নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২: কাল নন্দীগ্রামে গিয়ে কী করবেন? জিজ্ঞেস করলেন লক্ষ্মণ শেঠ

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০১২ সালে সিপিআইএমের রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে নন্দীগ্রাম কাণ্ড নিয়ে সমালোচিত হওয়ার পর বিমান বসুকে পাল্টা রিপোর্ট দিয়েছিলেন লক্ষ্মণ শেঠ। কিন্তু নন্দীগ্রাম পর্বে কী ভূমিকা ছিল তাঁর……

 

নন্দীগ্রাম 

‘কাল নন্দীগ্রামে গিয়ে কী করবেন?’ গলায় কোনও উত্তেজনা নেই, হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলেন লক্ষ্মণ শেঠ। তমলুক পার্টি অফিসে বসে আছেন একটা সাধারণ চেয়ারে। তাঁর দু’দিকে বসে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দুই সিপিআইএম নেতা নির্মল জানা এবং কানু সাহু। পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিআইএম সম্পাদক সুধীর গিরি তখন অসুস্থ। ১৩ মার্চ, ২০০৭, সন্ধে সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে। তার কয়েকদিন আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল, নন্দীগ্রামে পুলিশ যাবে যে কোনও সময়।
সেদিন, ১৩ মার্চ দুপুরে অফিসে বসে আছি, পূর্ব মেদিনীপুরের এক পরিচিত পুলিশ অফিসার ফোন করলেন। বললেন, ‘কাল তো নন্দীগ্রামে অপারেশন’। বিভিন্ন জেলা থেকে গাড়ি গাড়ি ফোর্স আসছে। একটু আগেই কোলাঘাটে সিনিয়র আফিসারদের ব্রিফিং শেষ হল। বিকেলে খেজুরির বিদ্যাপিঠ মোড়ে ফোর্স ডেপ্লয়মেন্ট নিয়ে মিটিং। কখন আসছেন?’
আগের দিনই শুনেছি, নন্দীগ্রামে পুলিশ যাবে চূড়ান্ত হয়েছে। আড়াই মাস বাদে পুলিশ ঢুকবে সেখানে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘গোলমাল হতে পারে?’
‘হতে পারে মানে? ঝামেলা হবেই। এখনও কোনও প্ল্যানিং নেই। কী হবে কেউ জানে না। গ্রামের লোক বাধা দিলে বড়ো গণ্ডগোল হবেই। খবরও পাচ্ছি তেমনই, নন্দীগ্রামের মানুষ প্ল্যান করছে পুলিশকে বাধা দেওয়ার। কিন্ত এখনও জানি না কী করতে হবে, কার কী কাজ। শুধু দেখছি গাড়ি গাড়ি ফোর্স আসছে অন্য জেলা থেকে। বিকেলে খেজুরিতে মিটিং।’
সঙ্গে সঙ্গে জানালাম অফিসে, সেই ৩ জানুয়ারি থেকে টানা নন্দীগ্রামে যাচ্ছি, জানি ওখানে পরিস্থিতি খুব খারাপ। পুলিশ ঢুকলে কী যে হবে, কেউ জানে না। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিকেলে রওনা দিলাম নন্দীগ্রাম। আমার সঙ্গে ক্যামেরাম্যান সৌমেন পান। যেতে যেতে রাস্তায় ফোন করলাম পূর্ব মেদিনীপুর এবং রাজ্য পুলিশের কয়েকজন সিনিয়ার অফিসারকে। কেউই কিছু বলছিলেন না পরিষ্কার করে। তবে সবার সঙ্গেই কথা বলে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঘটছে, সবার গলায় কেমন যেন একটা গোপনীয়তা। কী হবে, কীভাবে হবে অভিযান, কেউই খুব একটা কিছু জানেন না। অথবা জানলেও বলতে চাইছেন না। যেতে যেতে সন্ধে হয়ে গেল। তমলুকে পৌঁছলাম, প্রায় সন্ধে সাতটা। এই রাতে নন্দীগ্রামে যাওয়া ঠিক হবে না। অভিজ্ঞতায় জানি, তখন নন্দীগ্রামের সর্বত্র সমস্ত সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষেধ। কাঁথির তৃণমূল কংগ্রেস কিংবা হলদিয়ার সিপিআইএম নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তবেই অনুমতি মেলে নন্দীগ্রাম বা খেজুরিতে ঢোকার। কাঁথির অধিকারী পরিবার বা হলদিয়ার লক্ষ্মণ শেঠের শ্রমিক ভবন থেকে ইস্যু করা সেই ভিসা কিংবা মৌখিক অনুমতি নিয়ে গেলেই  যে নন্দীগ্রাম এবং খেজুরিতে আর কোনও ঝামেলা নেই, তাও নয়। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের হাতে হয়তো আক্রান্ত হতে হল। হয়তো কেন, আক্রান্ত হতে হয়েওছে বহুবার। কিন্তু ১৩ মার্চ সন্ধ্যায়, সেই মূহুর্তে কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলে মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কী হবে কাল? সোজা চলে গেলাম তমলুকে সিপিআইএমের পার্টি অফিস। তখনও নিমতৌড়িতে নতুন পার্টি অফিস হয়নি। তমলুকের মানিকতলা মোড়ের জেলা পার্টি অফিসে গিয়ে শুনি, ভিতরে মিটিং চলছে। ভেতরে খবর পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। খানিক বাদে ডাক পড়ল অফিসের ভেতরে, বসে আছেন লক্ষণ শেঠ। একদিকে নির্মল জানা, অন্যদিকে কানু সাহু।
‘আমি তো আজই চলে এলাম, কাল কী হবে নন্দীগ্রামে? জিজ্ঞেস করলাম লক্ষণ শেঠকে।
‘পুলিশ রাস্তা বানাতে যাবে। রাস্তা সব কাটা, পঞ্চায়েত কোনও কাজ করতে পারছে না প্রায় তিন মাস। সেই সব চালু করতে হবে। কাল নন্দীগ্রামে গিয়ে কী করবেন? রাস্তা টাস্তা সব ঠিক হয়ে যাক, তারপর যাবেন।’ উত্তর দিলেন তমলুকের সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ, বকলমে তিনিই তখন সিপিআইএমের জেলা সম্পাদক।
‘কিন্তু এতদিন পর পুলিশ যাবে। আমাদের তো যাওয়া দরকার।’
লক্ষ্মণ শেঠকে বেশ কয়েকবার বলার পর উনি বললেন, ‘ঠিক আছে যান। তবে রাস্তা তো বেশিরভাগই কাটা। পুলিশ ঢুকে সারিয়ে টারিয়ে দেওয়ার পর গেলে ভাল করবেন।’
‘সে তো রাস্তা সরানোর পর যাবই, কিন্ত আপনি দলের লোকেদের বলে দিন, আমি খেজুরি দিয়ে ঢুকব নন্দীগ্রামে।’
‘ঠিক আছে।’ আশ্বাস দিলেন লক্ষণ শেঠ।
‘আপনি বলে রাখবেন আপনার লোকেদের। সমস্যা হলে ফোন করব,’ বেরোলাম সিপিআইএম জেলা পার্টি অফিস থেকে।
কিন্ত তাঁর কথা শুনে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, সিপিআইএম চায় না, ১৪ মার্চ বাইরের কেউ নন্দীগ্রামে ঢুকুক। পরদিন খুব ভোরে নন্দীগ্রামে যাব ঠিক করে রাত প্রায় ন’টায় হোটলে ঢুকলাম। সেটাই আমার ভুল হয়েছিল। অপূরণীয় ভুল। সেই আফসোস কোনও দিন যাওয়ার নয়। উচিত ছিল, ১৩ তারিখ রাতের অন্ধকারেই লুকিয়ে নন্দীগ্রামে ঢোকার চেষ্টা করা। ঢুকতে পারতাম কিনা জানি না, তবে চেষ্টা করা উচিত ছিল। যা আমি আর সেই দিন করিনি। সিপিআইএম একটা কিছু চক্রান্ত করছে, লক্ষণ শেঠের কথায় একটা আশঙ্কা আমার হয়েছিল, একটা আঁচ করেছিলাম। কিন্তু সেটা ঠিক কী, কতটা ব্যাপক, তখন তা একেবারেই বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি কতটা গভীর এই ষড়যন্ত্র।
সিপিআইএমের কোন স্তরের নেতৃত্ব ১৪ মার্চ পুলিশ অভিযানের সময় নন্দীগ্রামকে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? কেন নিয়েছিলেন এমন সিদ্ধান্ত? কী ছিল তাঁদের আগাম পরিকল্পনা? তাঁদের এই সিদ্ধান্তের কথা কোন কোন পুলিশ অফিসার জানতেন? অভিযানের সময় নন্দীগ্রামকে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার এই যোগসাজশটা পুলিশ এবং সিপিআইএমের কোন পর্যায়ে হয়েছিল? প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর পেতে আমার সময় লেগেছে কয়েক বছর। পরে বহুবার ভেবেছি, ১৪ই মার্চ পুলিশি অভিযানে বড়সড় গণ্ডগোল হতে পারে এই আশঙ্কা  আমার হয়েছিল আগের দিন দুপুরে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলার পর। কিন্তু সেদিন নন্দীগ্রামে ঢোকার জন্য আগাম অনুমতি নিতে আগের সন্ধ্যায় আমি সিপিআইএম পার্টি অফিসে গিয়েছিলাম কেন? তখন তো জানতাম না, ১৪ জনের মৃত্যু হবে! জানতাম না পুলিশের ওই আধ ঘণ্টার অভিযানের পর নন্দীগ্রামের শয়ে শয়ে মানুষ সিপিআইএম বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অত্যাচারের অভিযোগ করবে! তখন তো এই ভাবনা মাথায় আসার কোনও কারণও ছিল না, প্রায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো রাজ্যের লিজ নেওয়া সিপিআইএম সরকারের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে উঠবে নন্দীগ্রাম। কিন্ত কেন জানি না, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ১৩ মার্চ বিকেল থেকেই মনের মধ্যে একটা খোঁচা দিচ্ছিল, কিছু একটা কাল হবে।এই খোঁচাটা ঠিক কী, লিখে বোঝানো আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে কথা বলে বারবার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে কোথাও।
১৩ তারিখ রাত ১১টা নাগাদ তমলুকের হোটেল থেকে অফিসের এক সিনিয়রকে ফোন করে বলেছিলাম, ‘কাল মনে হচ্ছে বড়ো ঝামেলা হবে।’ ১৪ মার্চ দুপুরের পর থেকে হাজারবার ভেবেছি, নন্দীগ্রাম রহস্যের সমাধান করতেই হবে। খালি চোখে অনেক কিছুই অস্বাভাবিক লাগছে, অনেক প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি না। এই সমস্ত উত্তর জানতে হবে। জানতেই হবে।

 

৩ জানুয়ারি, ২০০৭ 

এজেসি বসু রোডে স্টার আনন্দর অফিস, দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। অফিসে বসে আছি, হঠাৎ চার লাইনের একটা খবর এল অফিসে। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে একটা বড় গণ্ডগোল হচ্ছে। খবরটা  অফিসে প্রথম দিলেন আমাদের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুকের সাংবাদিক শুভময় জানা। দুপুর থেকেই একটা গণ্ডগোলের খবর আসছিল, বিকেলে জানা গেল, গ্রামের লোকজন পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশকে আক্রমণ করেছে, পালটা গুলি চালিয়েছে পুলিশও। ব্যাপারটার গুরুত্ব তখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি। বুঝতে বুঝতে আরও ঘন্টা দুয়েক কেটে গেল। সন্ধে নাগাদ মোটামুটি জানা গেল, নন্দীগ্রামের কালীচরণপুর নামক একটি এলাকার পঞ্চায়েত অফিসে সকালে মিটিং হচ্ছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে এই মিটিং। স্থানীয় মানুষ এই মিটিংয়ে বাধা দিলে পুলিশ যায় ঘটনাস্থলে। পুলিশ আক্রান্ত হয়ে প্রথমে গুলি চালায়, পরে পালিয়ে যায়। পুলিশ ঠেকাতে গ্রামবাসীরা রাস্তা কাটতে শুরু করে। সন্ধে ছ’টা নাগাদ অফিসে যুবরাজ ভট্টাচার্য আমাকে ডেকে বললেন, যেতে হবে নন্দীগ্রাম। নাম শুনেছি, কিন্তু আগে কখনও যাইনি। জানিও না কীভাবে যায়। ফোন করলাম শুভেন্দু অধিকারীকে। তিনি সেই সময় বিধায়ক, পূর্ব মেদিনীপুর জেলারই দক্ষিণ কাঁথি বিধানসভার। ২০০২ সালের শেষদিকে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখন তিনি কাঁথি পুরসভার কাউন্সিলার। তার আগের বছর ২০০১ সালে বিধানসভা ভোটে মেদিনীপুর জেলার মুগবেড়িয়া আসনে জোরদার লড়ে হেরে গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী কিরণময় নন্দর কাছে। প্রচণ্ড জেদি এবং সাধারণ, গড়পড়তা দক্ষিণপন্থী নেতাদের তুলনায় আত্মসম্মানবোধ অনেকটাই বেশি, পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে শুভেন্দু অধিকারী সম্পর্কে এই আমার ধারাবাহিক মূল্যায়ন।
যেতে না করলেন না। তবে ফোনে শুভেন্দু বুঝিয়ে দিলেন, নন্দীগ্রামে যাওয়া খুব বিপজ্জনক। বললেন, ‘নন্দীগ্রামের মানুষ মিডিয়ার ওপর প্রচণ্ড রেগে আছে। এখন রাতেরবেলা যাওয়া ঠিক হবে না। কাল সকালে যেও।’ পরামর্শ দিলেন শুভেন্দু।
‘কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। কেন রেগে আছে মিডিয়ার ওপর?’
‘মানুষ নিজের জমি দেবে  না, সরকার পুলিশ পাঠিয়েছে জমি দখল করতে। আর তোমরা তো জমি অধিগ্রহণের পক্ষে। সিঙ্গুরে তোমরা সব কী খবর করছ, তা নন্দীগ্রামের মানুষ জানে। তোমরা তো সিঙ্গুর নিয়ে বিরুদ্ধে খবর করছ। এখানকার লোক কিন্তু সিঙ্গুরের মতো নয়।’ আরও কিছু কথার পর শুভেন্দুর পরামর্শ, ‘সাবধানে যেও।’
‘তুমি ওখানে  তোমাদের নেতাদের একটু বলে দাও আমার কথা।’
‘আমি বলে দেখতে পারি, কিন্তু কোনও কথা দিতে পারছি না। ওখানে যা পরিস্থিতি হয়ে আছে, এখন তোমার দায়িত্ব নেওয়া মুশকিল।’
সেই রাত থেকে তারপর যতবার নন্দীগ্রাম গিয়েছি প্রতিবার কোনও না কোনও ঘটনায় বুঝতে পেরেছি, নন্দীগ্রাম কিন্ত সিঙ্গুর নয়। নন্দীগ্রাম আসলে কারোর মতো নয়। নন্দীগ্রাম স্বতন্ত্র, সবার চেয়ে আলাদা। এবং আমার মতো যে কোনও শিক্ষানবিশের কাছে সাংবাদিকতার সেরা শিক্ষক হওয়ার সমস্ত গুণসম্পন্ন একটা জায়গার নাম নন্দীগ্রাম।
শুভেন্দুর সঙ্গে কথার পর ফোন করলাম স্টার আনন্দের কাঁথির প্রতিনিধি শঙ্কুদেব পাণ্ডাকে। নন্দীগ্রাম নিয়ে কী ডেভেলপমেন্ট আছে, তার খবর নেওয়ার জন্য। পরে আমার সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্টে বহুদিন নন্দীগ্রামে ছিলেন শঙ্কুদেব পাণ্ডা। পরে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন।
অফিস থেকে বেরতে বেরতে প্রায় সাড়ে আটটা-নটা হয়ে গেল। সঙ্গে ক্যামেরাম্যান উজ্জ্বল ঘোষ। গাড়ির ড্রাইভার সুরেশ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। যেতে যেতে বিভিন্ন লোককে ফোন করে খোঁজ নিতে শুরু করলাম নন্দীগ্রাম সম্পর্কে। কিছুটা জানতাম, বাকিটা মোটামুটি যা বোঝা গেল, কেমিক্যাল হাবের জন্য নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক প্রায় পুরোটা এবং খেজুরির কিছু মৌজার জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। সেটা ২০০৬ সালের শেষ দিকের কথা। এই নিয়ে নন্দীগ্রামে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা উত্তেজনা, আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছিল। ৩ জানুয়ারি ২০০৭, মানে সেদিন সকালে নন্দীগ্রামের গড়চক্রবেড়িয়া এলাকার কালীচরণপুর ১০ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে একটা মিটিং ছিল। তার জন্য সরকারি অফিসাররা কালীচরণপুর পঞ্চায়েত অফিসে যান। গ্রামের লোকজন পঞ্চায়েত অফিসে চলে আসেন বিক্ষোভ দেখাতে। তাঁদের দাবি, জমি জোর করে দখল করা যাবে না, মানুষ জমি দেবে না। তখন সিঙ্গুরে ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার জমি অধিগ্রহণ করছে। ফলে জমি নিয়ে রাজ্যজুড়ে একটা উত্তেজনার পরিবেশ। কলকাতায় ২৬ দিন অনশনের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সদ্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সিঙ্গুরে জমি নিয়ে আন্দোলনের এই আবহে সেই দিন, ৩ জানুয়ারি কয়েক’শো মানুষ নন্দীগ্রামে কালীচরণপুর পঞ্চায়েত অফিসে মিটিং চলাকালীন গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। গ্রামবাসীদের দাবি, জমি দখলের এই মিটিং বন্ধ করতে হবে। অফিসাররা বললেন, তাঁরা জমি অধিগ্রহণ নিয়ে মিটিং করতে আসেননি। কিন্তু গ্রামবাসীরা তা মানতে নারাজ। এই নিয়ে দীর্ঘক্ষণ পঞ্চায়েত অফিসে ঝামেলা চলে। শেষে পঞ্চায়েত প্রধান সামেরণ বিবি পুলিশকে খবর দেন। থানা থেকে এক গাড়ি পুলিশ যায় বিক্ষোভ হঠাতে। এতেই আগুনে ঘি পরে। পুলিশকে আক্রমণ করে বিক্ষোভকারীরা। পুলিশ শূন্যে গুলি চালায়। এরপর পুলিশ কোনওভাবে পালিয়ে বাঁচে। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের জিপে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশের ফের গ্রামে ঢোকা বন্ধ করতে বিকেল থেকেই নন্দীগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পিচের রাস্তা কাটতে শুরু করেন আন্দোলনকারীরা।
গাড়ি কলকাতা ছাড়িয়ে বম্বে রোডে পড়ল। মনে পড়ছে মাত্র কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া পরপর সব ঘটনা। কয়েকদিন আগেই টানা অনশন করে তখন নার্সিংহোমে ভর্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারও মাস তিনেক আগে ২০০৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে সিঙ্গুরে বিডিও অফিসে ধরনা দিয়ে শুরু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমি আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়। দ্বিতীয় বলার কারণ, ২০০৫ সালেই জমি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্ত তখন তা ততটা দানা বাঁধতে পারেনি। ২০০৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বামফ্রন্টের ২৩৫ আসন। তৃণমূল ৩০। তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে বিরোধী দলের মর্যাদা পাবে কিনা তা নিয়ে বিধানসভার অধ্যক্ষ হাসিম আবদুল হালিম থেকে শুরু করে সিপিআইএমের নানা নেতার কটাক্ষ। ২৩৫ আসন পেয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এক লাইনে ভোটের পর্যালোচনা সেরে ফেলল, এই জয় বামফ্রন্টের শিল্পায়নের স্লোগানে অনুমোদন। ফলে আইনি বা বেআইনি রাস্তায় জমি দখলে আর কোনও বাধা নেই। কোনও কোনও সিপিআইএম নেতা এমনও ভেবে নিলেন, একবার মহাকরণ থেকে ঘোষণা করলেই হয়, এসএফআই, ডিওয়াইএফআই আয়োজিত রক্তদান শিবিরের মতো বাংলার গ্রামে-গ্রামে মানুষ স্বেচ্ছায় সরকারকে জমি দেওয়ার জন্য শিবির খুলবেন। তাই চিন্তার আর কিছু নেই। হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরীদের দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম, জমি বিলি, অপারেশন বর্গা, কৃষক সভার ভূমিকা সবাই তুচ্ছ। গ্রামের সাধারণ মানুষের জমি নিয়ে জন্মাবধি আবেগ এবং অনুভূতিকে আন্ডারএস্টিমেট করা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ধরে নিলেন, রাজ্য সরকারের শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকে জেলার ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসার, এঁদের বুদ্ধি আর পরামর্শেই পশ্চিমবঙ্গে জেট প্লেনের গতিতে শিল্পায়ন হবে। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিত্বে তখন আবিষ্ট সিপিআইএমের একটা বড়ো অংশ। তখন সিপিআইএমের রাজ্য কমিটির মিটিং মানে, কার্যত হীরক রাজার দরবার। রাজা যা বলেন সবাই তা মানেন। বেশিরভাগ নেতারই ঘাড় নাড়া ছাড়া কোনও কাজ নেই। মাঝেমধ্যে গোলমাল করেন কিছু কৃষক আর শ্রমিক! তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যন্তর-মন্তর ঘরে। আর তার পরেও যে দু-একজন প্রতিবাদ করে যান, তাঁরা পার্টির শত্রু, মানে জনগণের শত্রু, মানে তৃণমূল। শুরু হয়ে যায় পার্টিতে তাঁদের একঘরে করে দেওয়ার প্রক্রিয়া।
সেই সময় সিপিআইএমের রাজ্য কমিটির মিটিং প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল একদিনের কথা। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ধর্মতলা মোড়ে নাছোড়বান্দা অনশন করছেন, প্রথমদিকে তাকে ততটা গুরুত্ব না দিলেও কয়েকদিনের মধ্যেই খানিকটা চাপে পড়ে যায় রাজ্য সরকার। মহাকরণের ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে বিরোধী নেত্রীর এই অনশন নাকের ডগায় মাছি বসার থেকেও বেশি অস্বস্তির। অনশন প্রত্যাহার করে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একাধিক চিঠিও পাঠান মুখ্যমন্ত্রী। অন্যদিকে, এই অনশন নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারাও। প্রথম ৫-৭ দিন, ১০ দিন তো হই হই করে কেটে গেছে, তারপর থেকেই অনশন কীভাবে উঠবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধনুক ভাঙা পণ, সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকের জমি কোনওভাবে নেওয়া যাবে না। সেই সময় রাজ্য সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। একাধিকবার তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনের সঙ্গে কথাও বলেন। দলনেত্রীর ক্রমেই অবনতি হওয়া শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। চাইছিলেন আলোচনার মাধ্যমে একটা উপায় বের করতে, যাতে দলনেত্রী অনশন তুলে নেন। কিন্ত সমাধান সূত্র কিছুতেই বেরোচ্ছিল না।
এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। অনশন উঠে গিয়েছে, বিধানসভা চলছে। বিধানসভার ভেতরে কোনও একটা আলোচনায় সরকারের স্বাভাবিক সমালোচনা করছে বিরোধী দল। বিধানসভায় উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রীও। বিধানসভায় হই হট্টগোলের মাঝে হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বললেন, ‘এখন দলে নাম্বার বাড়ানোর জন্য এত কথা বলছেন। আর আমার সঙ্গে যখন বারবার দেখা করেছেন, কথা বলেছেন, তখন আপনার নেত্রীকে নিয়ে কী কী বলে গেছেন, মনে আছে? সে সব আমি বলে দিলে আপনার চাকরি থাকবে তো?’
কয়েক সেকেন্ডের জন্য রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখ। ভাবতেই পারেননি বিধানসভার আলোচনায় প্রকাশ্যে এভাবে বিলো দ্য বেল্ট আক্রমণ হতে পারে। পাশা খেলার আসরে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় যেমন উল্লাসে ফেটে পড়েছিল দুর্যোধনের নেতৃত্ব কৌরব পক্ষ, সেভাবেই সেদিন বিধানসভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই মন্তব্যের পর খ্যাক খ্যাক করে কটাক্ষের হাসি শুনেছিলাম বামফ্রন্টের বহু বিধায়কের গলায়। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের নেতারা সরকার পক্ষের নেতা, মন্ত্রীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে কিছু কথা বলবেন, এটাই স্বাভাবিক রীতি। কিন্ত তা হাটে, বাজারে, জনসভায় কিংবা বিধানসভার ভেতরে মাইক নিয়ে তা বলে বেড়াতে হবে, এটা সিপিআইএমের অনেক নেতাই সেই সময় ভালোভাবে নেননি। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মুখের ওপরে স্পষ্ট করে কিছু বলার ক্ষমতা তখন পার্টিতে বেশি লোকের ছিল না।
এর কয়েকদিন বাদেই মুজফফর আহমেদ ভবনে সিপিআইএমের রাজ্য কমিটির বৈঠক। যথারীতি হীরক রাজার দরবার বসেছে। হঠাৎই স্বভাব বেয়াড়া এক রাজ্য কমিটির সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এটা আপনি বলে দিলেন? পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বিধানসভায় যেভাবে আপনি অপমান করেছেন, তা একেবারেই ঠিক হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রে এসব করা ঠিক নয়। বিরোধী দলনেতা ব্যক্তিগত আলোচনায় কিছু কথা আপনাকে বলতেই পারেন, কিন্ত তা প্রকাশ্যে ফাঁস করে দেওয়া গণতন্ত্রের রীতি বিরোধী।’ রাজ্য কমিটির ওই সদস্যদের নাম অমল হালদার, তখন তিনি সিপিআইএমের সাংগঠনিক নিরিখে শক্তিশালী বর্ধমান জেলার সম্পাদক। রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে অমল হালদারের এই মন্তব্যের পর একজনও কোনও কথা বলেননি। সবাই চুপ। মিটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, দলের আর এক বিদ্রোহী নেতা সুভাষ চক্রবর্তী এগিয়ে গিয়ে অমল হালদারকে বলেছিলেন, ‘তুমি একদম ঠিক বলেছ। গত মিটিংয়ে আমার বিরুদ্ধে বলেছিলে, আমার রাগ হয়েছিল তোমার ওপর। আজ দেখলাম, তুমি যা ভুল মনে কর সামনাসামনিই বল।’
বিষয়টা কিছুই নয়, তার আগের মাসে বীরভূমের তারাপীঠ মন্দির গিয়েছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী। সেখানে গিয়ে ‘জয় মা’ বলে কালী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মন্দিরের ঘন্টাও বাজিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে তা প্রচারিত হওয়ার পর পার্টির মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আগের রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে সুভাষ চক্রবর্তীর এই তারাপীঠ যাওয়া নিয়ে তীব্র সমালচনা করেছিলেন অমল হালদার। সেদিন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে বর্ধমান জেলা সম্পাদকের সরব হওয়া প্রসঙ্গে, আগের দিন নিজেকে সমালোচনার উদাহরণই টেনে এনেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার প্রয়াত নেতা। সমালোচককে ডেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলার উদারতা সবার থাকে না। সুভাষ চক্রবর্তী ছিল। কিন্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেদিনের পর বহু দিন অমল হালদারের সঙ্গে কথা বলেননি।
এমনই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়ি করে যাচ্ছি। রাতে খেতে হবে। থামলাম কোলাঘাটে। কোলাঘাটের ধাবায় খাওয়া সেরে রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ রওনা দিলাম নন্দীগ্রামের দিকে। কোলাঘাটের ধাবায় দেখা টাইমস নাউ’য়ের সাংবাদিক সম্বিত পাল, ক্যামেরাম্যান সুরজ পান্ডে এবং ইন্ডিয়া টিভি’র সাংবাদিক প্রসেনজিৎ বক্সি, ক্যামেরাম্যান সুজিত দাসের সঙ্গে। ওরাও নন্দীগ্রাম যাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে সবাই একসঙ্গে রওনা দিলাম। কেউই কিছু চিনি না, একসঙ্গে থাকলে সুবিধা। প্রায় দেড়-পৌনে দু’ঘণ্টা পর পৌঁছলাম চন্ডিপুর মোড়ে। মাঝরাতেও দু-চারটে দোকান খোলা। দিঘা যাওয়ার বাস থামে বলে রাতে দোকানপাট খোলা থাকে চন্ডিপুরে। শুভেন্দু বলেছিল চন্ডিপুর মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে গেলেই সোজা নন্দীগ্রামের রাস্তা। একটা দোকানে জিজ্ঞেস করে, বাঁদিকে ঘুরলাম। প্রথম একশ-দু’শো মিটার রাস্তায় আলো জ্বলছে, তারপর ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। কোথায় যাব এই রাতে? মনে হচ্ছে পাহাড়ি নদীতে নৌকা চেপে যাচ্ছি, এমন খারাপ রাস্তা। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ঘণ্টাখানেক বাদে গিয়ে পৌঁছলাম নন্দীগ্রাম থানায়। রাত প্রায় দেড়টা। থানার সামনে গাড়িতে বসে আছি আমি আর উজ্জ্বল। বাইরে কনকনে ঠান্ডা, অপেক্ষা করছি আলো ফোটার। এরই মধ্যে সম্বিত পাল আর প্রসেনজিৎ বক্সি ওই অন্ধকারে খুঁজে পেয়েছে থানার উল্টোদিকে একটা পুকুরের ধারে বিডিও অফিস। বিডিও অফিসের মূল দরজা খোলা। ওরা ওখানেই থেকে গেল। আমি বসে থাকলাম গাড়িতে। আমাকে ফোন করে ডাকল। বলল, বিডিও অফিসে বড় বেঞ্চ আছে, একটু শুয়ে নেওয়া যাবে। না করে দিলাম। আমার ভয় ছিল একবার চোখ লেগে গেলে যদি ভোরে তাড়াতাড়ি ঘুম না ভাঙে। যদি উঠতে না পারি। কারণ, আমি তখন ঠিক করে ফেলেছি, সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়ব। আকাশ একটু পরিষ্কার হতেই বেরিয়ে পড়লাম থানা থেকে। যাব গড়চক্রবেড়িয়া, সোনাচুড়া এলাকায়। নির্দিষ্ট ভাবে বললে, কালীচরণপুরের ভূতার মোড়। যেখানে আগের দিন, ৩ তারিখ হামলা হয়েছে পুলিশের গাড়িতে, পাল্টা গুলি চালিয়েছে পুলিশ।
থানা থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে দু’শ-তিনশো মিটার এগোলে জায়গাটার নাম চৌরঙ্গি। একটা ছোট্ট মোড়। যেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরলে হাজরাকাটা যাওয়ার রাস্তা। আর সোজা রাস্তাটা মহেশপুর হয়ে তেখালি ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। তেখালি ব্রিজ পেরিয়ে খেজুরি। তখন এসব কিছুই জানতাম না। ভোর পাঁচটাও বাজেনি। ভেবেছিলাম, লোকজনের ঘুম ভাঙার আগে, আন্দোলনকারীরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই কালীচরণপুর পৌঁছে যাব। কিন্ত ভুল ভেবেছিলাম। তখনই রাস্তায় শ’য়ে শ’য়ে লোক। চৌরঙ্গি মোড়ে গাড়ি থামিয়ে ভিড়টাকেই জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে যাব গড়চক্রবেড়িয়া?
‘এদিক দিয়ে যান, কিন্তু যাবেন কীভাবে? রাস্তা তো কাটা।’ উত্তর, প্রশ্ন সব একসঙ্গে দিলেন চার-পাঁচজন। চৌরঙ্গি মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে পূর্বদিকে খানিকটা এগোতেই রাস্তা কাটা। ১২-১৪ ফুট পিচের রাস্তা দু’দিক থেকে এমনভাবে কাটা হয়েছে কোনও মতেই গাড়ি যাবে না। রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে নামলাম। সেখানেও ৪০-৫০ জনের জমায়েত। রাস্তা কাটার ধরনটা চমৎকার। দু’দিকে কাটা, মাঝখানে একটু অংশ কাটা হয়নি। মাঝখান দিয়ে শুধুমাত্র সাইকেল, মোটরসাইকেল যেতে পারবে। কাটা রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এখন উপায়? লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বুঝলাম, গড়চক্রবেড়িয়ার কালীচরণপুর ভূতার মোড় অন্তত ১৫-২০ কিলোমিটার। বেশিও হতে পারে।
এক একজন এক এক রকম বলছেন। সময় চলে যাচ্ছে, বুঝতেও পারছি না কী করব। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে এক যুবক এগিয়ে এলেন, ‘দাদা সাইকেলে যাবেন? আমার কাছে সাইকেল আছে, আপনাকে দিতে পারি।’ ছেলেটির নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাঁর এই এগিয়ে এসে সাহায্যের জন্য সাইকেল ফেরত দেওয়ার সময় একটা শুকনো ধন্যবাদ ছাড়া তাঁকে কিছু বলাও হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘দুটো সাইকেল জোগাড় করতে পারেন?’ কয়েক মিনিটের মধ্যে ওই ছেলেটা দুটো সাইকেল নিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। কয়েক মিনিট আগেই দিশাহীন লাগছিল কীভাবে গড়চক্রবেড়িয়ার যাব ভেবে।

 

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১ কীভাবে থানার ওসিকে খুনের ছক কষেছিল মাওবাদীরা

 

নন্দীগ্রামের কোনও সাধারণ মানুষের আমাকে প্রথম সাহায্য, ৪ জানুয়ারি সাতসকালে দুটো সাইকেল। একটা সাইকেলের সিটে বসলাম আমি। অন্য সাইকেলটা চালাল আমার গাড়ির ড্রাইভার সুরেশ। হাতে ক্যামেরা এবং মাইক নিয়ে সুরেশের পিছনের কেরিয়ারে বসল ক্যামেরাম্যান উজ্জ্বল। দুটো সাইকেলে তিনজন রওনা দিলাম গড়চক্রবেড়িয়া কালীচরণপুরের দিকে। সাইকেলে খবর করতে যাওয়া জীবনে ওই প্রথম। মিনিট ১৫-২০ সাইকেল চালিয়ে পৌঁছলাম হাজরাকাটা মোড়ে। হাজরাকাটা মোড় পর্যন্ত কোথাও কোনও সমস্যা নেই। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। কিন্ত মোড়ে কয়েকশো লোকের জটলা। সবাই প্রচণ্ড উত্তেজিত। সেখান থেকে ডান দিকে ঘুরে দক্ষিণদিক বরাবর সোজা গেলে গড়চক্রবেড়িয়া।
হাজরাকাটা মোড়ে রাস্তার অনেকটা কাটা। সাইকেল থেকে নামলাম। দু’হাতে সাইকেল তুলে কাটা রাস্তা পেরোচ্ছি, লোকজন ঘিরে ধরল। রীতিমত মারমুখী। ‘কোন মিডিয়া, কী করতে এসেছেন এখানে? ফিরে যা এখান থেকে, সব সালিমদের দালাল’, এমন নানান মন্তব্য চারিদিক থেকে উড়ে আসছে। খবর করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা আমার সাংবাদিক জীবনে কয়েকবার হয়েছে। কিন্ত এমন মারমুখী এত মানুষ এবং এত সকালে, কোথাযও দেখিনি। ওঁদের মধ্যেই দু-চারজন আবার বললেন, ‘ঠিক আছে যান। উল্টোপাল্টা কিছু করবেন না।’ নন্দীগ্রাম থানা থেকে হাজরাকাটা পর্যন্ত রাস্তায় বুঝতে পারিনি। এখানে এসে বুঝলাম, এবার আন্দোলন এলাকায় প্রবেশ করছি। হাজরাকাটা মোড়ে মানুষের চোখ, মুখ, শরীরী ভাষা বলে দিচ্ছে, আন্দোলনের আঁতুরঘর আর বেশি দূরে নয়।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে এক যুবক এগিয়ে এল। ‘বিতনুদা কেমন আছেন, কখন এলেন?’ উত্তেজিত ভিড়ের মধ্যে চেনা লোক দেখে আশ্বস্ত হলাম। ওকে রোজ মহাকরণে দেখি। ভিআইপি গেটে ডিউটি করে। কলকাতা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সের কনস্টেবল। ‘তুমি এখানে?’ ‘আমার তো এখানেই বাড়ি। কাল এসেছি সারাদিন এমন গণ্ডগোল হল। আজ ফেরার কথা ছিল। ভাবছি থেকে যাব, কাল ফিরব।’
‘ঠিক আছে, পরে কথা হবে,’ আবার সাইকেলে উঠে রওনা দিলাম। হাজরাকাটা মোড়ের পরিস্থিতিটা ভালো লাগলো না, উজ্জ্বলকে বললাম মাইক জামার ভিতরে ঢুকিয়ে নিতে। কেউ যেন দেখতে না পায়। কিছুটা এগোতেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। গড়চক্রবেড়িয়ার দিকে থেকে ছুটে আসছে বিরাট সশস্ত্র মিছিল।

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.