পরপর দুই প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর কড়া ধমক একাধিক পুর চেয়ারম্যানকে, পুরভোটের আগে কাউন্সিলরদের ধুকপুকানি বাড়ছে

বুধবার বাঁকুড়ার প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে ভাষায় জেলার তিন পুরসভার চেয়ারম্যানকে ধমকেছেন, যে ভাষায় নিজের হাতে থাকা ভূমি ও ভূমি সংস্কার, পূর্ত এবং জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, এই সব দফতরে ঘুঘুর বাসা আছে বলে তোপ দেগেছেন, তাতে জেলার জেলায় তৃণমূল কাউন্সিলরদের রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছে। একই ভাবে বৃহস্পতিবার দুর্গাপুরে পশ্চিম বর্ধমানের প্রশাসনিক বৈঠকেও মুখ্যমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়েন শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক, দুর্গাপুরের মেয়র দিলীপ অগস্তি-সহ অনেকে। তৃণমূলের অন্দরের খবর, পুরভোটের আগে পর্যন্ত দলের এবং প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর এই রণংদেহী মেজাজ বজায় থাকবে।
এপ্রিলেই পুরভোট। এমনিতেই ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরের (পি কে) টিম পুরভোটের আগে জেলাগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। পি কে-র টিমের কাছে দলের কাউন্সিলর ও নেতাদের নানা ধরনের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। কার কোথায় কাজের খামতি হয়েছে গত পাঁচ বছরে, কে কোথায় বড় বাড়ি, ক’টা গাড়ি করেছেন, কে কোথায় দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন, সব খুঁড়ে খুড়ে বার করছে টিম পি কে। দলের অন্দরের খবর, কলকাতা কর্পোরেশন-সহ বহু পুরসভার অনেক কাউন্সিলরের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছে যে, এ বার হয়তো তিনি টিকিট পাবেন না। তার উপরে প্রশান্ত কিশোর, দলের যুব নেতা অভিষেক ব্যানার্জি এবং সর্বোপরি খোদ নেত্রী সাফ বলে দিয়েছেন, পুরভোটে টিকিট পাওয়ার জন্য কোনও লবিবাজি চলবে না, চলবে না দাদা-দিদি ধরা। এই অবস্থায় পরপর দু’দিন প্রশাসনিক বৈঠকে দুই জেলার একাধিক পুরসভার চেয়ারম্যানকে নেত্রীর ধমকানি অনেক কাউন্সিলরের বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দিয়েছে।
জেলায় জেলায় তৃণমূলের হাতে থাকা অধিকাংশ পুরসভাতেই পরিষেবা নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ আছে। অভিযোগ আছে কাজের মান নিয়ে। অনেক পুরসভায় রয়েছে হাজারটা দুর্নীতি, কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ। এ ছাড়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকের বিরুদ্ধে মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারেরও ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। দলের নেতৃত্ব মনে করছেন, গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে এ সবের মাসুল দিতে হয়েছে। পাশাপাশি, বহু পুরসভায় তৃণমূল গোষ্ঠী কোন্দলে জর্জরিত। দলের জেলা নেতারা সে সব সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকী নেত্রী নিজেও বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তাতেও কাজ হয়নি। শেষে নেত্রী বেশ কয়েকটি পুর বোর্ড ভেঙেও দিয়েছেন। এ সব কারণেই নেত্রী এ বার পুরভোটে স্বচ্ছতার উপর বেশি জোর দিয়েছেন।
বুধবার নেত্রীর তোপের মুখে প্রথমেই পড়েন বিষ্ণুপুরের চেয়ারম্যান, প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আপনি সিনিয়র নেতা। চেয়ারম্যান আছেন অনেকদিন। মন্ত্রীও ছিলেন। আপনার এলাকায় হকারদের পুনর্বাসনে এত দেরি হচ্ছে কেন? তা ছাড়া আপনার ওখানে ময়লা পরিষ্কার নিয়ে মানুষের এত ক্ষোভ কেন? নোংরা ফেলার নির্দিষ্ট একটা জায়গা এতদিনে করে উঠতে পারেননি? সোনামুখী পুরসভার চেয়ারম্যান সুরজিৎ মুখার্জির কাছে মমতা জানতে চান, পুর এলাকায় বাড়ি বণ্টন নিয়ে এত সমস্যা কেন? সোনামুখী, বিষ্ণুপুরে বাড়ি বাড়ি জল দেওয়া যাচ্ছে না কেন এখনও? সুরজিতকে তিনি বলেন, তোমরা এত ঝগড়া কর কেন? বাঁকুড়া [পুরসভার চেয়ারম্যান মহাপ্রসাদ সেনগুপ্তকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আপনার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন? আপনি কি কাজকর্ম ঠিক মতো করেন না? নিজেকে শুধরে নিন। মানুষ ভুল বুঝলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসবেন। বৈঠকে ভাইস চেয়ারম্যান দিলীপ আগরওয়ালকে কেন ডাকা হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলে মমতা চেয়ারম্যানকে বলেন, উনি ভালো কাজ করেন। ওঁকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করুন।
গত ২২ জানুয়ারি বাঁকুড়ার সারেঙ্গায় সদ্য তৈরি হওয়া একটি জলের ট্যাঙ্ক তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। প্রশাসনিক বৈঠকে তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কোপে পড়েন জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের প্রিন্সিপাল সচিব মনোজ পন্থ। তাঁকে দাঁড় করিয়ে ভর্ৎসনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রবীণ আমলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সব কথা হজম করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পিএইচই, ভূমি সংস্কার এবং পূর্ত দফতরে ঘুঘুর বাসা রয়েছে। মুখ্যসচিবের নাম করে তিনি বলেন, রাজীব, দুর্নীতি দমন শাখাকে কাজে লাগিয়ে ওই ঘুঘুর বাসা ভাঙো তোমরা। ইট ইজ টু মাচ। জলের ট্যাঙ্ক ভাঙা নিয়ে তিনি ঠিকাদারদের এক হাত নেন। ওই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে বলেন তিনি। তাঁর হুমকি, এ সব বন্ধে কড়া আইন আনব আমি। যাতে অসাধু ঠিকাদারদের সম্পত্তি ক্রোক করা যায়।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, কলকাতা কর্পোরেশনেও দলের অনেক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। পি কে-র স্ক্যানারে তার কিছু কিছু ধরাও পড়েছে। বুধবার যখন কলকাতা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়ায় মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক বৈঠক করছেন, তখন কলকাতা কর্পোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেনের বিরুদ্ধে এলাকায় কাজ না করার অভিযোগে বিক্ষোভ দেখাতে ব্যস্ত ছিলেন তৃণমূলেরই বেশ কিছু সমর্থক। তাঁদের হাতে শান্তনুর বিরুদ্ধে স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ডও ছিল। তাঁদের বক্তব্য, কাউন্সিলর কাজ তো করেন না, উল্টে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। শান্তনু অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বাম জমানায় প্রবীণ মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী একবার বলেছিলেন, রাজ্যে ঠিকাদারদের সরকার চলছে। তার জবাবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, তা হলে উনি এই সরকারে আছেন কেন? তা নিয়ে ওই সময় রাজ্য রাজনীতি উত্তাল হয়েছিল। এ বার তৃণমূল জমানায় খোদ মুখ্যমন্ত্রীই বললেন, ভূমি ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরে ঘুঘুর বাসা আছে। পিডব্লিউডি ডিপিআর করলেই ভয় লাগে। পাঁচ কোটির প্রকল্প ওর ৫০ কোটির করবে। এ সব চালাকি বন্ধ করতে হবে।

Comments are closed.