কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #দশ

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: গোপীবল্লভপুরের আন্দোলনের কথা জানাচ্ছিলেন নকশাল নেতা সন্তোষ রাণা

ছ’য়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত গোপীবল্লভপুরে নকশাল আন্দোলন, তার প্রেক্ষাপট এবং প্রভাব সন্তোষ রাণার কাছে যেন গতকালের ঘটনা। ২০১৭ সালের শেষে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল, ৫০ বছর আগের নয়, একদিন আগের ঘটনা শুনছি। যে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজার-লক্ষ গরিব খেটে খাওয়া মানুষের, নিম্নবর্গের পরিবারগুলোর দীর্ঘ দিনের শোষন, অত্যাচারের জাল ছিড়ে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন। অর্থনৈতিক এবং জাতিগত বৈষম্য কাটিয়ে পুর্নজন্ম ঘটে যাওয়ার এক রোমাঞ্চকর কাহিনী, যা পঞ্চাশ বছর পরেও দেশজুড়ে এক গভীর আলোচনার বিষয়।
‘কিন্তু আপনি যে বলছিলেন, জাতিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, এটা কেন? তাছাড়া ’৬৯ এর নভেম্বরে যে আন্দোলন, তাকে তো ধরেও রাখা গেল না বেশি দিন!’
‘দেখুন সেই সময় গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রাম, বিনপুর, মেদিনীপুর জেলার তফশিলি জাতি এবং আদিবাসী এলাকাগুলোতে জাতি বৈষম্য ছিল মারাত্মক। বিনপুরে পরিস্থিতিটা ছিল একটু আলাদা। কারণ, সেখানে তফশিলি জাতি এবং আদিবাসীদের হাতে তাও কিছু জমি-জায়গা ছিল। ফলে কিছু বড়লোক তফশিলি এবং আদিবাসী পরিবার ছিল সেখানে। তার বাইরে বেশিরভাগই ছিল গরিব। বিনপুরে এই গরিব, দরিদ্র তফশিলি এবং আদিবাসী মানুষগুলো তুলনায় বড়লোক তফশিলি এবং আদিবাসী পরিবারের জমিতে চাষ করত। তাদের মধ্যে শ্রেণি বিভেদ ছিল ঠিকই, কিন্তু জাতি বিভেদ ছিল না। বিনপরে বড় জমির মালিক এবং মজুর একই সঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে পারত। আর এটাই ছিল গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রামের সঙ্গে বিনপুরের মৌলিক ফারাক। গোপীবল্লভপুরের মোহন্ত গোস্বামী, শৈলবালা মহাপাত্র, ঝাড়গ্রামের কর, হোতা কিংবা মল্লদেব পরিবার, সমস্ত জোতদার, জমিদারই ছিল উচ্চবর্ণের। এখানকার কিংবা ওড়িশার ব্রাহ্মণ। ৮০ শতাংশ জমির মালিক ছিল এরাই। অল্প জমি ছিল আমাদের পরিবারের মতো কিছু তেলি, সদগোপ সম্প্রদায়ের মধ্য-চাষি কিংবা মধ্যবিত্তের হাতে। আর তফশিলি এবং আদিবাসীরা ছিল মূলত ভূমিহীন কিংবা যৎসামান্য জমির মালিক। ফলে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর ওপর একই সঙ্গে ছিল চরম অর্থনৈতিক শোষন এবং জাতিগত বিদ্বেষ। নকশাল আন্দলন শুরুর পর গোপীবল্লভপুরেই এই জাতিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা আমরা অভিজ্ঞতার মধ্যেও বারবার দেখেছি।’
‘কী রকম?’
‘নকশালবাড়ির প্রভাবে আমরা যখন গোপীবল্লভপুরের বিভিন্ন এলাকায় যেতে শুরু করলাম, দেখলাম গ্রামগুলো রেসপন্ড করছে কমিউনিটি হিসেবে। প্রথমে এল মাল গ্রামগুলো। তারপর একে একে মুন্ডা, কেওট, সাঁওতালরা এগিয়ে এল। অর্থনৈতিকভাবে এবং জাতিগতভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ প্রথম এই আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিল। ’৬৯ এর নভেম্বরে প্রথম যখন ৩০-৩৫ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে জোতদারের জমির ধান কাটতে শুরু করে, তার একশো শতাংশই ছিল তফশিলি জাতিভুক্ত এবং আদিবাসী মানুষ। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে আস্তে আস্তে মধ্য-চাষি কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণিও এতে যোগ দেয়। বলা যেতে পারে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করতে শুরু করে। কিন্তু এই জোতদার-জমিদার বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করার মধ্যে মধ্যবিত্তের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। যখন আন্দোলনে জোয়ার আসত তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার পাশে দাঁড়াত, আবার ভাটা এলে তারা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে জোতদারদের পক্ষ নিত। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের বহুবার হয়েছে। তাই আমরা যখন পুলিশের থেকে বাঁচতে গোপনে মুভ করতাম, সব সময় চেষ্টা করতাম মধ্যবিত্ত পাড়া কিংবা গ্রাম এড়িয়ে তফশিলি এবং আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম দিয়ে যাতায়াতের। গ্রেফতারি এড়াতে আশ্রয়ও নিতাম তফশিলি এবং আদিবাসী গ্রামে। মধ্যবিত্তরা জোতদার এবং পুলিশের চরের কাজ করেছে, এমন ঘটনা প্রচুর। কিন্তু কোনও গরিব পরিবার বেইমানি করত না। কেন বলছি, সেই সময় গোপীবল্লভপুরে শুধুমাত্র শ্রেণি চরিত্রটাই শেষ কথা ছিল না? তার কারণ, আমরা অভিজ্ঞতায় বারবার দেখেছি, দশ বিঘা জমির মালিক সাঁওতাল আর দশ বিঘা জমির মালিক তেলির মধ্যে মৌলিক ফারাক ছিল। যে পরিমাণ জমির আদিবাসী মালিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল, একই পরিমাণ জমির মালিক তেলি কিন্তু তাতে যোগ দেয়নি। প্রয়োজন বুঝে মাঝেমধ্যে আন্দোলনকে সমর্থন করেছে মাত্র। আবার সুযোগ বুঝেই বড়লোক জোতদারের পক্ষ নিয়েছে।’
এও এক মৌলিক তত্ত্ব হাজির করলেন কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সন্তোষ রাণা। শুধুমাত্র শ্রেণি চরিত্র নয়, জাতিগত বিন্যাসও বড় প্রভাব ফেলেছিল ছ’য়ের দশকের শেষে গোপীবল্লভপুরের নকশাল আন্দোলনে। সন্তোষ রাণার ব্যাখ্যায় এটাই ‘কাস্ট ফিউডালইজম’। কারণ, স্বাধীণতার পর গ্রামে গ্রামে বড়লোক, জমিদার, জোতদারদের যে শোষন, অত্যাচার, তা শুধুমাত্র গরিবের ওপরেই কেন্দ্রীভূত ছিল না, জাতিগতভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের ওপর তা ছিল আরও বেশি। আর একই সঙ্গে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া এবং নিম্নবর্গের মানুষের ওপর যে বহুমাত্রিক আক্রমণ, তাকেই ‘কাস্ট ফিউডালইজম’ আখ্যা দিয়েছেন সন্তোষ রাণা। কিন্তু শুধুমাত্র গোপীবল্লভপুরে ছ’য়ের দশকের আন্দোলনের সামাজিক কিংবা শ্রেণি চরিত্র নয়, তার বাইরেও কিছু জানার ছিল তাঁর কাছে৷
‘একুশ শতকের গোঁড়ায় এই যে তীব্র মাওবাদী আন্দোলন শুরু হল মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিভিন্ন অংশে, যা চূড়ান্ত আকার নিল লালগড়ে এসে, তার ওপর গোপীবল্লভপুর কিংবা ডেবরার নকশাল আন্দোলনের প্রভাব কতটা? কিষেণজির নেতৃত্বে মাওবাদীদের লালগড় আন্দোলনকেই বা আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেন?’
‘আমি শুরুতেই বলেছি, মাওবাদীরা ক্লাস স্ট্রাগল ভুলে গেল। আমাদের সময় ছ’য়ের দশকের শেষে ব্যাপারটা তেমন ছিল না। তাছাড়া মাঝের ৩৫-৪০ বছরে বাংলার গ্রামগুলোর শ্রেণি চরিত্র, জাতি চরিত্রও অনেক পাল্টেছে। আমাদের সময় ছিল তীব্র দারিদ্র, ক্ষুধা, শোষন আর অত্যাচার। যার বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১-৭২ এর পর সেই আন্দোলনে ভাটা পড়ে। মাঝখানে কয়েক বছর কংগ্রেস শাসন। আবার জোতদার, জমিদারদের হাত শক্ত হল। তারপর ১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট সরকার গঠন হলে ফের জোতদারের জমি দখল শুরু হল। ’৭৭ সালে সাঁকরাইলের রোহিনীর জমিদার হরিশ মহাপাত্রকে হারিয়ে আমি বিধায়ক হলাম। রাজ্যজুড়ে শুরু হল অপারেশন বর্গা। ব্যাপক ভূমি সংস্কার। জোতদার, জমিদারদের এক্তিয়ার বহির্ভুত জমি দখল। আমরা এবং সিপিআইএম একসঙ্গে সাঁকরাইলের মহাপাত্রদের জমি খাস করেছি। ঝাড়গ্রামের জোতদার কর এবং হোতাদের জমি খাস করল সিপিআইএম। এই যে ঝাড়গ্রাম ব্লকজুড়ে জমি খাস করার আন্দোলন শুরু হল তা গরিব তফশিলি এবং আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলল। ১৯৭৭ থেকে ’৮৭, প্রথম দশ বছর সিপিআইএমের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত ভাল। কিন্তু তারপরই গোলমালটা শুরু হল ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন এলাকায়। আটের দশকের গোঁড়া থেকেই আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবি নিয়ে জোর আন্দোলন শুরু করল ঝাড়খন্ড পার্টি। একদম শুরুর দিকে বিনপুরে ঝাড়খন্ড পার্টির কিছু প্রভাব ছিল। কিন্তু আটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই তীব্র আধিপত্যের রাজনীতি শুরু করে দিল সিপিআইএম। মূলত ঝাড়খন্ড পার্টিকে দমন করতেই সিপিআইএমের এই আধিপত্যবাদের সূত্রপাত। আর সিপিআইএম যত দলীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, ততই মানুষ ঝাড়খন্ড পার্টির দিকে ঝুঁকেছে। ঝাড়খন্ডিদের শক্তি ততই সংহত হয়েছে। সিপিআইএম যদি আধিপত্যের রাজনীতি না করত তবে ঝাড়খন্ডিদের এত শক্তি বৃদ্ধিও হোত না। আসলে বিরোধী কোনও রাজনৈতিক মতকেই মান্যতা দেওয়ার সহিষ্ণুতা সিপিআইএম সেই সময় দেখায়নি। শাসক দল হিসেবে সিপিআইএম যদি বিরোধী মতকে মান্যতা দিত, তবে ঝাড়গ্রামে এত গরিব তফশিলি, আদিবাসী মানুষ লাইন দিয়ে ঝাড়খন্ড পার্টির দিকে চলে যেত না।
আটের দশকের শুরু থেকে আরও একটা ব্যাপার হয়েছিল ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবি তুলল ঝাড়খন্ড পার্টি। তাতে সরাসরি যোগ দিল কংগ্রেস। তখন কংগ্রেস মানেই সব বড়লোক, জোতদার, জমিদার পরিবার। আর নীতিগতভাবে আমরাও আলাদা রাজ্যের দাবিকে সমর্থন জানালাম। আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবির একমাত্র বিরোধিতা করল সিপিআইএম। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে। ফলত, সেই সময় একদিকে জোটবদ্ধ হল ঝাড়খন্ড পার্টি, কংগ্রেস এবং পুরনো নকশালরা। অন্যদিকে, সিপিআইএম। সিপিআইএমের সঙ্গী তখন প্রশাসন। তারপরেই দু’দলের মধ্যে শুরু হয়ে গেল রক্তাক্ত সংঘর্ষ। খুন-পাল্টা খুনের রাজনীতি। প্রথমে টাঙি, বল্লম, তীর ধনুকের লড়াই। তারপর আমদানি হল বন্দুকের। সেই লড়াইটা চলল বহু বছর। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে ঝাড়খন্ডিদের ওপর তীব্র দমন পীড়ন শুরু করল সিপিআইএম। এমনই অবস্থা পৌঁছেছিল, টানা দু-তিনটে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, জামবনি, গোপীবল্লভপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় কোনও বিরোধী দল প্রার্থীই দিতে পারেনি। কিন্তু প্রশাসনকে ব্যবহার করে যে নির্বাচনী একাধিপত্য সিপিআইএম প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার একটা পালটা পরিস্থিতিরও জন্ম নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছিল সেই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই।’
‘আচ্ছা, কংগ্রেস তো আগাগোড়াই সিপিআইএমের বিরুদ্ধে ছিল। জোতদার, জমিদারদের জমি খাস করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল তার থেকে বাঁচতে কংগ্রেসিরা তখন ঝাড়খন্ডিদের সমর্থন করে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু আপনারা কেন তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন? লড়াইটা তো প্রথম শুরু হল জোতদারদের জমি খাস করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর।’ থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সন্তোষ রাণাকে।
‘আমি নিজে ঝাড়খন্ডিদের পৃথক রাজ্যের দাবিকে সমর্থন করেছি। আদিবাসীরা নিজেদের স্বশাসন, নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষার দাবি নিয়ে পৃথক রাজ্যের কথা তুলেছিল। আমাদের দৃষ্টভঙ্গীতে এটা ছিল একটা গণতান্ত্রিক লড়াই। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং অধিকার রক্ষার আন্দোলন। তাই আমরা এর সঙ্গে ছিলাম। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ঝাড়গ্রামে সিপিআইএমের সঙ্গে সমস্ত বিরোধী দলের লড়াই, সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। যা অনেক পরে সিপিআইএমের সঙ্গে মাওবাদীদের লড়াইয়ে পরিণত হল। কিন্তু মুশকিল হল, সিপিআইএম যেভাবে বিরোধী মতকে মান্যতা দিতে অস্বীকার করেছে, পরবর্তী সময়ে একই কাজ করল মাওবাদীরাও। যে বা যারাই রাজনৈতিকভাবে মাওবাদীদের বিরোধিতা করেছে তাকেই তারা নির্বিচারে খুন করেছে। একুশ শতকের শুরু থেকে মাওবাদীরা যত লোককে খুন করেছে তারা কেউ জোতদার, জমিদার কিংবা বড়লোক ছিল না। ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দল, মানে, মূলত সিপিআইএম করা গরিব মানুষ। আর গরিব মানুষকে খুন করে কোনও ক্লাস স্ট্রাগল হয় না। প্রথম প্রথম মাওবাদীরা যখন ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থনে এখানে সিপিআইএম বিরোধী লড়াইয়ে সামিল হয়েছিল, তখন তারা সাধারণ গরিব মানুষের সমর্থন পেয়েছিল। তাছাড়া, আরও একটা ফ্যাক্টর ছিল। মাওবাদীরা এখানে সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ডিদের মধ্যের রাজনৈতিক লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল। গরিব পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষ নিয়ে বড়লোকের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি তারা। আর এটাই ছিল এরাজ্যে একুশ শতকের গোঁড়ায় মাওবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি। এলাকার দখল নিতে গিয়ে ক্লাস স্ট্রাগলটা ভুলে গিয়ে স্রেফ মানুষ খুন করতে শুরু করল তারা। সমস্ত বিরোধী মতকে দমন করার যে রাস্তা সিপিআইএম নিয়েছিল, তারই পালটা ব্যবস্থা আরও নৃশংসভাবে চালু করল মাওবাদীরা।’
নকশাল আন্দোলনের আমলে গোপীবল্লভপুরের নেতা, সিপিআইএমএলের প্রাক্তন বিধায়ক সন্তোষ রাণার সাক্ষ্য মোটামুটি শেষ। তাঁর সঙ্গে কথার পরে ভাবছিলাম, কী বিচিত্র এই ঝাড়গ্রাম মহকুমার চরিত্র! দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একটা মহকুমার কয়েকটা ব্লকে গরিব মানুষ শুধু লড়াই করে চলেছে নিজেদের মধ্যে! যে খুন করছে, আর যে খুন হচ্ছে দুই পরিবারেই চরম দারিদ্র। দু’দল মানুষেরই অধিকাংশ হয় তফশিলি জাতিভুক্ত, নয়তো আদিবাসী। শুধু তাদের রাজনৈতিক পরিচয় আলাদা। কেউ ঝাড়খন্ড পার্টি কিংবা মাওবাদীদের নেতা-কর্মী-সমর্থক। কেউ আবার সিপিআইএমের নেতা-কর্মী-সমর্থক। কিন্তু এই লড়াই, সংঘর্ষ, খুনোখুনি তো কোনও শ্রেণি কিংবা জাতি বৈষম্য দূর করার জন্য হচ্ছিল না। অথচ, এই মহকুমাতেই ছ’য়ের দশকের শেষে জেগে উঠেছিল গরিব, নিম্নবর্গীয় মানুষ। যে নকশালরা গরিব আদিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ছ’য়ের দশকের শেষে ডেবরা, গোপীবল্লভপুরে জোতদার, জমিদারের জমি দখলের আন্দোলন করেছে, তাদেরই উত্তরাধিকার চলে গেল এমন একটা রাজনৈতিক দলের হাতে যাদের একমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং কৌশল হয়ে উঠল মানুষ হত্যা। উলটো পক্ষে সিপিআইএম। যে সিপিআইএম ১৯৭৭ সালে সরকার গঠন করে বহু জমি খাস করেছে, তারাই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ল। এ কি সমাজের কোনও অগ্রগতি? নাকি স্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতা কব্জায় রাখার জন্য স্বল্পমেয়েদি এক বন্দোবস্ত?

বাসুদেব ভকত, ঝাড়খন্ড পার্টি, পঞ্চায়েত ভোট ২০০৩ 

কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের প্রথম সাক্ষী আইপিএস প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় থেকে সন্তোষ রাণা বলেছেন, ‘ঝাড়খন্ড পার্টি মানেই সেই সময় সিপিআইএমের জাত শত্রু। আর জমি আন্দোলনের পর সিপিএমের আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠাই ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে তাদের লড়াইয়ের মূল কারণ।’ বিরোধীরা বলেন, বেলপাহাড়ি, জামবনির জঙ্গলমহলে সিপিআইএমের আধিপত্যবাদের রাজনীতির মুখ তখন বাসুদেব ভকত। কে তিনি?
জামবনির চুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা, পুরো ঝাড়গ্রাম তাঁকে চিনত বাসু ভকত নামে। তাঁর নেতৃত্বে সিপিআইএম বাহিনীর সঙ্গে ঝাড়খন্ডিদের লড়াইয়ের একটা অধ্যায় শেষ হল ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের দিন। একুশ শতকের প্রথম পঞ্চায়েত ভোট রাজ্যে। তখনও পিডব্লুজি’র সঙ্গে এমসিসি যুক্ত হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদী তৈরি হয়নি, তবে তার সলতে পাকানো শুরু হয়েছে। বাংলায় মাওবাদী কার্যকলাপের যে সূচনা লগ্ন, তার প্রাক্কালে জঙ্গলমহলে পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘটল এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড। যে ঘটনা জঙ্গলমহলে হত্যা-পাল্টা হত্যার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার।
পুরো জামবনি, বেলপাহাড়ি তখন জ্বলছে। একদল একটা খুন করে তো আর একদল পালটা একটা খুন করে। এরা কারও হাত কেটে নেয় তো ২৪ ঘন্টার মধ্যে ওরা কারও হাত কেটে নেয়। বাস্তবিকই এমন হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি তখন ঝাড়গ্রাম মহকুমার বিভিন্ন জায়গায়। থানা, পুলিশের মনোবল তলানিতে। এরই মধ্যে এগিয়ে আসছিল পঞ্চায়েত ভোট। ভোট কীভাবে করানো যাবে তা ভেবেই তখন রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পুলিশ প্রশাসনের। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার তখন কে সি মিনা। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজেশ সুবর্ণ। এসডিপিও ঝাড়গ্রাম বাস্তব বৈদ্য এবং ঝাড়গ্রাম থানার ওসি দীপক সরকার। ভোটের আগে এক-দেড় মাসে মধ্যে পরপর কয়েকটা খুন-পালটা খুন হল।
ঝাড়গ্রাম পুলিশ একটা চ্যালেঞ্জ নিল, ভোটের দিন কাউকে কোনও ঝামেলা করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সেই সময় ঝাড়গ্রাম মহকুমার যা অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি, এটা কঠিন কাজ। কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও বসতি, মাইলের পর মাইল ফাঁকা এলাকা, তার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সমস্ত বুথ। আর অস্ত্রে শান দিয়ে রয়েছে যুযুধান দু’পক্ষ, ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএম। এই পরিস্থিতিতে বিনা রক্তপাতে পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনা করা কার্যত অসম্ভব। ভোটের আগের দিন যতটা করা সম্ভব, খাতায়-কলমে যতটা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তা সম্পুর্ণ করে  প্রায় মাঝরাতে একটু বিশ্রাম নিতে গেল জেলা পুলিশ। ঘুমোতে নয়, তার সময় নেই আর। ভোর চারটে-সাড়ে চারটের মধ্যে রেডি হয়ে বেরোতে হবে। ভোটের আগের দিন সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের আলোচনায় ঠিক হল, ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজেশ সুবর্ণ থাকবেন বেলপাহাড়িতে এবং এসডিপিও বাস্তব বৈদ্য জামবনিতে। সিনিয়র অফিসাররা এলাকায় থাকলে কিছুটা সুবিধে। কিন্তু এই যে বিভিন্ন এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এটাও পুলিশ অফিসারদের একটা মানসিক সান্তনা মাত্র। নিরাপত্তা কখনও নিশ্ছিদ্র হয় না, জঙ্গলমহলে তো তা আরও অবাস্তব আইডিয়া।
সকাল থেকে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু হল গোটা রাজ্যে। এবং একই সঙ্গে প্রাক মাওবাদী যুগের ঝাড়গ্রামেও। সকাল সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা হবে। ল্যান্ডলাইনে ফোন বাজল জামবনি থানায় ওসির ঘরে। ঘরে তখন বসে এসডিপিও বাস্তব বৈদ্য। তিনিই ফোন তুললেন।
‘জামবনি থানা?’
‘হ্যাঁ, কে বলছেন?’
‘স্যার, গড়বেতা থেকে দুটো গাড়িতে ১০-১২ জন প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জামবনি গেছে ভোট করাতে। গাড়ির নম্বর দুটো লিখে নিন।’
‘আপনি কে বলছেন?’
‘স্যার, নাম বলতে পারব না। এটুকু বলছি, আমিও সিপিআইএম করি। গড়বেতায় থাকি। গড়বেতার সিপিআইএম অফিস থেকে দু’গাড়ি সশস্ত্র লোক আজ ভোরবেলা জামবনিতে গেছে। গাড়ির নম্বর বললাম। আপনি দেখে নিন।’
এই কয়েকটা কথা বলেই ফোন কেটে দিলেন ওই অপরিচিত ব্যক্তি। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এসডিপিও। বলে কী লোকটা! অবিলম্বে গাড়ি দুটোকে আটকাতে হবে। বাস্তব বৈদ্য বুঝে গেলেন, সিপিআইএমের গড়বেতা বাহিনীকে ধরতে না পারলে সর্বনাশ হবে আজ একটা। কিন্তু খবরটা কি ঠিক?
সেই সময় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের প্রায় একচ্ছত্র নেতা দীপক সরকার। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলা সম্পাদক। দীপক সরকারের বিরোধী একটা শিবিরও রয়েছে জেলাজুড়ে। তবে সংখ্যায় তাঁরা নগণ্য এবং স্বাভাবিকভাবেই দলীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট দুর্বল। দীপক সরকারের সবচেয়ে বিরোধী তখন সূর্যকান্ত মিশ্র। কিন্তু জেলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সূর্যকান্ত মিশ্র নিজেকে খুব একটা জড়াতেন না। এছাড়া দীপক সরকারের বিরোধী শিবিরের লোক বলে পরিচিত কেশপুরের কৃষকসভার নেতা তরুণ রায় আর ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ডহরেশ্বর সেন। প্রকাশ্যে জেলা সম্পাদক দীপক সরকার এবং তাঁর অনুগামীদের বিরোধিতা কেউ বিশেষ করতে পারতেন না ঠিকই, কিন্তু তা বলে সিপিআইএমের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রচণ্ড গোষ্ঠী কোন্দল গোপনও ছিল না। নয়ের দশক থেকেই মেদিনীপুর জেলায় দীপক সরকারের কী সর্বাত্মক প্রভাব ছিল তা বোঝার জন্য ২০১১ সালের একটা ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। সেই ঘটনার কথা বলেই ব্যাক করব ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের দিনে।

২০১১ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগের ঘটনা। সিপিআইএম রাজ্য দফতর সমস্ত জেলায় বার্তা পাঠাল বিধানসভা ভোটের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার সব আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম চেয়ে। এটাই ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বহু বছরের দস্তুর। খুব প্রয়োজন না পড়লে প্রার্থী তালিকা নিয়ে জেলা কমিটির প্রস্তাবের ওপর রাজ্য দফতর কখনই খুব একটা কাটাছেঁড়া করত না। পশ্চিম মেদিনীপুরে ১৯টি আসন। শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের প্রস্তাবিত প্রার্থীদের নাম নিলেন সিপিআইএম জেলা সম্পাদক। তারপর জেলার ১৯টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম পাঠালেন মুজফফর আহমেদ ভবনে। সেই তালিকা দেখে দলের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, মুখ্যমন্ত্রী এবং পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং আর এক শীর্ষ নেতা নিরুপম সেন তো হতবাক। ১৯ জনের তালিকায় ১৮ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম রয়েছে। নারায়ণগড় কেন্দ্রে প্রার্থীর নামের জায়গা ফাঁকা! সেই ১৯৮২ সাল থেকে নারায়ণগড়ের বিধায়ক সূর্যকান্ত মিশ্র। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, তার চেয়েও বড় কথা, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সিপিআইএমের সর্বোচ্চ কমিটির সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রর নাম না লিখে নারায়ণগড়ে প্রার্থীর জায়গা ফাঁকা রেখে তালিকা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দীপক সরকার। স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন রাজ্য নেতৃত্বকে, সূর্যকান্ত মিশ্র নারায়ণগড় কেন্দ্রে জেলা সিপিআইএমের অনুমোদিত প্রার্থী নন। তাই জায়গাটা ফাঁকা রাখা হল। রাজ্য পার্টি তাদের মতো নাম বসিয়ে নিতে পারে।
বিষয়টা জানতে সূর্যকান্ত মিশ্রর বেশি সময় লাগেনি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নেতৃত্বের এই ঔদ্ধত্যে তীব্র অপমানিত সূর্যকান্ত মিশ্র রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে জানিয়ে দেন, তিনি ভোটে লড়বেন না। সূর্যকান্ত মিশ্র কথা বলতেন কম, কিন্তু তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে সম্যক ধারণা ছিল সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের। সূর্যকান্ত মিশ্র খানিকটা মান্য করতেন নিরুপম সেনকে। তাঁকেই দেওয়া হল দায়িত্ব। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনরা রুদ্ধদ্বার ঘরে বারবার বোঝালেন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে। সূর্যকান্ত মিশ্র ভোটে না লড়লে রাজ্যজুড়েই ভুল বার্তা যাবে। এমন একটা কারণে তিনি ভোটে লড়তে চাইছেন না যা প্রকাশ্যে বলাও যায় না। তবে তো পার্টি শীর্ষ নেতৃত্বের গোষ্ঠী কলহের নগ্ন, জরাজীর্ণ চেহারার পলেস্তারাটা খসে পড়বে। জানাজানি হয়ে যাবে ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নিঃস্বার্থ ভাবমূর্তি গড়ে তোলা নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমীকরণ।
এদিকে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভোটে না লড়লে কী বার্তা রাজ্যজুড়ে যাবে তা ভালই বুঝতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, নিরুপম সেনরা। নিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কায় রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নির্বাচনে লড়ছেন না, বিরোধীদের এই প্রচারের মোকাবিলা করার মতো সাংগঠিক শক্তি বহু বছর আগেই চলে গিয়েছে। নিরুপম সেন লাগাতার বোঝালেন সূর্যকান্ত মিশ্রকে। বোঝালেন, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার্টির, আরও নির্দিষ্টভাবে দীপক সরকারের এই গোষ্ঠী রাজনীতির জন্য এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না যাতে দলের আশু ক্ষতি হয়। বরফ গলল, ২০১১র ভোটে লড়তে রাজি হলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। সমস্যার আশু সমাধান হল বটে, কিন্তু আসল ক্ষতটা থেকেই গেল। আসলে সমস্যাটা তো শুরু হয়েছিল সেই আটের দশকে। ২০১১ সালে এসে তা কীভাবে, কোন ম্যাজিকে এক মুহূর্তে কেটে যাবে?
ব্যাক টু ২০০৩। স্থান, জামবনি থানা। পঞ্চায়েত ভোট চলছে মোটামুটি নির্বিঘ্নে। কথা নেই, বার্তা নেই, আচমকা বজ্রপাতের মতো একটা টেলিফোন এল থানার ওসির ঘরে, গড়বেতা থেকে দুটো গাড়িতে চেপে সিপিআইএমের লোক ঢুকেছে জামবনিতে। আর এই এক ফোনেই তাল কেটে গেল ঝাড়গ্রাম পুলিশের। নিস্তরঙ্গ ভোটের সকালে আচমকা ঝড় উঠল জামবনি থানায়। ফোনটা আসার আগে পর্যন্ত সব কিছু স্বাভাবিকই ছিল। এক একটা বুথের সামনে লাইন। যেখানে জোর যার, সেখানে ভোট তার। এটাই তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ভোটের নিয়ম। থানায় বসে পুরো এলাকার খোঁজ নিচ্ছেন এসডিপিও। কোথাও কোনও গণ্ডগোলের খবর নেই। শুরুটা ভালো হয়েছে। প্রথম সাড়ে তিন-চার ঘন্টা ঠিকঠাক চলছে সব কিছু। সমস্ত বুথ থেকে ব্যালট পেপার বের করে ঝাড়গ্রামে না পৌঁছনো পর্যন্ত শান্তি নেই যদিও! তবু, মর্নিং শোজ দ্য ডে। কিন্তু হঠাৎই আসা একটা ফোনে এসডিপিও বুঝে গেলেন, গড়বেতা-চন্দ্রকোণার সশস্ত্র বাহিনী এলাকায় ঢুকে পড়েছে মানে ঝাড়খন্ডিদের শক্ত ঘাঁটিতে বুথ দখলের পরিকল্পনা করছে সিপিআইএম। এবং তার অনিবার্য পরিণতি সংঘর্ষ। আর মেদিনীপুরের পশ্চিম প্রান্তের জঙ্গলে ঘেরা এই রুক্ষ এলাকায় সংঘর্ষ মানেই একাধিক মৃত্যু, রক্তস্রোত। খুন-পালটা খুন।
সেই সময় থানায় উপস্থিত সামান্য কয়েকজন অধস্তন পুলিশ কর্মী, হোমগার্ডও ঠিকই বুঝতে পারলেন, কিছু একটা হয়েছে। সিনিয়র অফিসারদের চেহারাটা বদলে গিয়েছে এক মুহূর্তে। শান্ত, নিশ্চিন্ত ভাবটাই নেই আর।
গড়বেতা থেকে ফোনটা আসার পর মিনিট চার-পাঁচ চুপ করে বসে থাকলেন বাস্তব বৈদ্য। তারপর ওয়্যারলেসে খবর পাঠাতে শুরু করলেন সমস্ত টহলদারি পুলিশের গাড়িকে। এটা তো প্রায় প্রাক মোবাইল ফোনের যুগ। প্রায় বলার কারণ, মোবাইল ফোন এসেছে বটে। কিন্তু সবার হাতে নেই। আর থাকলেই বা কী? জঙ্গলের অধিকাংশ জায়গায় নেটওয়ার্কও নেই। খবর পাওয়া এবং দেওয়া এত সহজ নয় তখন। তবুও যতটা সম্ভব জামবনি এবং বেলপাহাড়ির সমস্ত বুথে ডিউটিরত পুলিশ এবং টহলদারি ফোর্সকে থানা থেকে জানিয়ে দেওয়া হল গড়বেতা থেকে পাওয়া গাড়ি দুটোর নম্বর। বলা হল, যত দ্রুত সম্ভব ধরতে হবে গাড়ি দুটোকে।
পুলিশ অফিসারদের খবর পাঠানোর পর বাস্তব বৈদ্য ফোনে ধরলেন রবি সরকারকে। রবি সরকার তখন ঝাড়গ্রামে সিপিআইএমের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং তাঁর একটা পরিচয়, তিনি জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের বিরোধী।
‘গড়বেতার দিক থেকে আপনাদের কিছু সশস্ত্র ছেলে দুটো গাড়ি করে ঝাড়গ্রামে ঢুকেছে শুনছি। আপনি কি কিছু জানেন?’ প্রতিটা মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ, সময় নষ্ট না করে সরাসরি রবি সরকারের কাছে জানতে চাইলেন ঝাড়গ্রামের এসডিপিও।
‘না তো। আমি কিছু জানি না।’

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #নয়

 

‘দেখুন, খোঁজ নিন। যদি জানা থাকে কিংবা জানতে পারেন এখনই উইথড্র করুন গাড়ি দুটোকে। কোনও বুথ দখল, গোলমাল কিন্তু বরদাস্ত করব না।’
‘সত্যিই আমার জানা নেই। তাছাড়া যদি এই খবর ঠিকও হয় আমাকে জানাবে না।’
আধ ঘন্টা-চল্লিশ মিনিট বাদে জামবনি থানায় খবরটা এল ওয়্যারলেসে। যে দুটো নম্বরের গাড়ির খোঁজে আকাশ-পাতাল তল্লাশি শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে একটার হদিশ মিলেছে। জামবনি থানা এলাকার দুবরা গ্রামে নম্বর মিলিয়ে একটি গাড়িকে আটক করেন মেদিনীপুর জেলা পুলিশের এক সাব ইন্সপেক্টর। কিন্তু সেখানে পুলিশের সংখ্যা ছিল কম। পুলিশ দেখেই গড়বেতার গাড়িটা থেকে নেমে কয়েকজন পালায়। পুলিশ তাদের মধ্যে দুজনকে ধরে ফেলে। সেই সঙ্গে গাড়ি থেকে উদ্ধার হয় একাধিক বন্দুক। তার মধ্যে একটা বন্দুকের লাইসেন্সও রয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টা বেজেছে, মাথার ওপরে গনগনে সূর্য। ভোটের বুথগুলোতে ভিড়টা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করছে। এবং নির্বাচন এখনও পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ। হিংসা-প্রতিহিংসার কোনও খবর নেই, কিন্তু মেদিনীপুরে ডিউটি করা যে কোনও পুলিশ অফিসারই জানেন, কঠিন সময় এবার শুরু হল। জঙ্গলের মাঝে অনেক দূরে দূরে বুথ। অধিকাংশই প্রায় ফাঁকা। রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র বাহিনীর বুথ দখল নেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ, পরিস্থিতি। গড়বেতা থেকে আসা সাদা বড় গাড়িটাকে দুপুর ১টার কাছাকাছি জামবনি থানায় নিয়ে এল পুলিশ। সঙ্গে আটক দুজন এবং বাজেয়াপ্ত পাঁচটি বন্দুক। একটা গাড়ি ধরা পড়েছে, আধ ঘন্টা আগে পাওয়া এই খবরে যতটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুশ্চিন্তাটা কয়েক গুণ বেড়ে গেল ঝাড়গ্রামের এসডিপিওর। কারণ, দ্বিতীয় গাড়িটা ধরা পড়েনি, এটা বড় কথা নয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, অন্য গাড়িটা রয়েছে খোদ বাসু ভকতের সঙ্গে।

চলবে

(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)

সাংবাদিকতা করতে চান? The Bengal Story চালু করছে Online Journalism Course: The Bengal Story Journalism Course: কারা শেখাবেন সাংবাদিকতা, কী আছে পাঠ্যক্রমে, কীভাবে রেজিস্ট্রেশন? জানুন বিস্তারিত

Comments are closed.