ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে গড়ে ওঠা কুমোরটুলি আজ দুই বাংলার শিল্পীদের সহাবস্থানে এক অনন্য শিল্পক্ষেত্র!

ওঁদের এখন স্নান-খাওয়া প্রায় বন্ধ বললেই চলে। মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিমা নির্মাণের কাজ শেষ করতে হবে। আসলে ওঁরা বলতে কুমোরটুলির এক এক প্রখ্যাত মৃৎশিল্পীর কথা বলা যেতে পারে। দুর্গা পুজো তো দরজায় কড়া নাড়ছে। তাই ওঁদের ব্যস্ততাও বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সরু গলি, আর দু’দিকে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে অসংখ্য প্রতিমা। তার উপর বৃষ্টি পড়লে অবস্থা আরও নাজেহাল হয়ে যায়। প্যাচপ্যাচে কাদায় কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে কুমোরটুলি। কিন্তু তাই বলে কি কাজ বন্ধ থাকবে? নাকি বায়না করতে আসবেন না পুজো উদ্যোক্তারা? না, বাস্তবে কোনওটাই সম্ভব নয়। কিন্তু ঠিক কবে থেকে কুমোরটুলি মৃৎশিল্পের আঁতুড়ঘরে পরিণত হল?

ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা যায়, কলকাতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জব চার্নক মহাশয়। কলকাতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকদিনের মধ্যে ফোর্ট উইলিয়ামও প্রতিষ্ঠা হল। সেই সময় অবশ্য কলকাতা ছিল এক গ্রামের স্বরূপ। আজকের কলকাতার মত চাকচিক্য তখন ছিল না। ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির ফলে সেই অঞ্চলের মানুষের নতুন করে বসতি স্থাপনের জন্য প্রয়োজন ছিল অন্য একটি জায়গার এবং এই প্রয়োজন মেটানোর জন্যই গঙ্গা পাড়ে গড়ে তোলা হলো সুতানুটি। যেখানে বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন বসবাস শুরু করলেন।

ইতিমধ্যে পলাশির যুদ্ধ হয়ে গেছে এবং ইংরেজরা বাংলাকে নিজেদের শক্তিশালী ঘাঁটিতেও পরিণত করেছেন। কোম্পানির ডিরেক্টরের নির্দেশে হলওয়েল সাহেব পেশা ভিত্তিক বিভিন্ন অঞ্চল গড়ে তুললেন। যেগুলি আমাদের কাছে আজকে শুঁড়িপাড়া, কলুটোলা, ছুতারপাড়া, আহিরীটোলা, কুমোরটুলি ইত্যাদি নামে পরিচিত। বাণিজ্যের অগ্রগতি ও প্রসারের ফলে জমিদার শ্রেণিরও আবির্ভাব হতে থাকল। কাজের আশায় গ্রামগঞ্জ থেকে কলকাতায় ভিড় জমাতে থাকলেন একাধিক মানুষজন। এর মধ্য মুর্শিদাবাদ, নদিয়া থেকে আসা মানুষেরা মৃৎশিল্পে যথেষ্ট পটু ছিলেন। তাঁদেরই বসবাস করার জায়গা ছিল এই কুমোরটুলি। তবে হ্যাঁ, প্রাথমিক ক্ষেত্রে এঁরা অবশ্য প্রতিমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন মৃৎপাত্র তাঁরা তৈরি করতেন এবং তাতে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এর পাশাপাশি অতি অবশ্যই তাঁদের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলে রাখা ভালো। এই মৃৎশিল্পীরা মাটির পুতুল নির্মাণে যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দেন। এরপর সময় যত এগিয়েছে কলকাতায় দুর্গা পূজার জনপ্রিয়তা তত বৃদ্ধি পেয়েছে, আর সেদিন যাঁরা পুতুল নির্মাণে পটু ছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে প্রতিমা নির্মাণে দক্ষ হয়ে উঠতে লাগলেন। প্রথমে গুটিকয়েক মৃৎশিল্পী প্রতিমা নির্মাণ করতেন। কিন্তু চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মৃৎশিল্পীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

আসলে এক কথায় বলতে গেলে কুমোরটুলি বাঙালির আবেগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। যেমন আজকাল পুজোর ঠিক আগে কুমোরটুলিতে ফটোগ্রাফারদের বেশ ভিড় জমে। মূর্তি নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়গুলি তাঁরা লেন্সবন্দি করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু কয়েক দশক আগে পর্যন্ত এই চিত্রটা ছিল না। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারা, রুচিবোধ গুলোও অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়েছে। উত্তর কলকাতার এই কুমোরটুলিতে একাধিক প্রখ্যাত মানুষের বসবাস ছিল। নন্দরাম সেন, যিনি কলকাতার কালেক্টর ছিলেন, তাঁর বসবাস ছিল এই কুমোরটুলিতে। সালটা অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিক নাগাদ। এই ভদ্রলোক তখন আবার ব্ল্যাক ডেপুটি নামে অধিক পরিচিত। পরবর্তীকালে অবশ্য কুমোরটুলি অঞ্চলে তাঁর নামে একটি রাস্তা নামাঙ্কিত করা হয়েছে।

লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলেবেলা কেটেছিল এই কুমোরটুলিতে। ইংরেজি দৈনিকে তিনি এক সময় লিখেছিলেন ‘In those days, instead of buying the idols from the market at Kumortuli, families invited the kumor or artisan home to stay as a house guest weeks before the Puja, during which time he sculpted the idol. The idol at our Puja was known for its magnificent size. It used to be over 10 feet tall. Every morning as the kumor started his work, we children gathered around him and gaped in awe as he gradually turned a fistful of straw and a huge mass of clay into a perfectly formed, larger-than-life figure. And then came the most intriguing part — the painting of the third eye of the goddess. The artisan would sit in meditation sometimes for hours and then suddenly in one swift stroke of his paint brush, it would be done.’

আজকের প্রজন্মও কিন্তু পিছিয়ে নেই। তারাও কিন্তু এই আবেগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বনেদি পরিবারের ছেলে অরিন্দম। যাঁর বেড়ে ওঠা এই কুমোরটুলি চত্বরে। ‘দুর্গা পুজোর আগে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় কুমোরটুলির ওই সরু গলিটা ঢুঁ মেরে যাওয়াটা যেন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আসলে মনটা যেন প্রতিদিন ওই মৃৎশিল্পীদের বাড়িতেই পড়ে থাকে। এটা একটা আবেগ, যেটা আমাদের রক্তে জড়িয়ে আছে,’ জানালেন অরিন্দম সিংহ।
কিন্তু এখন কেমন আছে কুমোরটুলি? ব্যস্ততা তো রয়েছেই। ‘আমার যখন আট বছর বয়স তখন বাবার হাত ধরে মৃৎশিল্পে আমার হাতে খড়ি হয়। আজ সাত দশক পরেও একইভাবে মৃৎশিল্পের শৈল্পিক চেতনা বাঁচিয়ে রেখেছি। আগে অবশ্য এখানে নীল চাষ হতো। শান্তিপুর থেকে নীল চাষিরা আসতেন এখানে। হ্যাঁ, তবে আগের কুমোরটুলির থেকে এখনকার কুমোরটুলি অনেক বেশি পরিণত হয়েছে। এই যেমন আগে শুধুমাত্র গুটিকয়েক বাড়িতে দুর্গা পুজো সম্পন্ন হতো, আর এখন? কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে দুর্গা পূজা হচ্ছে। তাই মূর্তি বিক্রির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।’ জানালেন সমীর কুমার পাল। কিন্তু এই কথা বলতে বলতে তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রশ্ন করাতে উত্তর দিলেন, ‘আসলে মৃৎশিল্পীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই মৃৎশিল্পে আর আসতে চাইছেন না। তাই ভবিষ্যতে কী হবে এটা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।’
১৯৪৭ সাল নাগাদ দেশভাগ হলে, ওপার বাংলা থেকে রাখালচন্দ্র রুদ্রপাল, সঙ্গে হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল, মোহনবাঁশি, চার ভাই পশ্চিমবঙ্গে এসে উপস্থিত হলেন। শুধু কি এরা? এর পাশাপাশি যোগেন্দ্র পাল, গোরাচাঁদ পাল প্রত্যেকেই ভিড় জমাতে শুরু করলেন কুমারটুলিতে। আর এই সময় থেকেই প্রতিমা শিল্পে এক অনন্য পরিবর্তন ঘটে গেল। নিত্যনতুনভাবে নির্মিত হতে শুরু করল প্রতিমা। তবে অবশ্যই মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছিলেন কৃষ্ণনগরের গোপেশ্বর পাল। তাঁর দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীকালে রাখালচন্দ্র রুদ্রপাল, মোহনবাঁশি রুদ্রপালেরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন মৃৎশিল্পের ধারাকে। এখন অবশ্য মৃৎশিল্পীদের মধ্যে নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা পরিলক্ষিত হয়। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেই অনেকে প্রতিমা নির্মাণে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের নিত্যনতুন শৈল্পিক চেতনা যা আজকের থিম পুজোগুলিকে আরও বেশি বর্ণময় করে তুলেছে। এখন প্রতি বছর কয়েক হাজার প্রতিমা বিদেশে পাড়ি দেয়। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল আটের দশকের শেষের দিকে। সেই সময় অমরনাথ ঘোষের তৈরি করা শোলার প্রতিমা পাড়ি দিয়েছিল বিদেশে, আর সেটাই ছিল শুরু। এখন অবশ্য প্রতি বছর প্রায় ৯৩ টি দেশে কুমোরটুলির প্রতিমা পাড়ি দেয়। যা নিঃসন্দেহে কুমোরটুলির মুকুটে এক নতুন পালক যোগ করেছে।

এ বছর বর্ষায় তেমন বৃষ্টি চোখে পড়েনি, কিন্তু এখন বৃষ্টির প্রকোপ শিল্পীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাই সরু গলির দু’পাশে যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই প্লাস্টিকে মোড়া প্রতিমা লক্ষ্য করা যাবে। ‘এই বৃষ্টিটাই প্রতি বছর আমাদের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, একেই এখানকার গলি প্রচণ্ড সরু। তারপর বৃষ্টি পড়লে রাস্তায় হাঁটার মত অবস্থা থাকে না। সেই সঙ্গে আমাদের তো সমস্যার শেষ নেই। বৃষ্টি না হয় প্রাকৃতিক বিষয়, কিন্তু তার সঙ্গে অন্যান্য সমস্যাগুলি আমাদের জন্য যথেষ্ট সমস্যায় ফেলছে। এই দেখুন মাটির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের কোনও পদক্ষেপ নেই, তার উপর লেবার ক্রাইসিস তো রয়েছেই। তাঁদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। তাছাড়াও দেবীর সাজসজ্জার জিনিসপত্রের দামের পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। মূর্তি শুকানোর জন্য যে বার্নার ব্যবহার করা হয় সেটাও তো খরচসাপেক্ষ। সমস্যা আমাদের প্রচুর,’ জানালেন এক মৃৎশিল্পী।
আসলে কুমোরটুলি বাঙালির মনে সব সময় এক অন্যরকম জায়গা করে আছে। আর পুজো শুরুর আগে কুমোরটুলিতে পা রাখার জায়গা থাকে না। তারপর আস্তে আস্তে এক এক করে মূর্তি বিভিন্ন মণ্ডপে বা বাড়িতে পৌঁছে যায়। তখন কুমোরটুলি প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। মৃৎশিল্পীদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর পুজোর পাঁচটা দিন এই শিল্পীরা একটু জিরিয়ে নেওয়ার সময় পান। কারণ, দুর্গা পূজা শেষ হলেই যে আবার লক্ষ্মী পুজো, তারপর কালী পুজো। তাঁদের এই জিরিয়ে নেওয়ার সময় নেহাতই খুব সীমিত। পুজোর সময় কলকাতায় সেজে ওঠে আলোর রোশনাইতে। এক বারোয়ারি পুজো আর এক বারোয়ারি পুজোকে টেক্কা দিতে সদা তৎপর হয়ে ওঠে। একের পর এক পুরস্কারও পায় পুজো কমিটিগুলি। আর তখন ওঁরা? মানে মৃৎশিল্পীরা! তাঁরা তখন অন্য প্রতিমা গড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোন পুজো কী পুরস্কার পেল, তার হদিসও রাখেন না তাঁরা।

Comments are closed.