কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১২

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০০৩ পঞ্চায়েত ভোটের সন্ধ্যায় ঝাড়গ্রামের পাঁচামির জঙ্গলে ঝাড়খন্ডিদের অবরোধে গিয়ে থামল সিপিআইএম নেতা বাসুদেব ভকতের গাড়ি…

আটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই বেলপাহাড়ি, বিনপুর, জামবনির গ্রামে গ্রামে যে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক হিংসা এবং সংঘর্ষের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএমের মধ্যে, তাতে ২০০৩ পঞ্চায়েত ভোটের সন্ধ্যায় একশো বুথের ব্যালট বাক্স পেয়ে গেলেও ওই জমায়েতটা এত খুশি হোত না, যতটা তারা হয়েছিল বাসুদেব ভকতকে হাতের কাছে পেয়ে। ব্যালট বাক্সের গাড়ি ভেবে মহিলা এবং পুরুষদের ভিড়টা মুহূর্তের মধ্যে ঘিরে ফেলল সিপিআইএম নেতার গাড়ি। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একজন অন্ধকারেই চিনে নিলেন বাসু ভকতকে। এমন একজন বাসু ভকতকে চিনে ফেললেন, ঝাড়খন্ড পার্টি করার অপরাধে যাঁর বাড়ি কয়েকদিন আগে পুড়িয়ে দিয়েছিল সিপিআইএম বাহিনী। তাঁকে দেখেই তিনি চিৎকার করতে শুরু করেন, কেন তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। হতভম্ব বাসু ভকত কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিল সশস্ত্র ঝাড়খন্ডিরা। সিটের পাশে রাখা রিভলভার হাতে তোলার সময়ই পেলেন না তিনি। গাড়ির চালক এবং পেছনের সিটে বসে থাকা দুই দলীয় কর্মী কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাসু ভকতকে মারতে মারতে পাঁচামির জঙ্গলের ভেতরে টেনে নিয়ে গেল ঝাড়খন্ডিরা। বাসু ভকতকে হাতের সামনে পেয়ে যাওয়ায় মুহূর্তের উত্তেজনায় গাড়ির বাকিদের গায়ে হাতও দিল না তারা। গাছের গুঁড়ি সরিয়ে বাসু ভকতকে ছাড়াই তাঁর গাড়ি রওনা দিল জামবনিতে সিপিআইএম পার্টি অফিসের দিকে।
এর পরের ঘটনা ভয়ঙ্কর। বল্লম, তীর দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হল বাসু ভকতকে। তারপর মাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে তীর ছোঁড়া হল তাঁর বুকে। ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত বাসু ভকতের মৃতদেহ পড়ে রইল পাঁচামির জঙ্গলে। বাসু ভকতের মৃতদেহে সর্বত্র প্রতিশোধের চিহ্ন স্পষ্ট। জঙ্গলমহলে হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতিতে একটা বৃত্ত সম্পুর্ণ হল! কিন্তু বৃহত্তর কিছু প্রশ্ন তুলে দিল ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সন্ধ্যায় বাসু ভকতের হত্যা। জামবনির একইসঙ্গে জনপ্রিয় এবং দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতার খুন ক্রিয়া না প্রতিক্রিয়া?
সিপিআইএম নেতা এবং জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদক বাসুদেব ভকতের মৃত্যু সামান্য একটা খুন ছিল না ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের দিন। আসলে ২০০৩ এর পঞ্চায়েত ভোটের দিন রাজ্যের তিনটে জেলায় সকাল থেকে পৃথক পৃথক বিরোধী দলের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংঘর্ষ হচ্ছিল সিপিআইএমের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর, কুলতলি, ক্যানিং এলাকায় সিপিআইএমের সঙ্গে মারাত্মক সংঘর্ষ হয় এসইউসিআইয়ের। মুর্শিদাবাদের ডোমকলসহ বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হয় সিপিআইএমের সঙ্গে কংগ্রেসের এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ড পার্টির। গ্রাম পঞ্চায়েত এবং জেলা পরিষদের আসনে বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকবে না এবং রাজ্যজুড়ে নিজেদের এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করাই তখন সিপিআইএমের একমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য। জ্যোতি বসু তখন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দলে এবং সরকারে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রভাব সেই সময় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রসে তৈরির পর আচমকা একটা রাজনৈতিক ধাক্কার মুখোমুখি হয়েছিল বটে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। সরকার থাকবে কিনা সেই প্রশ্নও উঠে গিয়েছিল সিপিআইএম নেতৃত্বের একটা বড়ো অংশের মধ্যে। কিন্তু ২০০১ বিধানসভা ভোটে তা সামলে ওঠা গেছে। আর সেই বিধানসভা ভোটে ‘হয় এবার, নয় নেভার’ স্লোগান তুলে বিপর্যস্ত হওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেসের তখন এমনই ৩০ রানে আট উইকেট অবস্থা, ২০০৩ পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের বহু গ্রামে তারা প্রার্থীই দিতে পারল না। প্রায় বিরোধীহীন দক্ষিণবঙ্গে সিপিআইএমের অশ্বমেধের ঘোড়াকে যে দু’তিনটে পয়েন্টে এসইউসিআই, কংগ্রেস কিংবা ঝাড়খন্ড পার্টি থামানোর চেষ্টা করেছে, সেই এলাকাই রক্তাক্ত হয়েছে। কিন্তু ওই পঞ্চায়েত ভোটের দিন মুর্শিদাবাদের ডোমকল কিংবা দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর, কুলতলিতে কংগ্রেস এবং এসইউসিআইয়ের সঙ্গে লড়াইয়ের থেকেও ঝাড়গ্রামে ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের লড়াইয়ের একটা মৌলিক ফারাক ছিল। ডোমকল, জয়নগর কিংবা কুলতলিতে বিরোধীদের কাছে লড়াইটা ছিল কয়েকটা মাত্র গ্রাম পঞ্চায়েত দখলের, আর ঝাড়গ্রামে লড়াইটা ছিল এলাকা দখলের। তাই সেদিন সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদক বাসু ভকতের নৃশংস খুন মামুলি একটা ব্যাপার ছিল না। কারণ, বাংলায় বিরোধী মতের গলা টিপে ধরার ঐতিহ্য শত পুষ্পে বিকশিত হয়েছিল ২০০১ এর বিধানসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে দু’বছর পরের পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত। বাসু ভকতের মৃত্যু কারণ সন্ধানে এবার আমার ডেস্টিনেশন ঝাড়গ্রামের জামবনি ব্লক।
কারণ, কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের সন্ধান করতে হলে সিপিআইএম নেতা বাসুদেব ভকতের হত্যার কারণও জানা জরুরি। পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে আটের দশকের গোড়া থেকে তীব্র আন্দোলন শুরু না হলে যেমনভাবে ঝাড়গ্রামে বাসু ভকতের নেতৃত্বে সিপিআইএমের আধিপত্যবাদের রাজনীতির দরকার পড়ে না, তেমনই বাসু ভকত না থাকলে মাওবাদীদের নির্বিচারে ব্যক্তি হত্যার রাজনীতিও জঙ্গলমহলে সামাজিক স্বীকৃতি পায় না একটা সময় পর্যন্ত। কিন্তু বাসু ভকতদের রাজনীতির মতোই কিষেণজির নেতৃত্বে লালগড় আন্দোলনে এই ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি যে মাওবাদীদের সাংগঠনিকভাবে কতটা দুর্বল করতে পারে একটা বড়ো প্রমাণ ২৪ নভেম্বর ২০১১। সেই জামবনি, যেখানে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতা বাসু ভকতকে ২০০৩ সালে খুন হতে হয়, সেই জামবনিই সাক্ষী থাকে ২০১১র নভেম্বরে আরও এক মৃত্যুর! মাঝে মাত্র আট বছরের ব্যবধান।

 

বাসু ভকত, মোহিনী ষড়ঙ্গী এবং তিন ইঞ্চি বনাম ছ’ইঞ্চি টাঙি 

‘কনকদুর্গা মন্দির দেখেননি? যান, দেখে আসুন একবার।’
‘কিন্তু আমি তো পুজো দিই না, ভক্তিও নেই।’
‘পুজো দেওয়ার কী দরকার? স্রেফ ঘুরে আসুন। ঝাড়গ্রামে ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের ক্লান্তিহীন রক্তাক্ত সংঘর্ষের যে ইতিহাস, তার এপিসেন্টার হচ্ছে জামবনি এবং বেলপাহাড়ি। আর এই ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কনকদুর্গা মন্দির। এই মন্দিরের পুজো, পুরোহিত, ট্রাস্টি বোর্ড সব কিছুই জড়িয়ে রয়েছে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএমের সংঘর্ষের সঙ্গে।’
যাঁর সঙ্গে আমার এই কথা হচ্ছিল তাঁর নাম, পরিচয় এই লেখায় উল্লেখ করতে পারলে ভালো হোত। কিন্তু তিনি রাজি নন। কারণ, তিনি সরকারি চাকরি করেন। চাকরি সূত্রে বহু বছর ধরে রয়েছেন ঝাড়গ্রামে। সেই নয়ের দশকের শুরু থেকে। চোখের সামনে দেখেছেন বহু ঘটনা। শুধু এটুকুই বলতে পারি, তিনি রাজ্য পুলিশে চাকরি করেন। তিনি যেভাবে আমাকে জঙ্গলমহলে তাঁর চাকরি জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, হুবহু সেভাবেই সেই ইতিহাস লিখব। কিষেণজি মৃত্যু রহস্য মামলায় আমার পরের সাক্ষী, নাম লেখা যাবে না এমন এক পুলিশ অফিসার।
‘জামবনি, বেলপাহাড়ির একদিকে বিহার। তখনও ঝাড়খন্ড তৈরি হয়নি। কিন্তু আলাদা রাজ্যের সেই দাবি ছিল অনেক পুরনো। আটের দশকের একদম শুরু থেকে শিবু সোরেন আলাদা রাজ্যের জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করলেন। আদিবাসী সমাজের ‘‘গুরুজি’’ শিবু সোরেন খুব তাড়তাড়ি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন এ’রাজ্যের আদিবাসীদের মধ্যেও। বিনপুরে এসে মিটিংও করলেন তিনি। মাত্র কয়েক বছর আগে রাজ্যে সিপিআইএম সরকার হয়েছে। সিপিআইএম তখন ঝাড়গ্রাম মহকুমায় দ্রুত প্রভাব বিস্তারে মন দিয়েছে। পুরো রাজ্যের মতোই ঝাড়গ্রামেও কোণঠাসা হতে শুরু করেছে কংগ্রেস। কিন্তু বাকি রাজ্যের থেকে এখানে অবস্থাটা ছিল অনেকটা আলাদা। শিবু সোরেন এখানে এসে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরের খড়গপুর পর্যন্ত এলাকাকে পৃথক ঝাড়খন্ড রাজ্যে অর্ন্তভূক্তির যে দাবি তুললেন, তা বিনপুর, বেলপাহাড়ি, জামবনির আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলল। নরেন হাঁসদা ছিলেন বিনপুরের ঝাড়খন্ডি নেতা। তিনিও বাড়তি জোর পেলেন গুরুজির আন্দোলনে। এই সুযোগেরই যেন অপেক্ষায় ছিল কংগ্রেস। নড়বড়ে, দুর্বল কংগ্রেস জড়ানো লতার মতো আঁকড়ে ধরল ঝাড়খন্ড পার্টিকে। রাজ্যে দীর্ঘদিন সরকার চালানো কংগ্রেসের নিচুতলায় একটা জনভিত্তি ছিলই, আর ছিল জোতদার, জমিদারদের সরাসরি সমর্থন। কিন্তু ১৯৭৭ সাল থেকে সিপিআইএমের জমি আন্দোলন রাজ্যজুড়ে গরিব, প্রান্তিক মানুষের মধ্যে যে গণ উন্মাদনা তৈরি করেছিল, তা মোকাবিলার কোনও রাস্তা কংগ্রেসের জানা ছিল না। এই রাস্তারই হদিশ কিন্তু কংগ্রেস পেয়ে গেল ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। নির্দিষ্টভাবে বললে জামবনি, বেলপাহাড়ি, বিনপুরে। কারণ এই এলাকাগুলোতে গরিব আদিবাসীদের মধ্যে ঝাড়খন্ড পার্টি তখন ব্যাপক প্রভাব তৈরি করে ফেলেছে। আটের দশকের শুরু থেকে সরাসরি ঝাড়খন্ডিদের হাত ধরে ঝাড়গ্রাম মহকুমার দু’তিনটে ব্লকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল রাজ্যে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হতে বসা কংগ্রেসের। জোট হল ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের। বলতে গেলে রাজ্যে সিপিআইমের বিরুদ্ধে প্রথম কোনও রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী সমঝোতার পরীক্ষাগারের নাম জামবনি, বিনপুর এবং বেলপাহাড়ি। এরপর তা আস্তে আস্তে ছড়াল আরও কিছু ব্লকে।
স্বাভাবিকভাবেই ১৯৭৭ সালের পর থেকে ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সংগঠন বৃদ্ধিতে সিপিআইএম সবচেয়ে বড় বাধা পেল জামবনি, বেলপাহাড়ি এবং বিনপুরে। এবং এই বাধা ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠল রাজ্যের শাসক দল। সিপিআইএমের তখন জামবনির নেতা বাসুদেব ভকত। জামবনির চুটিয়া গ্রামে বাড়ি। মোটামুটি আটের দশকের শুরু থেকেই ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের তীব্র সংঘর্ষ শুরু হল জামবনিকে কেন্দ্র করে বেলপাহাড়ি, বিনপুরে। রোজ মারপিট, রোজ বাড়ি জ্বালানো। লাইন দিয়ে পরপর ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থক গরিব মানুষের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া ছিল সিপিআইএমের মূল মোডাস অপারেন্ডি। নাম বলব না, কিন্তু পরে সিপিআইএমের এক নেতাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘আপনারা বিরোধীদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন কেন? এই জিনিস তো আগে কখনও ছিল না। রাজনৈতিক মারপিট, খুনোখুনি দেখেছি, শুনেছি, কিন্তু লাইন দিয়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কারণটা কী?’’
ওই সিপিআইএম নেতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। বলেছিলেন, ‘‘গরিব মানুষের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে সে নিজে থেকে আর তা তৈরি করতে পারবে না। সাহায্যের জন্য তাকে যেতে হবে পঞ্চায়েত অফিসে। আর পঞ্চায়েত তো চলে আমাদের পার্টি অফিস থেকে। বাড়ি বানানোর জন্য পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা দিত পার্টি, কিংবা অন্য কোনওভাবে সাহায্য করত। তার বদলে শর্ত একটাই, ঝাড়খন্ড পার্টি করা যাবে না। সিপিআইএম করতে হবে।’’
শাসক দলের এই কৌশল শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি বিরোধীদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া সমর্থন আদায়ের কোনও ট্যাকটিকাল লাইনও হতে পারে।’ টানা বলে থামলেন ওই অফিসার।
সাংবাদিকতার সূত্রে বাংলার বহু গ্রামে গিয়েছি ১৯৯৮ সাল থেকে। অনেক নির্বাচন দেখেছি। দেখেছি রাজনৈতিক একাধিপত্য কাকে বলে। দেখেছি বিরোধী শূন্য নির্বাচন কিংবা বিরোধী এজেন্টহীন শয়ে শয়ে বুথের ভেতরের ছবিও। সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস, দুই জমানাতেই। রাজনৈতিক মারপিট, সংঘর্ষ, খুনোখুনির ঘটনাতেও গিয়েছি অনেক। কিন্তু রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, বিরোধী মনোভাবাপন্ন গরিব মানুষকে নিজের দলে টানতে শাসক দলের কৌশলের যে বিবরণ মেদিনীপুরে দীর্ঘ দিন কাজ করা এক পুলিশ অফিসার আমাকে দিলেন, তা আমার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। অথচ বিরোধীদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা তো রাজ্যের বহু জায়গায় আমি দেখেছি, নন্দীগ্রামেও দেখেছি। কিন্তু এই মডেলের আঁতুড়ঘর কোথায়, কবে, কীভাবে, তার কোনও আইডিয়াই ছিল না আমার। কোনওদিন ভাবতে পারিনি এমন কৌশলও মানুষের মাথা থেকে বেরোতে পারে! অবশ্য মানব সমাজেই তো এমন রাজত্ব চলে, যাকে বৈধতা দিতে আমরা তার নাম দিয়েছি, ‘জঙ্গলের রাজত্ব’৷ যদিও এলাকা দখলের জন্য এমন নৃশংস হিংসা-প্রতিহিংসা জন্তু, জানোয়াররা প্র্যাকটিস করে না।
ওই পুলিশ অফিসারের কথা শুনে ভাবছিলাম, এ তো এক অদ্ভুত মডেল। গরিব মানুষকে বিপদে ফেলে, সর্বস্বান্ত করে, আবার তাকেই কিছু পাইয়ে দেওয়া। আর এই পাইয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে দিন দিন ধরে একটা সিলেক্টিভ বেনিফিশিয়ারি শ্রেণি তৈরি করা। মোদ্দা কথা, মানুষকে সব সময় পার্টির ওপর নির্ভরশীল রাখতে হবে। কখনও ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা দিতে হবে। বার্ধক্য ভাতা, জব কার্ড, বেকার ভাতা, একশো দিনের কাজের তালিকা, আরও কত কী…। হাসপাতালে ভর্তি থেকে স্কুলে অ্যাডমিশন, মানে পার্টি অফিস। চাকরিতে পার্টির সুপারিশ। তারও পরের ধাপ নিজের লোককে সরকারি প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারি পাইয়ে দেওয়া। এই যে নানান শ্রেণির মানুষের হাড়ে-মজ্জায় কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি করে একটা আপাদমস্তক সুবিধেভোগী সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করার মডেলের উৎস সন্ধানে বহু ভেবেছি। ভেবেছি, কবে, কীভাবে শুরু হয়েছিল এই ব্যবস্থার, যেখানে অধিকাংশ মানুষ মনে করতে শুরু করেছিলেন, প্রশাসন তুচ্ছ। পার্টিই সব। পার্টির সঙ্গে থাকলে সব মিলবে। বদলে নিঃশর্ত আনুগত্য ছাড়া পার্টি চাইবেও না কিছু। আটের দশকের মাঝামাঝি জামবনি কিংবা বিনপুরের গরিব ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থকের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে তারই জন্য ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন সিপিআইএমের যে জেলা নেতারা, তাঁরা নিশ্চই ভাবেননি, এই সিলেক্টিভ বেনিফিশিয়ারি নীতি কীভাবে রাজ্যজুড়ে ব্যুমেরাং হয়ে উঠবে উদার অর্থনীতি চালুর দেড় দশক বাদে। কিন্তু ভাবেননি তো আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারাও! তাঁরা তখন রাজ্যজুড়ে শক্তিবৃদ্ধির চিন্তায় মশগুল। কীভাবে হবে শক্তিবৃদ্ধি, কোন পথে হবে, তা ভাবার মতো কষ্টসাধ্য কাজ করার সময় তখন মুজফফর আহমেদ ভবনের ছিল না। সরকার হয়েছে আট-দশ বছর! তাকে অন্তত ৩৪ বছর ছোটাতেই হবে। জামবনি, বেলপাহাড়িতে একের পর এক বিরোধীকে খতম করে সিপিআইএম যখন সর্বশক্তিমান এক ভাবমূর্তি গড়ায় ব্যস্ত, তখন তো আর কেউ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে গিয়ে সাবধানবাণী শুনিয়ে আসেননি, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে…।
হ্যাঁ, আটের দশকের মাঝামাঝি কিংবা শেষদিক থেকে মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম প্রান্তে গোকুলেই বাড়ছিল মাওবাদীরা। কিন্তু শাসক দল সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ডিদের লড়াইটা শেষমেশ একুশ শতকের গোড়ায় এসে কীভাবে মাওবাদীদের সঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পার্মানেন্ট লড়াইয়ে কনভার্ট করে গেল, সেই ঘটনায় আসব পরে। আপাতত কথা হচ্ছিল সেই পুলিশ অফিসারের সঙ্গে, যিনি ২০১৭ সালের মাঝামাঝি শোনাচ্ছিলেন নয়ের দশকে তাঁর ঝাড়গ্রামে কাজের অভিজ্ঞতা। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাসুদেব ভকতের মৃত্যুর ঘটনা, ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষের ঘটনা তো শুনলাম। কিন্তু এই যে ২০০৩ পঞ্চায়েত ভোটের দিন বাসু ভকত খুন হয়ে গেলেন, এর সলতে পাকানোটা স্পেসিফিক কবে, কীভাবে শুরু হয়েছিল? বাসু ভকতকে এই দলবদ্ধভাবে খুন তো ছোটখাট ব্যাপার ছিল না একটা। এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা বোঝার মতো বোধবুদ্ধি নিশ্চয় ছিল ঝাড়খন্ড পার্টির নেতৃত্ব এবং জামবনির সিপিআইএম বিরোধী মানুষের!’
‘দেখুন, সিপিআইএমের লড়াইটা শুরু হয়েছিল জোতদারদের সিলিং বহির্ভূত জমি দখলকে কেন্দ্র করে। সেটাই আস্তে আস্তে রাজনৈতিক জমি দখলের সংঘর্ষ টার্ন করে গেল। নয়ের দশকের শুরু থেকে বলা যায় এই সমস্ত এলাকায় নির্বাচন বলে কিছু হোত না। মূলত পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের লড়ার ওপর মোটামুটি নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছিল সিপিআইএম। জামবনিতে বাসু ভকতের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মূল কথাই ছিল, বিরোধী দল, মানে ঝাড়খন্ড পার্টি করা যাবে না। সিপিআইএম করলে সব মিলবে। বাসু ভকত নিজে দাঁড়িয়ে অনেক গরিবের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কেউ পড়তে পারছে না টাকার অভাবে, বাসু ভকত টাকা জোগাড় করে পড়িয়েছেন এমন উদাহরণ জামবনিতে প্রচুর। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি সমস্ত সাহায্য পাওয়ার একমাত্র মাপকাঠি ছিল সিপিআইএমের সঙ্গে যুক্ত থাকা। সরাসরি সিপিআইএম না করলেও চলত, কিন্তু ঝাড়খন্ড পার্টি করা যাবে না কিছুতেই। মনে আছে, নয়ের দশকের শুরুতে পঞ্চায়েত ভোটে জামবনির ১০টা অঞ্চলে বিরোধীরা কোনও প্রার্থী দিতে পারেনি। একটা মাত্র সিটে ঝাড়খন্ড পার্টির হয়ে একজন দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর ওই প্রার্থী আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। রাস্তাতেই খুন হয়ে যান।
১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির পর অবস্থা সাময়িকভাবে কিছুটা পাল্টাল। গোটা রাজ্যে তো বটেই, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল মেদিনীপুর জেলায়। জামবনি, বেলপাহাড়ি থেকে শুরু করে কেশপুর, গড়বেতা, শালবনি, পিংলা, পাঁশকুড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সিপিআইএমের বিরুদ্ধে একটা বহুদলীয় জোট তৈরি হল। রাজ্য বা জাতীয় স্তরে কোন দলের সঙ্গে কার জোট হচ্ছিল সেটা তখন বড়ো কথা ছিল না এই জেলায়। একেবারে গ্রাম স্তরে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, ঝাড়খন্ডি, বিজেপি সমস্ত দলের সমর্থক এবং ভোটার মোটামুটি এক হয়ে গেল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে। যেখানে যার যা শক্তি ছিল সেখানে তারা সেভাবে ঐক্যবদ্ধ লড়াই শুরু করল। শাসক দল বিরোধী এই জোট শক্তিশালী হতে শুরু করল মূলত ১৯৯৮ এর পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোটের পর থেকে। যেখানে যেখানে নিচুতলায় বিরোধীদের পায়ের তলার জমি শক্ত ছিল, সেখানেই মারাত্মক সংঘর্ষ হল। আর পুরো মেদিনীপুরের মধ্যে একমাত্র ঝাড়গ্রাম মহকুমাতেই বিরোধী দলের পেছনে সাধারণ গরিব মানুষের সমর্থন সবচেয়ে বেশি ছিল। আর কিছুটা ছিল কেশপুরে। ২০০০ সালের শুরু কিংবা মাঝামাঝি থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম, সিপিআইএম যেভাবে শক্তি সংহত করছে কেশপুর, গড়বেতা কিংবা পিংলায় বিরোধীরা বেশিদিন লড়াই করতে পারবে না। পারলও না একটা সময়ের পর। কিন্তু ঝাড়গ্রামের জামবনি, বেলপাহাড়ি, বিনপুরে গরিব আদিবাসীদের মধ্যে ঝাড়খন্ডিদের প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। তাই ২০০১ বিধানসভা ভোটে বিরোধী জোট পুরো মেদিনীপুর জেলা এবং রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়লেও, ঝাড়গ্রাম মহকুমায় কিন্তু তা হল না। আর সেই কারণেই ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআইএম সরকার প্রতিষ্ঠার পর মেদিনীপুর এবং পুরো রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, হিংসা বন্ধ হলেও, জামবনি, বেলপাহাড়িতে তা থামছিল না। সিপিআইএমও বুঝতে পারছিল, পুরো জেলা দখল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জঙ্গলমহল তাদের পলিটকাল ম্যাপের বাইরে থেকে গিয়েছে। তাই ২০০১ বিধানসভা ভোটের পরও ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষ ছিল প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। খুন-পালটা খুন, হিংসা-পাল্টা হিংসা। আর নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে জঙ্গলমহলের রাজনৈতিক সংঘর্ষে আমদানি হল আগ্নেয়াস্ত্রের। আদিবাসীরা এমনিতে লড়াই করত তীর, ধনুক আর টাঙি দিয়ে। ওদের ট্র্যাডিশনাল অস্ত্র।
কিন্তু বিহার লাগোয়া একটা এলাকায় যদি দিন-রাত সংঘর্ষ, খুনোখুনি চলতে থেকে তবে বন্দুকের ব্যবহার আর কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে। বিহার থেকে আসতে শুরু করল বন্দুক। টাঙি, তীর, ধনুকের লড়াইয়ে সিপিআইএম বাহিনী ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে খুব একটা এঁটে উঠতে পারত না।
এই তীব্র লড়াই, সংঘর্ষের মধ্যেই এগিয়ে আসছিল পঞ্চায়েত ভোট, ২০০৩। গ্রাম বাংলায় আপনি দেখবেন লোকসভা কিংবা বিধানসভার থেকেও পঞ্চায়েত ভোটে উত্তেজনা বেশি থাকে। পঞ্চায়েতগুলোর হাতে প্রচুর টাকা আসার পর এই প্রবণতাটা শুরু হয়েছে। সবাই জানত, পঞ্চায়েত দখল করতে পারলে প্রচুর কাজের, কাজ পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ। কারণ, গ্রাম পঞ্চায়েতই তখন প্রকৃত অর্থে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। আর যেখানে রাজনৈতিক শক্তি সমানে-সমানে, সেখানে পঞ্চায়েত দখল করতে একমাত্র রাস্তা অস্ত্র।
সেদিন ছিল ২০০২ সালের ২৬ অক্টোবর। একদম সকাল সকাল একটা খুন হল জামবনির জামুই গ্রামে। দিবাকর মালাকার নামে এক স্থানীয় সিপিআইএম নেতা তাঁর দুই সঙ্গী মানিক শতপথী এবং হেনা শতপথীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে যাচ্ছিলেন। সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে। দিবাকর মালাকার ছিলেন বাসু ভকতের অনুগামী এবং এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী নেতা। অত সকালে আক্রমণ হতে পারে ভাবতে পারেননি। খুব কাছ থেকে দিবাকর মালাকারকে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল দিবাকর মালাকারের। কিন্তু তাঁর দুই সঙ্গীর কিচ্ছু হয়নি। তাঁদের আক্রমণও করেনি দুষ্কৃতীরা। মানিক এবং হেনা পালিয়ে গেলেন মোটরসাইকেলে চেপে। দিবাকর রাস্তায় পড়ে থাকলেন জখম অবস্থায়। দলীয় অফিসে গিয়ে দিবাকর মালাকারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দিলেন মানিক এবং হেনা। পরে জানা যায়, ঝাড়খন্ডিরাই খুন করেছিল দিবাকর মালাকারকে।’ টানা বলে থামলেন ওই পুলিশ অফিসার। থামলেন, কারণ আমিই থামালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আপনি কনকদুর্গা মন্দিরে যেতে বললেন কেন? কনকদুর্গা মন্দিরের সঙ্গে কী সম্পর্ক বাসু ভকতের খুনের?
‘দেখুন সম্পর্ক সরাসরি নেই, আবার আছেও। আসলে জামবনির একটা প্রাচীন ইতিহাস আছে। যে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কনকদুর্গা মন্দির, সেখানকার পুজো, পুরোহিত। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এখানকার আদি মানুষের লড়াই-সংগ্রাম। আপনি তো ডুলুং নদী দেখেছেন। বহু বহু বছর আগে এখানকার সমস্ত এলাকা দুটো রাজ পরিবারের অধীনে ছিল। ডুলুং নদীর পূর্ব প্রান্ত ছিল ঝাড়গ্রামের মল্লদেব রাজাদের অধীনে আর পশ্চিম প্রান্ত ছিল ধলভূমগড়ের রাজা ধবলদেবদের অধীনে। এখনকার যে জামবনি এলাকা তা ছিল প্রাক ব্রিটিশ যুগে রাজা ধবলদেবদের অধীনে। রাজা ধবলদেবরাই প্রায় তিনশো বছর আগে চিল্কিগড়ে এই কনকদুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস চর্চায় যাব না বেশি। জামবনির এই কনকদুর্গা মন্দিরে পুজো করতেন এক ষড়ঙ্গী পরিবার। জামবনির দুবরা গ্রামে বাড়ি। পুরনো পরিবার। ধলভূমগড়ের রাজাদের আমলের জমিদার ছিলেন ষড়ঙ্গীরা। অনেক সম্পত্তি ছিল। আমি নিজে দেখিনি, শুনেছি ছয়-সাতের দশকে এই পরিবারের এক কর্তা শম্ভুনাথ ষড়ঙ্গী কনকদুর্গা মন্দিরে এমন চন্ডি পাঠ করতেন, গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ত তা শোনার জন্য। দুবরার ষড়ঙ্গীরা ছিলেন আদি কংগ্রেসি পরিবার। স্বাধীনতার আগে থেকেই। আর স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস আমলে এই পরিবারের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল জামবনিতে। অনেক জমি-জায়গা ছিল। সেই আমলে বাড়ি ছিল অনেকগুলো। ষড়ঙ্গীরা যেহেতু কংগ্রেস করতেন, ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ ছিল যথেষ্টই।

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃ্ত্যু রহস্য #এগারো

তো সেই ২৬ অক্টোবর দিবাকর মালাকার খুনের পর তাঁর দুই সঙ্গী মানিক এবং হেনা সিপিআইএম পার্টি অফিসে গিয়ে খবর দিলেন। তারপর লোক জমায়েত হতে যতক্ষণ, জামবনিজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল বাসু ভকতের বাহিনী। বছর শেষ হলেই পঞ্চায়েত ভোট। তার আগে সক্কাল সক্কাল দিবাকর মালাকারের মতো ওজনদার নেতার খুন সিপিআইএমের কাছে যত বড় না সাংগঠনিক ধাক্কা, তার থেকেও বড়ো ছিল পার্টির শক্তিশালী ইমেজকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। সিপিআইএম জানত, জামবনিসহ জঙ্গলমহলের রাজনীতিতে দুর্বলের কোনও জায়গা নেই। একটা খুন করে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে ঝাড়খন্ডি-কংগ্রেস জোট। সুদে-আসলে তার বদলা না নিলে এলাকায় সর্বশক্তিমান ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এই ক্ষতির মূল্য চোকাতে হবে জামবনির একাধিপত্য হাতছাড়া করে। তাছাড়া সদ্য গড়ে ওঠা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম প্রান্তের ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সিপিআইএমের ট্যাকটিকাল লাইন তা অনুমোদনও করে না। অর্থাৎ, পালটা খুন। হিংসার বদলে হিংসা। ছাড়া যাবে না এক ইঞ্চি জমিও।
সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ জামুইয়ে দিবাকর মালাকার খুন হলেন। এক থেকে দেড় ঘন্টা লাগল সিপিআইএমের রেডি হতে। প্রথম টার্গেট তিন কিলোমিটার দূরের দুবরা গ্রাম। দুবরা বেছে নেওয়ার কারণ, এখানেই প্রভাবশালী এবং সমৃদ্ধ কংগ্রেস পরিবার ষড়ঙ্গীদের বাড়ি। সিপিআইএমের ৩০-৪০ জনের একটা বাহিনী সকাল সাড়ে নটা নাগাদ ঢুকল দুবরায়। সবাই সশস্ত্র। শুরু হল বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। দিবাকর মালাকারের সম্ভাব্য খুনির খোঁজে। ঠিক সেই সময় চাষের জমি থেকে বাড়ি ফিরছিলেন ষড়ঙ্গী পরিবারের এক কর্তা মোহিনীমোহন ষড়ঙ্গী। তখন তাঁর বয়স ৭২ বছর।’
এর পরের ঘটনাও বলেছিলেন ওই পুলিশ অফিসার। কিন্তু সেই ঘটনা আমি লিখব মোহিনীমোহনের ছেলে প্রসূন ষড়ঙ্গীর মুখে। ওই পুলিশ অফিসার এবং প্রসূন ষড়ঙ্গীর বর্ণনায় বিশেষ কিছু অমিল নেই। প্রায় এক। কিন্তু জামবনিসহ ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ডি এবং কংগ্রেসের দীর্ঘ লড়াইয়ে প্রসূন ষড়ঙ্গীও এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাই এই লেখায় প্রসূন ষড়ঙ্গীর এন্ট্রি জরুরি। সেদিন কী ঘটেছিল জামবনির দুবরা গ্রামে তা এবার শুনব প্রসূন ষড়ঙ্গীর মুখে। তিনি এই জামবনির ইতিহাস চর্চায় আর এক সাক্ষী।

চলবে

(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বের মাঝে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)

Comments are closed.