কর্ণাটকে উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ঃ মোদীর ক্যারিশমা দুর্বল হওয়া মানে, বাংলায় বামপন্থী রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধি

কর্ণাটকের উপনির্বাচনের ফলাফল অবশ্যই বিজেপির জন্য একটি বড় ধাক্কা। বিশেষত, বল্লারি লোকসভা কেন্দ্রে যেভাবে বিজেপির ভোট কমেছে, তা আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় শাসক দলের গলার কাঁটা হয়েই থাকতে পারে। এজন্য নয় যে শুধুমাত্র বিজেপি বিরোধী জোট গড়ে উঠেছে বলে এই ফলাফল। অবশ্যই ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বাধীন অর্থবলে বলীয়ান, খনি মাফিয়াদের মৃগয়াক্ষেত্র বল্লারি গত চোদ্দ বছর ধরে বিজেপির নিরঙ্কুশ আধিপত্যাধীনে ছিল। জি জগন্নাথ রেড্ডির মতো খনি মাফিয়ার করতলে বন্দি বল্লারির সাধারণ জনতা এবার সুযোগ বুঝে বিদ্রোহ করেছেন। কংগ্রেস এবং জনতা দল (সেকুলার) এর জোট অবশ্যই একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থী ভি এস উগরাপ্পা যেভাবে রেকর্ড আড়াই লক্ষাধিক ভোটে জয়লাভ করলেন তা বিস্ময়কর। অর্থাৎ, স্পষ্টতই বিজেপির অর্থবল সত্ত্বেও জনভিত্তি যে দুর্বলতর হচ্ছে তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। অবশ্য উপনির্বাচন আর সামগ্রিক সাধারণ নির্বাচন একই বস্তু নয়। কিন্তু একথা বলা যেতে পারে, কর্ণাটকে বিজেপির এই বিপর্যয় আগামী লোকসভা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করবে ।
এর আগে উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনেও আমরা একই পরিস্থিতি দেখেছি। বিরোধীরা একজোট হলেই বিজেপি হেরেছে। যেমন, ফুলপুর বা গোরক্ষপুরের উপনির্বাচন। ফুলপুরে বিজেপির ভোট কমেছিল ১৩ শতাংশ, আর গোরক্ষপুরে প্রায় ৭ শতাংশ। জনভিত্তিতে একটি সামগ্রিক বিশ্বাসহীনতা কাজ না করলে এমনটা হওয়ার কথাই নয়। যতই বিরোধী জোট হোক, বিজেপি নিজের ভোট ধরে রাখতে পারছে না কেন, সেটাই ভেবে দেখার বিষয়। উত্তরপ্রদেশে প্রবলভাবে ফিরে আসার জন্য বিজেপি এখন সঙ্ঘ পরিবারের পদতলে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছে। অর্থাৎ, এখন আর ‘এক ভারত অখণ্ড ভারত’ কিংবা ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ নয়। সামাজিক বিভাজন এবং ধর্মীয় মেরুকরণই এখন ভরসা । সাধু, সন্ত নিয়ে রামমন্দির আন্দোলনকে তীব্র করার চেষ্টা চলছে। স্লোগান উঠছে, ‘যোগীজি এক কাম করো/ রামমন্দির কা নির্মাণ করো’। ২০১৪ সালের উন্নয়ন প্রসঙ্গ বা মোদীর শৌচাগার নির্মাণ কিংবা সর্দার প্যাটেলকে নিয়ে ইতিহাসের ভুলভাল চর্চা এখন হিমঘরে। সর্দার প্যাটেলের বিশালাকার মূর্তি নির্মাণ করে এমনিতেই মোদী কিছুটা ব্যাকফুটে। দেশ বিদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে। তিন হাজার কোটি টাকা একটি মূর্তি নির্মাণে কীভাবে ব্যয় করা যায় তা বিস্ময়কর, বিশেষত যেখানে কৃষক আত্মহত্যা বাড়ছে বিজেপি পরিচালিত রাজ্যগুলিতেই। তবুও বলবো যে, সর্দার প্যাটেলকে নিয়ে ভুলভাল ইতিহাস চর্চা বা মূর্তি বানিয়ে ফুর্তি করলে দেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজন হয় না। যেটা হয় গোরক্ষার নামে তাণ্ডবে, মানুষ খুনে। দেশজুড়ে চরম ফ্যাসিবাদী আবহ তৈরির মাধ্যমে। মোদীর জমানায় এসব তো বেড়েই চলেছে, উপরন্তু সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও বিশেষ হেলদোল আছে বলে মনে হচ্ছে না।
মোদী নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, তাঁর নিয়ন্ত্রণও আর দলের উপর নেই। উত্তরপ্রদেশে যে যোগীরাজ চলছে, তা অচিরেই বিজেপির অভ্যন্তরে একটি বিশ্বাসহীনতা নিয়ে আসবে এবং সঙ্ঘ পরিবারের গোপন অ্যাজেন্ডাগুলি প্রকাশিত হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারও সাংবিধানিক শাসনের প্রশ্নে বিপথগামী হতে বাধ্য। শুধু ‘ফৈজাবাদ’, ‘অযোধ্যা’ হয়ে গেল না, ভারতকে পরিপূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করার সব ছক মজুত করা হচ্ছে। কিন্তু সেই হিন্দু রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু, দলিত, নিম্ন বর্গের মানুষের স্থান কোথায় হবে? দৃশ্যতই উচ্চ বর্ণের আধিপত্যাধীনে পরিচালিত কেন্দ্রীয় শাসক দল এই প্রশ্নে বিভ্রান্ত। ভাষাগত ঐক্যের প্রশ্নেও তেমন জোর দেওয়া হচ্ছে না। ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’ পাচ্ছে না তার যথাযোগ্য সম্মান। বস্তুত পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে।
গুজরাতে বিহারিদের প্রতি বিদ্বেষ বা অসমের তিনসুকিয়ায় সম্প্রতি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বাঙালি নিধন এবং অসমজুড়েই এনআরসির প্রশ্নটিকে বিকৃত করে ক্রমাগত উস্কানিমূলক প্রচার কি অখণ্ড হিন্দু ভারত গড়ে তোলার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলবে? এতদিন শুধুমাত্র সংখ্যালঘু জনতার মনেই ভয় ছিল, তাঁরাই আক্রান্ত হচ্ছিলেন। নিহত হচ্ছিলেন গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গি বা গোবিন্দ পানসারের মতো যুক্তিবাদী, মুক্তমনা মানুষ। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। দলিত সমাবেশে যদি উচ্চবর্ণের আক্রমণ হয় এবং দলিতদের পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বলেন তবে তাঁকেও ‘আরবান নকশাল’ নাম দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অর্থাৎ, ঝুলি থেকে বিড়ালটা বেরিয়েই পড়েছে। হিন্দু সমাজে যদি উচ্চবর্ণের আধিপত্য থাকে, তবে স্বাভাবিকভাবেই তার রাজনৈতিক প্রকাশে তা থাকতে বাধ্য। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। জাতিভেদ হিন্দু ধর্মের গোড়ায় আছে। হিন্দুত্ববাদীরা তা যতই আড়াল করার চেষ্টা করুন না কেন, তাঁদের কল্পিত হিন্দু ঐক্য এখনও পর্যন্ত অধরাই রয়ে গেল। এর স্পষ্ট ফল ফলছে বিজেপির জনভিত্তি হ্রাসে।
রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হবে ১৯ শে ডিসেম্বর। এখন বিজেপির পাখির চোখ অবশ্যই এই রাজ্যগুলি। যদি সরকার ধরে রাখা যায়, তবে ২০১৯ এর আগে অনেকটা বাড়তি অক্সিজেন পাবেন মোদী। কিন্তু যদি গদি ওল্টায় তবে সমস্যা আছে, কারণ ২০১৪ র ফলাফল কোনও সামাজিক ভিত্তির বিন্যাসের ফলে হয়নি, হয়েছিল একান্তই মোদীকে ঘিরে প্রবল প্রচার এবং প্রভাবশালী মিডিয়ার একাংশের প্রায় মরিয়া কংগ্রেস বিরোধিতার কারণে। সেই মিডিয়াকুল স্তিমিত হয়ে পড়েছে এমনটা নয়, কিন্তু এবার মোদীর বিরুদ্ধ হাওয়াকেও তাদের সামলাতে হবে। মিডিয়াভিত্তিক রাজনীতির বিপদ হলো, জনভিত্তি যখন সরে যেতে শুরু করে মিডিয়ার হাজার প্রচার সত্ত্বেও তা ফিরে আসে না।
বিজেপির নেতৃত্ব সেটা বোঝেন না, তা নয়। সঙ্ঘ পরিবারের নিজস্ব অঙ্ক আছে। তাঁরা এখন পূর্ব ভারতে মনোনিবেশ করেছেন। উত্তর-পূর্ব তো আছেই। অসমে সামাজিক, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা অব্যাহত। এবার টার্গেট ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ। বাংলায় সাড়ে সাত বছরের তৃণমূল জমানায় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অবকাশ তৈরি হচ্ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কলেজে ভর্তি দুর্নীতির অভিযোগ ইত্যাদি নানা ইস্যু অবশ্যই আছে। বিগত কতগুলি উপনির্বাচনে দেখা গেছে যে, বাম বা কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে তৃণমূল বিরোধী ভোটের একটি বড় অংশ পাচ্ছে বিজেপি। সারদা, নারদা নিয়ে সিবিআই-এর মাধ্যমে শাসক দলকে কোণঠাসা করার কোনও সুযোগই হাতছাড়া করা হচ্ছে না। তৃণমূল বিরোধী মানুষ ভাবছেন, হয়তো বিজেপিই পারবে তৃণমূলকে সরাতে। বামপন্থী ভোটের একটি বৃহদংশই বিজেপির দিকে সরে গেছে। এই অবস্থায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টাও চলছে। কিন্তু সবটাই ওই শহুরে মনোভাবে আক্রান্ত। যে মুহূর্তে সর্বভারতীয় পারসেপশন পাল্টাবে, এখানেও এদিক-ওদিক করা ভোটাররা আবার বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন। মিডিয়া এঁদের বিভ্রান্তি বাড়াতে আরও সহায়ক হবে। মোদী হারতে পারেন, এই ধারণা একবার পেয়ে বসলে ভাসমান নির্বাচক আগের অবস্থায় ফিরে যাবেন। তার অর্থ, তাঁরা তৃণমূল হয়ে যাবেন তা নয়, বাম-কংগ্রেস লিখিত অলিখিত যাই জোট হোক, সেই দিকে সরে যাবেন। বিজেপি এখনও বাংলায় প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেনি, যেটা বামপন্থী বা কংগ্রেসের আছে। তাঁদের জনভিত্তিও অনেক প্রাচীন। আজও সোমেন মিত্র বা বিমান বসুর ডাকে যত লোক জড়ো হন, মিডিয়া না দেখালে দিলীপ ঘোষ কোনও দিনই তত লোক টানতে পারবেন না। বামপন্থীরা ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনে রয়েছেন, এবং অবশ্যই কেন্দ্রীয় স্তরে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনের অঙ্গীকার করছেন। এই প্রেক্ষিতে মোদীর ক্যারিশমা দুর্বল হওয়ার অর্থ হলো, বাংলায় বামপন্থী রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধি। অবশ্যই তা এতটা নয় যে, অদূর ভবিষ্যতে মমতা হেরে যাবেন। কিন্তু বামপন্থী বা কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ দ্রুত এরাজ্যের রাজনীতিতে তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাবেন।

Comments are closed.