যৌন হেনস্থার কথা জানিয়ে ‘মি টু’ ক্যাম্পেনে এবার বহু মহিলার অভিযোগ লেখক, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, তোলপাড় দেশের মিডিয়া জগৎ

মাত্র দিন দশেক আগের ঘটনা, অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্তের একটি অভিযোগ ঘিরে সাড়া পড়ে গিয়েছিল বলিউড ও আম-জনতার মধ্যে। যার রেশ আজও বর্তমান তো বটেই, ক্রমে নাটকীয় মোড় নিচ্ছে ঘটনা পরম্পরা। তনুশ্রী দত্তর দাবি, ২০০৮ সালে ‘হর্ণ ওকে প্লিজ’ নামে একটি ছবির গানের দৃশ্যের শুটিং চলাকালীন তাঁকে যৌন হেনস্থা করেন সহ অভিনেতা নানা পাটেকর।
তনুশ্রী দত্তর অভিযোগের মধ্যেই এবার যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে দেশের একাধিক সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের কর্তাদের বিরুদ্ধে। ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ প্রচারের শরিক হয়ে বহু মহিলা সাংবাদিক এবং সংবাদ কর্মী সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুলতে শুরু করেছেন, যা নিয়ে নতুন করে উত্তাল হচ্ছে মিডিয়া জগৎ। যেমন, মহিমা কুকরেজা। দু’দিন আগে তিনি ট্যুইটারে জানান, বছর দুয়েক আগে স্ট্যান্ড আপ কমেডি গ্রুপ ‘এআইবি’র এক সদস্য, উৎসব চক্রবর্তী তাঁকে মোবাইল চ্যাটে নিজের পুরুষাঙ্গের ছবি পাঠিয়েছিলেন এবং কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিষয়টি তিনি দলের অন্যান্য সদস্যদের জানান, কিন্তু উৎসবের বিরুদ্ধে সেরকম কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া
হয়নি। পরে তিনি জানতে পারেন আরও অনেক মহিলাদের সাথে উৎসব চক্রবর্তী ওই একই ধরনের অশালীন কাজ করতেন। প্রমাণ হিসাবে কিছু চ্যাটের ছবিও স্ক্রিন শট নিয়ে পোস্ট করেছেন মহিমা কুকরেজা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর প্রথমে নিজের পক্ষে সাফাই দিয়েছিলেন উৎসব। বলেছিলেন, তিলকে তাল করা হচ্ছে, কার্যত নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন তিনি।
কিন্তু এতেই হিতে বিপরীত হয়। মহিমার অভিযোগ যে সত্যি এবং তাঁদের সাথেও এরকম অসভ্যতা করেছেন এই কমেডিয়ান, তা নিয়ে পালটা ট্যুইট করতে শুরু করেন অন্যান্য মহিলারা। এতে চাপে পড়ে অবশেষে ক্ষমা চেয়েছেন উৎসব। ট্যুইটারে লিখেছেন, যা হয়েছে তাঁর জন্য তিনি দুঃখিত। এই অপরাধী তকমা নিয়ে আর থাকতে পারছেন না।
এখানেই শেষ নয়। একাধিক মহিলা ও মহিলা সাংবাদিক, বেশ কিছু পুরুষ সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ এনে সোশ্যাল সম্প্রতি মিডিয়ায় সরব হয়েছেন। এক মহিলা ট্যুইট করে দাবি করেছেন, বছর কয়েক আগে এক ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে তাঁর সাথে আলাপ হয় এক সাংবাদিকের। প্রথম থেকেই ওই সাংবাদিকের কথার ধরন যৌন ইঙ্গিত দেওয়ার মতো ছিল বলে তিনি অভিযোগ করেন। মহিলার আরও অভিযোগ, দু’জনে একদিন দেখা করেছিলেন। রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন, সামনা সামনি দেখাতেও ওই সাংবাদিক অসভ্য আচরণ করেন তাঁর সাথে। বাড়ি যাওয়ার প্রস্তাব দেন প্রথম দেখাতেই।
মহিলার অভিযোগ, গাড়িতে ওঠার সময় তাঁকে জোর করে কাছে টেনে চুম্বন করারও চেষ্টা করেন ওই সাংবাদিক। যদিও মহিলা জানিয়েছেন, পরে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন ওই সাংবাদিক। ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ওই একই ধরনের অভিযোগ করেছেন আরও বেশ কয়েক জন মহিলা।
তবে এই একটি ঘটনাতেই থামছে না ভারতের এই ‘মি টু’ মুভমেন্ট। আরও এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তিন মহিলার অভিযোগ, তাঁদের স্ন্যাপ চ্যাটে যৌন উদ্দীপক ভিডিও পাঠিয়েছেন ওই ওই সাংবাদিক।
এই অভিযোগ অবশ্য জনৈক সাংবাদিক স্বীকার করে নিয়ে জানিয়েছেন, মজার ছলেই তিনি ওই ভিডিও পাঠিয়েছিলেন এবং মহিলাদের নগ্ন ছবি পাঠাতে বলেছিলেন। তখন তিনি বুঝতে পারেননি বিষয়টি এত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। দেশের বিখ্যাত দুই সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পদে থাকা দুই বিখ্যাত সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে জোর করে চুম্বন, গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে গায়ে হাত দেওয়া, স্ত্রী চলে যাওয়ায় একাকিত্বের কথা বলে বকলমে যৌন প্রস্তাব দেওয়ার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগকারী মহিলা সাংবাদিক বিষয়টি অফিসের সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও জানিয়ে তদন্তের দাবি করেছেন। জবাবে বিখ্যাত ওই দুই সংবাদপত্রের তরফে বলা হয়েছে, অভিযোগগুলির প্রেক্ষিতে আভ্যন্তরীণ তদন্ত করা হবে। তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন অভিযুক্তরাও।
অভিযোগ উঠেছে জনপ্রিয় লেখক চেতন ভগতের বিরুদ্ধেও। এক মহিলা সাংবাদিকের অভিযোগ, কর্মসূত্রে আলাপ হলেও হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে তাঁকে অযাচিতভাবে প্রণয়ের প্রস্তাব দেন চেতন ভগত। তাঁদের কথোপকথনের স্ক্রিন শট তুলেও প্রকাশ করেছেন ওই অভিযোগকারিণী। এই কথোপকথন যে তাঁরই তা স্বীকার করেছেন চেতন ভগতও। বলেছেন, তিনি ওই মানে করে মেসেজ লেখেননি। কিন্তু তিনি অজান্তে আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।
ট্যুইটারে অভিযোগকারীদের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পুরুষ প্রধান সমাজে চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে, প্রভাবশালীদের ভয়ে ও সামাজিক হাসি ঠাট্টার ভয়ে মহিলারা এমন অভিযোগ সামনে আনতে পারেন না। কিন্তু ক্রমে সেই জড়তা ভাঙছে। মূলত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেই তাঁরা প্রকাশ্যে আসছেন, নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। হলিউডের মতো ‘মি টু’ মুভমেন্ট না হলেও, ক্রমে কিন্তু পর্দা সরছে বলে মানছেন অনেকেই। প্রায় সকলেই একমত যে, শুধুমাত্র প্রচার পেতে বা শত্রুতা মেটাতে কোনও মহিলা নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এরকম একটি বিষয় নিয়ে এমন অভিযোগ প্রকাশ্য আনবেন না। বিষয়টি যথেষ্ট কষ্টকর ও যন্ত্রণার শামিল, তাই মিথ্যা অভিযোগ আনার কথা বলাটা যত সহজ, বাস্তবে ততটা নয়।

মি টু মুভমেন্ট কী?

২০০৬ সালে মার্কিন সমাজকর্মী ও কলামিস্ট তারানা বার্ক নিজের এক লেখায় এই ‘মি টু’ শব্দ বন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন একটি বৃহত্তর অর্থে। তাঁর উদ্দেশ্যে ছিল, কর্মস্থলে যে সব মহিলা যৌন হেনস্থা বা অপমানের শিকার, তাঁদের সামনে আনা। পাশে থেকে তাঁদের ক্ষমতা যোগানো এই ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করতে। তবে সেই সময় এই শব্দবন্ধটি এতটি জোরালো হয়নি। ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর হলিউড অভিনেত্রী আলিশা মিলানো ট্যুইটারে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ ব্যবহার করে নিজের সাথে ঘটা হেনস্থার কথা প্রকাশ্যে জানান। রাতারাতি ট্যুইটারে এক আন্দোলনের চেহারা নেয় আলিশা মিলানোর এই ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’। দু’দিনে প্রায় সাত লক্ষ মহিলা এই ‘মি টু হ্যাশ ট্যাগ’ ব্যবহার করে নিজেদের কথা প্রকাশ্যে আনেন। প্রথম সারির একাধিক হলিউড অভিনেত্রী প্রকাশ্যে আনেন তাঁদের ঘটনা। কেউ জানান ছোট বেলায় আত্মীয়ের হাতে যৌন হেনস্থার কথা, কেউ বলেন কর্মস্থলে কুপ্রস্তাব পাওয়ার কথা। পরে গোটা বিশ্বেই এই ‘মি টু’ ক্যাম্পেন জনপ্রিয় হয়, কোটি কোটি মহিলা নিজের যন্ত্রণার কথা জানান। এবার তার আঁচ দেশের চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়িয়ে সংবাদমাধ্যমেও পড়ল।

Comments are closed.