেই রাহুল দ্রাবিড়, যিনি ব্যাট-প্যাডের ফাঁক সহজে বোলারকে দেখিয়ে দেবেন না। নেই শচীনের মতো কেউ, যিনি ব্যাটের ‘সুইট স্পট’ এর ছোঁয়াতে বল মাঠের বাইরে পাঠানোর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবেন। নেই লক্ষণের মতো বিদেশের মাটিতে দাপিয়ে ব্যাট করার মতো টেকনিক্যাল ট্যালেন্ট। নেই সৌরভ, যিনি ৬ নম্বরে নেমে ৯৯ রানের ইনিংস খেলার মানসিকতা দেখাতে পারেন। সঙ্গে সিম বোলিংয়ে বিপক্ষের পার্টনারশিপ ভাঙতে পারেন। ‘আমরাও পারি’, এই মানসিকতা দলের মধ্যে আমদানি করতে পারেন।
আর বর্তমান?
বিরাট কোহলি সেদিনের ওঁদের মতন মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামেন। রান করেন। আবার রান আউট করে মাঠের উত্তাপ বাড়াতে পারেন, কিন্তু বিদ্যুৎ তরঙ্গটা বাকিদের মধ্যে এখনও ছড়াতে পারেননি।
কোচ বা ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী নিজে ওপেনারের ভূমিকা নিয়ে গর্ব বোধ করেন। দুটি টেস্টে চারটি ইনিংসে দুটি ওপেনিং কম্বিনেশন। ৫০ রানের আগেই তিন জন প্যাভিলিয়নে ফেরত আসছে! ডালমিয়া-বিন্দ্রা থেকে রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর বা শশাঙ্ক মনোহররা আগে অন্তত ফোনে জানতে চাইতেন, কী হচ্ছে! কিন্তু এখনকার এই মধ্যবর্তী সময়ে এভাবে ফোনটা কে করবেন, তাও জানা নেই। ফলে, যা চলছে, চলুক। অক্টোবর থেকে বোর্ড আবার স্বাবলম্বী হবে। তখন কাউকে ফোনটা করতে হবে। মাঝে ক্রিকেট ম্যানেজার পদে ছিলেন (এখনও আছেন) সাবা করিম। প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার-সিলেক্টর সাবা নামি কর্পোরেটে চাকরি করতেন। জবাবদিহি চাওয়া কিংবা দেওয়ার তত্বটা জানেন। কিন্তু শাস্ত্রীর মতো বড় নামের সামনে মিতভাষী সাবা বড্ড নড়বড়ে। তাই এই সিরিজে রবির ভাবনাতেই দল চলবে। কিন্তু এবার রবি শাস্ত্রী ইগোর শক্ত বর্মটা গা থেকে সরাতে পারবেন কি?
যদি পারেন, তাহলে সৌরভ-সঞ্জয় মঞ্জরেকরদের, ইংল্যান্ডে শচীন থাকলে তাঁদের নিয়ে ধাওয়ান, রাহুল, মুরলি, পূজারা, রাহানে এমনকী কোহলিরও নেট এবং হোটেল সেশন চলুক। এঁরা সকলে এক সময় দেশের জন্য সেরাটা দিয়েছেন, কিংবা কারও কারও থেকে তা বের করেও এনেছেন। ক্রিকেট বরাবরই মানসিক শক্তির লড়াই। ইংল্যান্ড এগিয়ে আছে দু’ধাপ। তৃতীয় টেস্ট ভারত না হারলেই, এই দলের পক্ষে লড়ে যাওয়া সম্ভব। সম্ভব ঘুরে দাঁড়ানো।
শেন ওয়ার্নকে দাঁত ফোটাতে দেবেন না বলে হোম সিরিজে চেন্নাই টেস্টের ৫ দিন আগে থেকে অনুশীলন চালিয়েছিলেন শচীন। শুধু লেগ স্পিনাররাই বল করেছিল নেটে। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাটিং সাফল্য পেতে গ্রেগ চ্যাপেলের তত্বাবধানে ওদেশে গিয়ে প্র্যাকটিস করে এসেছিলেন সৌরভ। ২০১১ বিশ্বকাপ দলে ছিলেন না রাহুল দ্রাবিড়। কিন্তু তারপরই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সিরিজ। ভারতীয় দল বাঙ্গালোরে অনুশীলন শুরু করার ঘন্টাখানেক আগে নিয়মিত ব্যাটিং প্র্যাকটিস করে নিজেকে ঘষেমেজে তৈরি করতেন দ্রাবিড়। তাই কোহলির দলের ব্যর্থতায় এখনই ওঁদের কাঠগড়ায় না তুলে, সকলকে সচেতন করা ভালো। এটা বিদেশের আবহাওয়া-উইকেট আর বিপক্ষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে লড়াই। আবহাওয়া আর উইকেটে এই এক মাসে মানিয়ে নিতে হবেই আমাদের। ‘দেরি করে জেগে লাভ নেই। জাগো, ঝাঁপিয়ে পড়ি চলো’, এটাই এখন হোক কোহলিদের একমাত্র জিয়ন মন্ত্র।
Comments are closed.