অনন্য উদ্যোগ, নিজেদের পুজোর সঙ্গে আমপান বিধ্বস্ত সুন্দরবনে পুজোর দায়িত্ব নিল কুমোরটুলি সার্বজনীন

জীবন যখন হেরে যায় মৃত্যুর কাছে, শিল্পীর সৃষ্টি বোধহয় তখনই অমরত্ব লাভ করে।এই স্বার্থপর পৃথিবীতে সবাই যখন প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন নীরবেই কিছু মানুষ জীবনের এক অন্য দিক খুঁজে নিচ্ছেন অসহায় মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে। এই ছন্দহীন পৃথিবীতে মাতৃপক্ষের সূচনার প্রভাতে নতুন করে মহালয়ার আগমনীর বার্তা নিয়ে আসছে ‘কুমোরটুলি সার্বজনীন’।
কুমোরটুলি সার্বজনীনের এই বছরের পুজো ৯০ তম বর্ষ। অতীতের অনেক ঐতিহ্য বহনকারী এই পুজো এই  বছর পুজোতে এক অনন্য উদ্যোগ নিয়েছে। কুমোরটুলির কনভেনার দেবাশিস ভট্টাচার্যের ভাষায়, ‘কুমোরটুলির এই বছরের পুজো দায়বদ্ধতার পুজো’। এই আকালের দিনে সমস্ত পুজো কমিটি যখন নিজেদের পুজো করতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে তখন কুমোরটুলি সার্বজনীন একসঙ্গে দুটি পুজো করছে। প্রথমে মহামারি ও পরে আমপানের ফলে বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলের অবস্থা খুবই খারাপ। সেই অসহায় মানুষদের কথা মাথায় রেখে সুন্দরবনের কুলতলি থানার শ্যামনগর গ্রামে কুমোরটুলি সার্বজনীন আরও একটি পুজো করছে। এটা ভাঙাচোরা জীবনে ওঁদের নতুন করে ঘর বাঁধতে সাহায্য করার চেষ্টা মাত্র বলেই দেবাশিসবাবু জানাচ্ছেন।


মহামারির বাজারে সারা দেশে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে, সেই বিপর্যয়ের প্রভাব কুমোরটুলি সার্বজনীনেও পড়েছে। পুজো কমিটির কোষাধ্যক্ষ অরিজিৎ পাল জানাচ্ছেন, বিগত বছরের মতো এ বছরে স্পনসরশিপের তেমন কোনও পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে কুমোরটুলি সার্বজনীন এক ধাপ এগিয়ে ভাবছে। সুন্দরবনের কুলতলি থানার শ্যামনগর গ্রামের প্রায় ১৯০ টি পরিবারের ৫০০ জন  মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র ও পুজোর সামগ্রিক খরচের ব্যবস্থা করেছে কুমোরটুলি সার্বজনীন। এবং একটি দুর্গা প্রতিমাও তাদের দেওয়া হচ্ছে। দেবাশিসবাবু বলেন, আমপানের পর সুন্দরবন পুরো শেষ হয়ে গেছে, তাই আনন্দের দিনে কিছুটা হলেও বিষাদের অশ্রু যাতে তাঁরা মুছতে  পারেন তারই এই ক্ষুদ্রতম প্রয়াস কুমোরটুলি সার্বজনীনের।


কুমোরটুলি সার্বজনীনের ৯০ তম বর্ষের থিম ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’। সুন্দরবনের অসহায় মানুষেরা দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিদিন হাসিমুখে লড়াই করে যাচ্ছেন। আর সেই দুর্যোগের হাসি নিয়েই কুমোরটুলি সার্বজনীনের এই বছরের মণ্ডপ সেজে উঠছে। তবে সরকারি সমস্ত বিধিনিষেধ মেনেই এই বছরের পুজো হবে বলেই দেবাশিসবাবু, অরিজিৎবাবুরা জানাচ্ছেন। অষ্টমীতে প্রতি বছরের মতো এই বছরে জনসাধারণের জন্য কোনও ভোগ থাকছে না। দশমীতে সিঁদুর খেলা সামাজিক দূরত্ব ও সুরক্ষা বজায় রেখেই হবে।
মহামারির দিনে এই বছরের পুজো যখন কিছু মানুষের কাছে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, কিছু মানুষ আবার পুজো বন্ধ করার পক্ষে, তখনই কুমোরটুলি সার্বজনীন সমস্ত বেড়াজাল টপকে উমার আগমনকে মানবিক বন্ধনের সাথে অটুট করে তুলতে চলেছে। শরতের আকাশে বাতাসে কুমোরটুলি সার্বজনীন নতুন করে বেঁচে থাকার আশার আলো দেখাচ্ছে সুন্দরবনের অসহায় মানুষগুলির মধ্যে।

Comments are closed.