নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৩: গড়বেতা, কেশপুরের ১৫-১৬ টা সশস্ত্র ছেলেকে নিয়ে মাঝরাতে রওনা দিলাম রানিচক

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের অভিযানে নন্দীগ্রামে ১৪ জনের মৃত্যুর পর নড়বড়ে হয়ে পড়ল প্রশাসন, এরই মাঝে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিতে গিয়ে যোগ দিলেন এক যুবক। নিজের নাম বললেন গৌরাঙ্গ, তিনিই মাওয়িস্ট নেতা তেলেগু দীপক……

 

মাওবাদীদের অন্যতম শীর্ষ নেতা তেলেগু দীপক ২০০৭ সালের মার্চের মাঝামাঝি নন্দীগ্রাম আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিলেন। প্রায় আট মাস ছিলেন নন্দীগ্রামে। লড়াই করেছেন সামনে থেকে। ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর দুপুরে নন্দীগ্রাম ছাড়েন তিনি। তেলেগু দীপক যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই নন্দীগ্রামে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় আরও ৪-৫ জন মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য। সকলেরই পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে সিপিআইএম এবং পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ের অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারও বেশ কিছু দিন বাদে, জুন মাসে নন্দীগ্রামে গিয়ে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিলেন আরও একজন। নন্দীগ্রামের আন্দোলনকারীরা তাঁকে চিনতেন সুকুমার নামে। তাঁর আসল নাম সুদীপ চোঙদার। রাজ্যে সুদীপ চোঙদার তখন মাওবাদীদের শীর্ষ নেতা। পরে মাওবাদীদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হয়েছিলেন সুদীপ চোঙদার।
পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা, কেশপুরের সশস্ত্র বাহিনী যেভাবে খেজুরি, নন্দীগ্রামে সিপিআইএম ক্যাম্পগুলোর শক্তিবৃদ্ধি করছিল, একই ব্যাপার ঘটল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির ক্ষেত্রেও তেলেগু দীপক, সুদীপ চোঙদারদেরর যোগদানের পর। এপ্রিলের গোড়া থেকেই সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হল নানা  জায়গায়। মাওবাদী যোদ্ধারা নন্দীগ্রাম আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হওয়ার পর প্রথম বড়ো সংঘর্ষ শুরু হয় ২৯ এপ্রিল থেকে। সেই সংঘর্ষ, লড়াই চলেছিল ৩-৪ দিন টানা। সরকারি এবং বেসরকারি হিসেব মিলে ৫-৬ জনের মৃত্যুর পর সাময়িক যুদ্ধবিরতি। আবার নতুন করে ঘরছাড়া হলেন বহু মানুষ।
মাত্র কয়েকবছর আগে ছিল একটাই জেলা ছিল মেদিনীপুর। এখন দু’ভাগ হয়েছে, পূর্ব আর পশ্চিম। রাজনীতির কী আশ্চর্য গতি, এই দুই জেলার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষই একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করল এলাকা দখল কিংবা তা রক্ষার জন্য।
১৪ মার্চ পুলিশ অভিযানের পর বেশ খানিকটা ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল শাসক দল এবং সরকার। এরই মধ্যে আন্দোলনকে অনেকটাই সংহত এবং সংগঠিত করার সুযোগ পেয়ে যায় ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। ১৪ মার্চের পর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, নন্দীগ্রামে ফের পুলিশ পাঠানোর মতো অবস্থা সরকারের নেই। পুলিশের অভিযানে ১৪ জনের মৃত্যু প্রশাসনকে নন্দীগ্রাম নিয়ে সম্পূর্ণ ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল। তারপর থেকে রাজ্যজুড়ে সাধারণ মানুষের সমর্থন এবং সহানুভূতি পুরোটাই চলে গিয়েছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির দিকে। কিন্তু কমিটির নেতারা বুঝতে পারছিলেন, পুলিশ থানায় চুপচাপ বসে আছে, তার মানে এই নয়, সিপিআইএমও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। ততদিনে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতা-সদস্যরা বহিরাগত সিপিআইএম বাহিনীর আনাগোনার খবরও পুরোদস্তুর জানতেন। তাই যে আন্দোলন প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে, বিনা নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল, তা ৭ জানুয়ারি খেজুরি থেকে চালানো গুলিতে ৩ জনের মৃত্যুর পর একটা যৌক্তিকতা পায় এবং দানা বাঁধতে শুরু করে। কিন্তু তাও ছিল কিছুটা ছন্নছাড়া, দিশাহীন। ১৪ই মার্চ ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা যেমন একদিকে বেড়ে যায়, তেমনই তা সশস্ত্র চেহারাও নিতে শুরু করে। প্রথমদিকে যা ছিল শুধুমাত্র পুলিশ এবং সিপিআইএমকে ঠেকানোর লড়াই, দিনে দিনে তাই হয়ে দাঁড়াল শাসক দলকে মেরে এলাকা বাড়ানোর রাজনীতি।
১৪ মার্চের পর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির জমি রক্ষার এই সশস্ত্র আন্দোলনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যুক্ত হল। প্রথমটা তেলেগু দীপক, সুদীপ চোঙদারের নেতৃত্বে সরাসরি মাওবাদীদের যোগদান। দ্বিতীয়ত, আন্দোলনে প্রচুর টাকার যোগান। প্রাথমিকভাবে আন্দোলন যখন শুরু হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই তাতে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা কম ছিল, আবেগ ছিল অনেক বেশি। বিবেচনার সময়ও ছিল না। কিন্তু ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি অচিরেই বুঝতে পারে, পর্যাপ্ত টাকার যোগান ছাড়া সরকার এবং সিপিআইএমের সঙ্গে লড়াই চালানো অসম্ভব। তাই প্রথম দিন থেকেই চাঁদা তোলা শুরু হয়েছিল। জমি, ভিটে রক্ষার জন্য এবং সিপিআইএমের আক্রমণ থেকে বাঁচার লড়াই করতে হবে। তাই টাকা দরকার, এই স্লোগানই ছিল যথেষ্ট। লোকজন সাধ্যমতো টাকা দিতে শুরু করলেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতাদের। অনেকটাই তৃণমূল বিরোধী আবার সিপিআইএমের নেতা নন, এরকম বহু মানুষই থেকে গিয়েছিলেন নন্দীগ্রামে। সরাসরি আন্দোলনে যোগ দেননি, আবার এলাকাও ছাড়েননি, এই পরিবারগুলো পড়ে গেল মহা সমস্যায়। এঁদের পাশাপাশি টাকার জন্য অনেক সময় কিছুটা জোরজুলুমও হয় এলাকা না ছাড়া কিছু বর্ধিষ্ণু সিপিআইএম পরিবারের ওপর। নন্দীগ্রামে তাদের কর্মী, সমর্থকদের লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা করার যে অভিযোগ সিপিআইএম বারবারই করেছে, তা পুরোটা সত্যি না হলেও, পুরোটি মিথ্যেও নয়। এর পাশাপাশি শুভেন্দু অধিকারীও অনেক আর্থিক সাহায্য করেন। কিন্তু ১৪ মার্চ সাধারণ গ্রামবাসীদের মৃত্যু রাজ্যে তো বটেই, দেশে এবং বিদেশেও সহানুভূতির ঝড় তুলে দেয়। প্রচুর পরিমাণে আর্থিক সাহায্য পৌঁছতে শুরু করে নন্দীগ্রামে। দেশ তো বটেই, বিদেশ থেকেও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার হিসেব রাখতেন সোনাচূড়ার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা নিশিকান্ত মন্ডল। এই টাকার হিসেবই ২০০৯ সালের শেষে নিশিকান্ত মন্ডলের জীবন নিয়েছিল। অর্থই অনর্থ। সে ঘটনা পরে।

২৪ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গিয়েছিলেন হলদিয়া। গেলাম হলদিয়া, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সমাবেশ কভার করতে। সেখানে একটা-দুটো কারখানার শিলান্যাসের পর বিকেলে মুখ্যমন্ত্রীর জনসভা। জনসভায় তমলুকের সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠকে পাশে বসিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পায়নের পক্ষে জোর সাওয়াল করলেন। বলেছিলেন, শিল্পায়নের ফলে একটা গণ্ডগ্রাম হলদিয়া কী থেকে কী হয়েছে, আর তা না করতে দিয়ে নন্দীগ্রাম কী হারাল। বলেছিলেন, হলদি নদীর এক পার হলদিয়ায় লক্ষ ওয়াটের আলো জ্বলছে, অন্য পার নন্দীগ্রাম অন্ধকারই থেকে গেল কিছু লোকের হঠকারী আন্দোলনে। সেই সমাবেশে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। তার কিছুদিন আগে থেকেই খবর পাচ্ছিলাম, সিপিআইএমের বহিরাগত যোদ্ধারা তিন দিক থেকে নন্দীগ্রামকে ঘেরার পরিকল্পনা করছে। স্থানীয় কয়েকজন সোর্স এবং ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসাররা আমাকে বলেছিলেন, সিপিআইএম ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে নন্দীগ্রাম দখলের। অল্পবিস্তর শুনতে পাচ্ছিলাম শাসক দলের পরিকল্পনার কথা। ১৪ মার্চের পুলিশ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর যে প্রস্তুতি সিপিআইএম নিতে শুরু করেছিল, আমার মনে হয়েছিল খুব বেশি দিন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি প্রতিরোধ গড়তে পারবে না। ২৪ এপ্রিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বক্তৃতার পর হলদিয়ার মাঠে দাঁড়িয়ে সেখানকার সাংবাদিকদের কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, ‘কয়েকদিনের মধ্যেই নন্দীগ্রামের মানুষ যা মার খাবে কোনও দিনও ভুলতে পারবে না। সিপিআইএম পুরো এলাকা দখল করে নেবে। যারা আন্দোলনের জন্য রাস্তা কেটে পুলিশকে আটকে রেখেছে, তারাই একদিন থানায় যাবে পুলিশ ডাকতে সিপিআইএমের হাত থেকে বাঁচার জন্য।’
সেদিন পূর্ব মেদিনীপুরের সাংবাদিকদের যা বলেছিলাম তা ওই জেলার এক সাংবাদিক শুভেন্দু অধিকারীকে বলে দিয়েছিলেন। সম্ভবত সেদিনই। এর চার-পাঁচ দিন পর শুভেন্দু আমাকে ফোন করে বলেন, ‘তুমি বলেছ, সিপিআইএম আমাদের লোককে মেরে এলাকা দখল করে নেবে। এটা পূর্ব মেদিনীপুর। এখানকার লোক স্বাধীনতার জন্য লড়েছে ব্রিটিশদের সঙ্গে। দেখা যাবে ওদের কত শক্তি। এত সহজ না।’ কোন খবরের ভিত্তিতে আমি ওই কথাগুলো বলেছিলাম তা সেদিন আমি শুভেন্দু অধিকারীকে বোঝাতে পারিনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম, গড়বেতা, কেশপুরের বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকের লড়াইয়ে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি খুব বেশি দিন প্রতিরোধ করতে পারবে না। যতই তেলেগু দীপক, সুদীপ চোঙদারের নেতৃত্বে মাওবাদীরা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির হয়ে বন্দুক ধরুন না কেন। তার একটা কারণ, পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা। পুলিশ সিপিআইএম বাহিনীকে আটকানোর কোনও চেষ্টাই করেনি। বরং নানাভাবে চেষ্টা করছে আন্দোলন দমন করতে। কিন্তু আসল কারণ, নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের ভৌগোলিক অবস্থান। পূর্বদিক বরাবর হলদি নদী, সেদিকে পালানোর কোনও রাস্তা নেই। পালালেও জলপথে গিয়ে উঠতে হবে হলদিয়ায়, সেখানে তখন লক্ষণ শেঠই শেষ কথা। নয়তো জলপথে একদম দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা পূর্ব মেদিনীপুরের অন্য কোথাও। দক্ষিণ দিকে খেজুরি, যেখানে সিপিআইএমের প্রভাব প্রশ্নাতীত এবং সেখান থেকে প্রথম নন্দীগ্রামে আক্রমণ শুরু হয়েছিল। পশ্চিম দিকে নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লক। যেখানেও সিপিআইএমের প্রভাব যথেষ্ট। উত্তর দিকে একটু স্বস্তিকর পরিস্থিতি, কিন্তু সেদিকেও নদী। বেলপাহাড়ি, জামবনি বা লালগড়ে মাওবাদীদের পক্ষে সিপিআইএম বা প্রশাসনের সঙ্গে লড়াই ভৌগোলিকভাবে যতটা সুবিধাজনক ছিল, তা একেবারেই ছিল না নন্দীগ্রামে।

কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে থাকুক বা নাই থাক, এই লড়াই থেকে আর পিছু হঠার প্রশ্নই ছিল না ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির। কারণ, লড়াই আর তখন শুধু জমি বাঁচানোর নয়, লড়াই রাজনীতির। ক্ষমতা দখলের। সিঙ্গুর আন্দোলনে তখন কিছুটা ভাটা পড়েছে। তৃণমূলের আন্দোলনের পাশাপাশি সিঙ্গুরে পাঁচিল তোলা  এবং কারখানার কাজ দিব্যি বহাল রয়েছে। নন্দীগ্রাম আন্দোলন শুরুর সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন হাসপাতালে ভর্তি। তাছাড়া প্রথমদিকে এই আন্দোলন নিয়ে বাকি রাজ্যের সাধারণ মানুষ অনেকটাই বিভ্রান্ত ছিলেন। রাস্তা কাটা, ব্রিজ ভাঙা থেকে শুরু করে পুলিশের গাড়ি পোড়ানো, লাঠি, তরোয়াল নিয়ে মিছিল, সব মিলে রাজ্যের মানুষের মধ্যে নন্দীগ্রাম নিয়ে খানিকটা নেতিবাচক ধারণা ছিল। কিন্তু ১৪ মার্চ সরকার এবং সিপিআইএমের সব হিসেব গোলমাল করে দিল। ১৩ মার্চ পর্যন্ত কলকাতার যে মানুষজন বলছিলেন, এই অগণতান্ত্রিক আন্দোলন ভাঙতে সরকার কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন, কিংবা প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে, তারাই ১৪ মার্চের পুলিশ অভিযানের পর এক মূহুর্তে আন্দোলনকে বৈধতা দিয়ে দিলেন। সাধারণ গ্রামবাসী এবং কৃষকের আন্দোলন ভাঙতে  পুলিশ কেন অতি সক্রিয় হবে, এই প্রশ্ন উঠে গেল রাজ্যজুড়ে। ১৪ জন মানুষের মৃত্যু এবং তারপর কড়া প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের গড়িমসি রাজ্যের মানুষের একটা বড়ো অংশকে নন্দীগ্রামের কাছাকাছি নিয়ে এল। রাস্তা কাটা বা অগ্নিকাণ্ডের মতো উন্নয়নের পরিপন্থী মডেলকে সিপিআইএম বিরোধী শহুরে এলিট সোসাইটির একটা বড়ো অংশ কোনও যুক্তির জাল খাড়া করেও প্রকাশ্যে পুরোপুরি সমর্থন করতে পারছিলেন না, পুলিশি অভিযান তাঁদের হাতে সেই অস্ত্র তুলে দিল। আর নন্দীগ্রামের আন্দোলন রাজ্যের সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়ে যাওয়া মাত্রই তার রাশ হাতে নেওয়ার চেষ্টা করল তৃণমূল কংগ্রেস। ২৪ এপ্রিল হলদিয়ায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জনসভার পরদিনই নন্দীগ্রামে পালটা সমাবেশ ডাকল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। বক্তা শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারী এবং খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২৪ তারিখ রাতে হলদিয়া থেকে কলকাতায় না ফিরে তমলুকে থেকে গেলাম। ২৫ এপ্রিল উত্তপ্ত এবং অবরুদ্ধ নন্দীগ্রামে আন্দোলনের উৎপত্তিস্থল গড়চক্রবেড়িয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাবেশ।
সেদিন আমাকে গড়চক্রবেড়িয়া পৌঁছতে এবং সেখানে সমাবেশ কভার করার ক্ষেত্রে বিশেষ সাহায্য করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নয়তো সেদিন হয় সমাবেশস্থলে ঢুকতেই পারতাম না, নয়তো ১৫ মার্চের মতো আক্রান্ত হয়ে, মার খেয়ে ফিরতে হোত। ২৫ তারিখ সকালেই ঠিক করি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়ের সঙ্গে গড়চক্রবেড়িয়া যাব, একা ঢোকার ঝুঁকি নেব না। সেদিন দুপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গাড়ির পিছন পিছন যাচ্ছি। নন্দীগ্রাম বাজারের একটু আগে টেঙ্গুয়ার মোড়ের কাছাকাছি তৃণমূল নেত্রীর গাড়ি থেকে আমাকে ফোন করলেন শিশির অধিকারী।
‘তুমি ঠিক আছ তো?’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছি।’
‘ওখানে পৌঁছে আমাদের কাছাকাছি থাকবে। তা হলে আমি দেখতে পাব।’
আগের দিন আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলে রেখেছিলাম, ওবি ভ্যান নিয়ে যাব গড়চক্রবেড়িয়ায়। একটু বলে রাখবেন আপনার দলের নেতাদের।
টেঙ্গুয়া মোড় থেকে ডানদিকে না ঘুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয় সোজা এগোতে থাকল। এই রাস্তাটা আমার চেনা নয়। আগে যাইনি। আমি সব সময় টেঙ্গুয়া থেকে ডানদিকে ঘুরে নন্দীগ্রাম বাজার, থানা হয়ে চৌরঙ্গি, হাজরাকাটা হয়ে গড়চক্রবেড়িয়া গিয়েছি। কিন্তু সেই দিন সোজা অনেকটা গিয়ে তারপর ডানদিকে ঘুরে তৃণমূল নেত্রীর কনভয় হাজরাকাটা মোড়ে পৌঁছল। অনেকটা চওড়া করে রাস্তা কাটা। সেই ৩ জানুয়ারি থেকেই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্য নেতাদের গাড়ি যাওয়ার জন্য কাটা রাস্তার ওপর কাঠের পাটাতন দেওয়া। আমাদের গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার পরই এই রাস্তার ধারে দাঁড়ানো ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির লোকজন কাঠের পাটাতন তুলে নিলেন। সাড়ে চারটে-পাঁচটা নাগাদ পৌঁছলাম গড়চক্রবেড়িয়ার মাঠে। রাস্তার ডানদিকে মাঠ। ভর্তি লোক, মাঠে এক ফোঁটা জায়গা নেই। নাম মনে নেই, কোনও একজন স্থানীয় নেতা বক্তৃতা করছেন। মঞ্চে বসে শুভেন্দু অধিকারী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ির পর পরই আমার গাড়ি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশির অধিকারী, শোভন চট্টোপাধ্যায় সোজা মঞ্চে উঠে গেলেন। আমি এবং ক্যামেরাম্যান গাড়ি থেকে নামতেই জনতার মধ্যে থেকে শুরু হল গালিগালাজ, চিৎকার। এক আধজন অল্প ধাক্কাও দিলেন। এর মধ্যেই ক্যামেরার স্ট্যান্ড, মাইক নিয়ে মঞ্চের সামনে পৌঁছলাম। যাতে কেউ চিনতে না পারে মাইকের লোগো লাগাইনি। কিন্তু কয়েকজন আমাকে চিনে নেওয়ায় অনেকেই বুঝে ফেলল। আমি নীচ থেকে শিশিরদার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু শিশিরদা আমার দিকে তাকাচ্ছেনই না। বুঝতে পারছি, আমাকে ঘিরে পরিস্থিতি ঘোরালো হচ্ছে। অভিজ্ঞতায় জানি, এই অবস্থায় কিছুক্ষণ গালিগালাজের পরই কেউ একজন উত্তেজনাটা ছড়ায়। তারপর মারধর, ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া, ওবি ভ্যান ভাঙচুর স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। যে কোনও সময় শুরু হবে। বেপরোয়াভাবে মঞ্চের দিকে তাকাচ্ছি। হঠাৎ দেখি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আড়চোখে আমার দিকে দেখছেন। আমাকে ঘিরে তখন ছোটখাটো একটা জটলা। বুঝতে পারলেন, কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে। তখন বক্তৃতা শুরু করে দিয়েছেন শিশির অধিকারী। তারপর চেয়ার থেকে উঠে মঞ্চের একদম ধারে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন। ভিড় ঠেলে সামনে গেলাম। শিশিরদা বক্তৃতা থামিয়ে দিয়েছেন। সামনে যেতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ওবি ভ্যান ঠিক মতো দাঁড়িয়েছে তো? তার নিতে পেরেছে? গড়চক্রবেড়িয়া পৌঁছনোর একটু আগে গাড়ি থেকেই শোভন চট্টোপাধ্যায় আমাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ফোন করেছিলেন, ঠিক মতো পেছনে পেছনে আসছি কিনা জানতে। তখনই শোভনদাকে বলেছিলাম, ‘আমি ঠিক আছি, মাঠে ওবি ভ্যান পৌঁছেছে। কিন্তু লোকজন তার বের করতে দিচ্ছে না। তবে কী করে লাইভ হবে?’
ঘাড় নেড়ে মমতা ব্যন্দ্যোপাধ্যায়কে বললাম, ‘হ্যাঁ, তার ফেলতে পেরেছি।’
‘ঠিক আছে’, বলেই তৃণমূল নেত্রী পোডিয়ামের সামনে গিয়ে মাইক হাতে বললেন, ‘মিডিয়ার অনেকে এসেছেন এখানে কাজ করতে। আপনাদের আন্দোলনের খবর করতে। মিডিয়ার যাঁরা এসেছেন তাঁদের কাজ করতে দিন।’
আমাকে মঞ্চের কাছে ডেকে ১০ সেকেন্ড কথা আর তৃণমূল নেত্রীর দু’লাইন ঘোষণা ম্যাজিকের মতো কাজ করল। মাইকে শুধু ঘোষণা করলেই চলত, কিন্তু আমাকে ডেকেছিলেন শুধু ওবি ভ্যানের তার নিয়ে জানতে নয়। আমার সঙ্গে একটু কথা বলে লোকজনকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, একে আমি নিজে চিনি, এর যেন কোনও সমস্যা না হয়। তারপর আর সত্যিই সমস্যা হয়নি। আশেপাশের লোকজনও আর কিছু বলছে না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। একটা ঝামেলা মিটেছে। মিটিং কভার করতে আর কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু তখন আমার মাথায় ঘুরছে অন্য একটা বিষয়।
সেই জানুয়ারি থেকেই সিপিআইএম লাগাতার বলে চলেছে, নন্দীগ্রামে অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে মাওবাদীরা। বন্দুকের নলের সামনে লোককে আন্দোলন করতে বাধ্য করছে। যদিও আমি যতবারই আগে এসেছি, যত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, কখনই তা অর্ধসত্য বলেও মনে হয়নি। বরং প্রথম দিন থেকেই আমার মনে হচ্ছিল, জমি রক্ষার জন্য গ্রামবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, তাকে সাহায্য করতে বিভিন্ন মানুষ জড়ো হয়েছেন। তাতে মাওবাদী থাকতে পারে, কিন্তু তারা গোড়া থেকেই চালকের আসনে একথা আমি কখনও বিশ্বাস করিনি।
২৫ এপ্রিল সকালে সিপিআইএমের এক প্রথম সারির নেতার সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘তুমি আজ মমতার মিটিংয়ে  যাবে?’
‘হ্যাঁ যাব তো।’
‘আমরা যেতে পারছি না, পুলিশ ঢুকতে পারছে না। আর তিনি মাওবাদীদের প্রোটেকশনে গড়চক্রবেড়িয়ায় মিটিং করবেন, ভালো করে দেখাও।’
সকাল থেকেই সেই কথাটা মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু মাওবাদীরা তো আর ফুটবলারদের মতো পিঠে নাম লেখা জার্সি পরে ঘুরে বেড়ায় না। তবু চোখ-কান খোলা রেখে যতটা সম্ভব চেষ্টা তো অন্তত করতে পারি। গড়ক্রবেড়িয়া মাঠে পৌঁছানোর পর বেশ খানিকটা সময় কেটে গিয়েছে গালিগালাজ, ঘেরাওয়ের জন্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সেই বাধা কেটেছে। এখন লোকজন আমাকে জরিপ করছে ঠিকই, কিন্তু কিছু বলছে না। মঞ্চে শুভেন্দু অধিকারীর বক্তৃতা চলছে, আর আমি চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছি। সত্যিই কি সন্দেহজনক কেউ আছে কোথাও? সামনে থেকে কিছু বোঝা কঠিন, আস্তে আস্তে এগোলাম মঞ্চের পেছন দিকে।
মঞ্চের ৪০-৫০ মিটার পেছন একাধিক জটলা। কিছু কম বয়সী ছেলে, লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এটা ঠিক, ২৫ এপ্রিল ২০০৭, গড়চক্রবেড়িয়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিটিংয়ে নন্দীগ্রাম বা পূর্ব মেদিনীপুরের বাইরের অনেক জায়গা থেকেও তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী, সমর্থকরা গিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসের বহিরাগত কর্মীদের ওপরও সেদিন নজরদারি করছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির লোকজন। এমনকী সেদিনের মিটিংয়ে বাইরে থাকে কত গাড়ি নন্দীগ্রামে আন্দোলনের আঁতুড়ঘর গড়চক্রবেড়িয়ায় ঢুকেছিল তারও হিসেব করা হয়েছিল আলাদাভাবে। কাটা রাস্তায় যেখানে কাঠের পাটাতন ফেলে গাড়ি যাওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, সেখানেই মিটিং শেষে তারা মিলিয়ে নিচ্ছিল, যত গাড়ি ঢুকেছে তার মধ্যে সব বেরিয়েছে কিনা। তা আমি টের পেয়েছিলাম ফেরার সময়। কারণ, ঢোকার সময় আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। তাই বাইরে থেকে কত গাড়ি ঢুকেছে এই হিসেবের দায়িত্বে যারা ছিল, তারা আমাদের গাড়িকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারেনি। ভেবেছিল এটাও কনভয়ের গাড়ি। কিন্তু ফেরার সময় ক্যামেরা, স্ট্যান্ড গুটিয়ে আমরা তাড়াতাড়ি করে ভিড়ের মধ্যে কনভয় ধরতে পারিনি। মাঠ থেকে বেরতে সামান্য দেরি হয়ে যায়। ফেরার সময় হাজরাকাটার চেকপোষ্টে তাই আমাদের গাড়ির হিসেব মিলছিল না। আমি গাড়িতে বসে ভাবছি, এবার আর একটা ঝামেলায় পড়লাম। কিন্তু ওদের কারও মনে হল, ঢোকার সময় ওদেরই হিসেবে কোনও ভুল হয়েছে। তাই ছেড়ে দিল। তাছাড়া আমরা তখন বেরিয়ে যাচ্ছি নন্দীগ্রাম থেকে, তাই আটকে রাখার কোনও মানেও ছিল না ওদের। যত লোক ঢুকেছে, সবাই যাতে বেরিয়ে যায় নন্দীগ্রাম থেকে এটা নিশ্চিত করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, এই বাইরের গাড়ির হিসেব রাখা এবং চেক করে ঢোকানোর প্লানিং ছিল মাওবাদীদেরই। বিশেষ করে সোনাচূড়া থেকে গড়চক্রবেড়িয়া পর্যন্ত জায়গাটা বরাবরই মাওবাদীদের কাছে ছিল সেফ প্যাসেজ। এখানে কোনও বাইরের লোকের গতিবিধি তারা বরদাস্ত করত না।

২৪ এপ্রিল ২০০৭, হলদিয়ায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং পরদিন গড়চক্রবেড়িয়ায় মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মিটিং নতুন করে আগুন জ্বাললো নন্দীগ্রামে। বারুদের স্তুপ হয়েই ছিল, পরপর দু’দিন সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য তাতে অগ্নিসংযোগ করল মাত্র। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বক্তৃতায় কোনও প্ররোচনা না থাকলেও হুঁশিয়ারি ছিল নন্দীগ্রামের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, গড়চক্রবেড়িয়ার সমাবেশ নন্দীগ্রাম এবং খেজুরির মধ্যে ফের যুদ্ধ লাগিয়ে দিল। এমন নয় যে এই সমাবেশ না হলে যুদ্ধ লাগত না, তা অনিবার্যই ছিল। এরপর মারাত্মক হিংস্র চেহারা নিল নন্দীগ্রাম, খেজুরি।
২৯ এপ্রিল সকাল থেকে নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক এবং খেজুরি সীমান্ত এলাকা বরাবর তীব্র সংঘর্ষ শুরু হলো দু’পক্ষের। সাতেঙ্গাবাড়ি, শিমুলকুণ্ড, বৃন্দাবনচক, গিরিরবাজার সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রাথমিকভাবে সাফল্য পায় তেলেগু দীপক,  মধুসূদন মন্ডল, আদিত্য বেরাদের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। কিন্তু বড়ো প্রতিরোধের মুখে তারা পড়ে বাহারগঞ্জ এলাকায়। প্রায় সারাদিন গুলি বিনিময় চলে দু’পক্ষের। মৃত্যু হল দু’দল মিলিয়ে অন্তত ৪ জনের। সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে বলা অসম্ভব, কারণ দু’পক্ষই যতটা পেরেছে নিজেদের লোকের মৃতদেহ তুলে নিয়ে মাটির নিচে পুঁতে দেয়। জখম অনেকে। ভাঙচুর এবং অগ্নি সংযোগ করা হয় বহু বাড়িতে। দু’দল বহিরাগত সশস্ত্র বাহিনীর এলাকা দখলের উন্মত্ত লড়াইয়ের মাশুল দিতে হল মহিলাদের। শিশুদের। সেই মহাভারতের পাশা খেলার সময় থেকেই যুগে যুগে যে কোনও লড়াইয়ে, যুদ্ধে এক নম্বর টার্গেট মহিলারা। তার বাইরে নয় নন্দীগ্রামও। সেখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ যত তীব্র হয়েছে মহিলাদের ওপর আক্রমণও ততই বেড়েছে। ৩ জানুয়ারি থেকেই ঘরছাড়া হওয়া শুরু হয়েছিল নন্দীগ্রামে। ২৯ এপ্রিলের সংঘর্ষে নতুন করে গৃহহীন হলেন বহু পুরুষ, মহিলা। বড়োদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং রক্ষার লড়াইয়ে শৈশব, কৈশোর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল বহু বাচ্চার।

 

সিপিএম-মাওবাদী সংঘর্ষ এবং মাস্টারদা 

বর্ষার মধ্যেই সিপিআইএম বাহিনী প্রায় সোনাচূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী কীভাবে নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধার করল তা উল্লেখ করব মাস্টারদার মুখে। যেভাবে তিনি আমাকে বলেছেন।
‘আমাদের ছেলেরা ক্যাম্পগুলোর দায়িত্ব পুরোপুরি নিয়ে নেওয়ার পর আস্তে আস্তে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি পিছু হঠতে শুরু করে। গোকুলনগর, অধিকারীপাড়ায় রীতিমতো লড়াইয়ের পর বর্ষার ঠিক আগে আমরা প্রায় সোনাচূড়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে একটা বাজে দুর্ঘটনা ঘটে গেল। মাওবাদীরা আমাদের ঠেকাতে রাস্তার নানা জায়গায় ল্যান্ড মাইন পেতে রাখতে পারে এমন ধারণা ছিল আমার। গড়বেতা, চন্দ্রকোণায় এই ঘটনা আমি অনেক দেখেছি। আমি বারবার আমাদের ছেলেদের সাবধান করেছিলাম, ওদের দখলে থাকা এলাকায় প্রথমবার ঢুকে একদম যেন রাস্তায় না ওঠে। এমনকী ধান ক্ষেতের আল দিয়েও হাঁটতে না করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, সব সময় মাঠ দিয়ে যাতায়াত করতে। কিন্তু নন্দীগ্রামের ছেলেদের এর আগে কোনওদিন ল্যান্ড মাইনের অভিজ্ঞতা ছিল না। আমরা যেদিন প্রথম সোনাচূড়ার দিকে এগোচ্ছি সেদিনই ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে আমাদের ৬ জন মারা গেল। গড়বেতা, কেশপুরের কেউ মারা যায়নি। সবকটা ছেলেই ছিল নন্দীগ্রামের। আমরাই তাদের মৃতদেহ তুলে এনে সরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় আমাদের অভিযান একটু ধাক্কা খেল। তারপর পুরো বর্ষাকালে মাঝে মাঝে নানা জায়গায় লড়াই হয়েছে। কখনও ওরা ২ নম্বর ব্লকে ঢোকার চেষ্টা করেছে, আমরা ঠেকিয়েছি গুলি চালিয়ে, কখনও আবার আমরা ওদের এলাকায় আক্রমণ করেছি।  কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, ওদের মনোবল দিন দিন কমছে। ওরা নতুন এলাকাও দখল করতে পারছিল না, তাছাড়া ওদের নিজেদের মধ্যেও নানা গণ্ডগোলের খবর পাচ্ছিলাম। মাওবাদী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে নানা বিষয়ে গোলমাল হচ্ছিল। ওদের দখলে থাকা এলাকায় আমাদের যারা সমর্থক ছিল তারাই ওদের গতিবিধি নিয়ে নানা খবর দিত। তবে সব সময়ই মনে হোত, যে কোনও সময় বড় ধরনের একটা আক্রমণের পরিকল্পনা করবে মাওবাদীরা। আমরা পশ্চিম মেদিনীপুরে রাজনীতি করা লোক। ওদের দীর্ঘদিন চিনি। অনেক দিন ব্যাকফুটে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা বড়ো কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। তাই বিন্দুমাত্রও অসতর্ক হওয়ার জায়গা নেই। ছেলেদের মধ্যেও যাতে কোনও আত্মতুষ্টি না আসে তার জন্য আমি নিজে সবকটা ক্যাম্পে রোজ যেতাম। সতর্ক করতাম আমাদের ছেলেদের। বলতাম, অনেক এগিয়ে গিয়েছ বলে ভাবার কোনও কারণ নেই লড়াই শেষ।
তারিখ খেয়াল নেই, যত দূর মনে পড়ছে সেপ্টেম্বরের শুরু বা মাঝামাঝি হবে, একদিন রেয়াপাড়া পার্টি অফিসে বসে আছি। সন্ধে নাগাদ অশোক গুড়িয়া এসে আমাকে বললেন, ‘মাস্টার, কথা আছে, আপনার সঙ্গে বসতে হবে। একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে।’
জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?
‘কিছুক্ষণ আগে সাতেঙ্গাবাড়ির গ্রামে আমাদের লোকরা খবর দিল, ওখানে মাওবাদীরা বড়ো বাহিনী জড়ো করছে। সঙ্গে প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র। প্ল্যান করছে রানিচক দখল করার। দুপুর থেকে অনেক লোকের আনাগোনা হচ্ছে। সাতেঙ্গাবাড়ি থেকে এসে রানিচক আক্রমণ করে দখল করে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তখন রেয়াপাড়া ঢুকে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। তা হলে কিন্তু বিপদ। আমাদের লোক এইমাত্র ফোনে খবর দিল, কাল ভোররাতেই রানিচক আক্রমণের প্ল্যান করছে ওরা।’

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১২: নন্দীগ্রামে পৌঁছলেন গৌরাঙ্গ নামে এক যুবক, তিনিই তেলেগু দীপক, মাওবাদী নেতা

 

অশোক গুড়িয়ার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে, তখন সন্ধে ৭ টা মতো বাজে। সেই সময় রানিচকে আমাদের ক্যাম্পে ছিল ৬-৭ জন। আমি জানতাম, মাওবাদীদের বড়ো দল আক্রমণ করলে আমাদের ওই কয়েকজন বেশিক্ষণ লড়তে পারবে না। রানিচক হাতছাড়া হয়ে যাবে। অশোক গুড়িয়াকে বললাম, তাড়াতাড়ি দুটো গাড়ির ব্যবস্থা করুন, আমি বেরবো। আমার সঙ্গে সব সময় গড়বেতার ১৫-১৬ জন থাকতো, সবাই বন্দুক চালানোয় ওস্তাদ। ওদের বলে দিলাম, রেডি হতে। ঠিক করলাম ওদের নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারি রানিচক পৌঁছে যাব। মাওবাদীরা সাতেঙ্গাবাড়ি থেকে ভোররাতে আক্রমণের আগেই আমাদের পজিশন নিয়ে নিতে হবে। খোলা মাঠ, জঙ্গল বা যে কোনও জায়গায় যুদ্ধে ঠিক পজিশন নেওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রাত ১০ টার মধ্যে অশোক গুড়িয়া দুটো ট্রেকার পাঠিয়ে দিল রেয়াপাড়া পার্টি অফিসে। আমাদের ছেলেরাও ততক্ষণ খেয়েদেয়ে রেডি ছিল। যাতে আমাদের যাওয়ার খবর খুব বেশি জানাজানি না হয় তার জন্য আর একটু রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। প্রায় মাঝরাতে আমার সঙ্গে থাকা গড়বেতার ১৫-১৬ জনকে নিয়ে দুটো ট্রেকারে চেপে রওনা দিলাম রানিচকের দিকে। আমার প্ল্যান ছিল, মাঝরাতেই পজিশন নিয়ে নেব, যাতে মাওবাদী এবং তৃণমূলিরা বুঝতে না পারে আমাদের বড়ো দল রেডি হয়ে বসে আছে। ওরা জানত আমাদের রানিচক ক্যাম্পে কম লোক আছে। মনে হচ্ছিল, আমাদের ক্যাম্পে লোক কম আছে জেনে মাওবাদীরা সকাল-সকাল আক্রমণ চালাবে।

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.