নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৪: সংঘর্ষ শুরুর ঠিক আগে নন্দীগ্রামে সিটু অফিস কেন ভাঙচুর করেছিলেন সিপিআইএম কর্মীরা?

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ৬ জানুয়ারি, ২০০৭, মাঝরাতে গুলি, বোমার লড়াই শুরু হল নন্দীগ্রামে। ৭ তারিখ সকালে গিয়ে পৌঁছলাম, পরদিন পুলিশে গাড়িতে চেপে থানা থেকে লুকিয়ে রওনা দিলাম তেখালির দিকে…..

পুলিশের গাড়িতে থানা থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই পড়লাম চৌরঙ্গি মোড়ে। তিন দিন আগেই ঘুরে গিয়েছি। কিন্তু আজ চৌরঙ্গি থেকে পূর্বদিকে ঘুরে হাজরাকাটার দিকে যাওয়া যাবে না। জায়গায় জায়গায় রাস্তা কাটা। পুলিশের গাড়িও যাচ্ছে না সেই ৩ তারিখ বিকেল থেকেই। তাই এগোলাম দক্ষিণদিক বরাবর। এই রাস্তাটাই আমগেছিয়া, মহেশপুর হয়ে যাচ্ছে তেখালি ব্রিজের দিকে। রাস্তার মাঝখানে জায়গায় জায়গায় থিক থিক করছে লোক। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। পুলিশের গাড়ি দেখে লোকজন রাস্তায় একটু সরে দাঁড়াচ্ছেন। বেশি নয়, যতটুকু সরলে একটা গাড়ি যেতে পারে ঠিক ততটাই। খানিকটা এগোতেই রাস্তার মাঝখানে খেঁজুর গাছ পড়ে। সামনের সিটে বসা কনস্টেবল গাড়ি থেকে নেমে গাছটা সরিয়ে দিলেন। খানিকটা এগোতেই আবার গাছের ডাল রাস্তায়। বুঝলাম ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি এদিকে রাস্তা কাটেনি ঠিকই, কিন্ত গাড়ির গতি কমাতে জায়গায় জায়গায় গাছ ফেলে রেখেছে। গোটা রাস্তাতেই ভিড়। গাড়ি গাছ সরিয়ে এগোলেই আবার তা রাস্তার মাঝখানে দিয়ে দিচ্ছেন লোকজন। এই ব্যবস্থার কারণ, কোনও গাড়ি চাইলেই যেন জোরে চালিয়ে পালাতে না পারে। গাছ সরাতে গাড়ি থামালেই ওঁরা দেখে নিচ্ছেন কে রয়েছে গাড়িতে। এভাবে থামতে থামতে এগোলাম তেখালির দিকে। তেখালি ব্রিজের ওপারেই খেজুরি।
তেখালি ব্রিজে ওঠার ঠিক আগে বাঁদিকে মাঠের মধ্যে বসে কয়েক’শো মানুষ। নীল, হলুদ পলিথিন দিয়ে ২-৩ টে তাবু তৈরি হয়েছে। তাতেই ঠাসাঠাসি করে মহিলা আর বাচ্চা। পাশে বড়ো উনুনে ভাত হচ্ছে। জানুয়ারির শুরুর ওই কনকনে ঠান্ডায় বেশিরভাগেরই গায়ে শীতের পোশাক নেই। পুরুষরা অধিকাংশই তাবুর বাইরে মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে। সরকারের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূল্য চোকাতে রাজ্যের একটি ব্লকে রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে গেলেন কয়েক’শো মানুষ। এই মানুষগুলোর তখন সম্বল বলতে পাকা বাড়ি ছেড়ে পার্টির দেওয়া তাবুর আশ্রয়। অশোক গুড়িয়া, অশোক বেরা, বিজন রায়েদের মতো নন্দীগ্রাম-খেজুরির স্থানীয় কয়েকজন সিপিআইএম নেতার ঘরে ফেরানোর আশ্বাস এবং মাত্র ১০ মাস আগে হওয়া বিধানসভা ভোটে ২৩৫ আসনের ভরসা। এই অসহায় ঘরছাড়া সাধারণ মানুষগুলোকে স্থানীয় সিপিআইএম নেতারা বোঝালেন, তাঁদের জীবন-জীবিকা, সন্তানের ভবিষ্যৎ, মহিলাদের সম্মান রক্ষা করবে রাজ্য সরকার। নন্দীগ্রামের এই আন্দোলন বেশি দিন চলবে না, কারণ তাঁদের সঙ্গে পুলিশ আছে, প্রশাসন আছে। আর আছে প্রবল শক্তিমান পার্টি!
অন্যদিকে, সিপিআইএমের বেশ কয়েকজন ছোট থেকে মাঝারি নেতা এবং বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক ঘর ছাড়লেন না। সরাসরি যোগ দিলেন জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে সরকার বিরোধী আন্দোলনে। ৩ জানুয়ারি কালীচরণপুর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে যে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়েছিল, তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের একের পর এক পঞ্চায়েত এলাকায়। সিপিআইএমের রাজ্য দফতর মুজফফর আহমেদ ভবন এবং মহাকরণ বুঝতেই পারল না, কী ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে এক সময় তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম আঁতুড়ঘর নন্দীগ্রামে। দিন দিন ব্যাপক আকার নিতে শুরু করল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্বে জমি বাঁচানোর আন্দোলন। দিকে দিকে শুরু হল রাস্তা কাটা। পুলিশের গতিবিধি ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো এমনভাবে কাটা হল, যাতে চার চাকার গাড়ি যেতে না পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিচের রাস্তা কাটা হোত দু’দিক থেকে। মাঝখানে একটু অংশ কাটা হোত না সাইকেল, মোটরসাইকেল চলাচলের জন্য। খেজুরির দিক থেকে সিপিআইএমের আক্রমণ ঠেকাতে শুরু হল রাত জাগা। নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকের ১০ টি অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশই খুব দ্রত হয়ে উঠল স্বাধীন এলাকা। কোথাও কোনও প্রশাসন নেই। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা অধিকাংশ সময়েই নিজেদের আটকে রাখলেন নন্দীগ্রাম থানায়। মহাকরণ এবং মুজফফর আহমেদ ভবনে নন্দীগ্রাম নিয়ে লাগাতার ভুল এবং মনগড়া রিপোর্ট পাঠাতে শুরু করলেন পুলিশ অফিসাররা এবং তমলুকের সাংসদ লক্ষণ শেঠ। কেউ নন্দীগ্রামের মানুষের আবেগটা বোঝার চেষ্টাই করলেন না। নিজেদের মতকেই তাঁরা নন্দীগ্রামের মানুষের ভাবনা এবং চাহিদা বলে কলকাতায় রিপোর্ট পাঠিয়েছেন দিনের পর দিন। কিন্তু ৩ জানুয়ারি এমন হঠাৎ গণ্ডগোল, সংঘর্ষ এবং ৬ তারিখ থেকে এই খুনের রাজনীতি কেন শুরু হয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের এই একটি ব্লকে তার সঠিক মূল্যায়ন করতে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েকটা মাস।

 

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট 

২০০৫, ৩১ জুলাই। রাজ্যে তখন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রকৃত পক্ষেই লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ। বামফ্রন্ট সরকারের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে শিল্পায়নের পতাকা পতপত করে উড়ছে রাজ্যজুড়ে। সেদিন কলকাতার ইস্টার্ণ মেট্রোপলিটন বাইপাসের ধারে এক পাঁচতারা হোটলে পৌঁছেছি সকাল-সকাল। ওই হোটেলে ইন্দোনেশিয়ার সালিম গোষ্ঠীর সঙ্গে মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (মউ) স্বাক্ষর করবে রাজ্য সরকার। তাতে অনেক কিছুর মধ্যে ছিল, নন্দীগ্রামে ১২ হাজার ৫০০ একর জমিতে পেট্রোরসায়ন শিল্প তালুক গড়বে সালিম গোষ্ঠী। সেই দিন যত প্রকল্পের জন্য মউ সই হয়েছিল, তার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সব মিলিয়ে প্রায় ৪১ হাজার একর জমির প্রয়োজন ছিল। মউ চুক্তির পর এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এত জমি অধিগ্রহণের জন্য বাংলার মানুষের সম্মতি আছে?’ দৃশ্যতই বিরক্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জবাব দিয়েছিলেন, ‘একমাত্র আপনার কাগজ ছাড়া রাজ্যে সবাই শিল্প চায়। সবার সম্মতি আছে। শুধুমাত্র আপনার কাগজ শিল্প চায় না। রাজ্যে শিল্পের জন্য জমির অভাব হবে না।’ সেই সাংবাদিকের নাম অমল সরকার এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চিহ্নিত সেই কাগজের নাম বর্তমান পত্রিকা।
২০০৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে নজিরবিহীন জয়ের পর দ্রুত শিল্পায়নের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এতটাই দ্রুত যে, ১৮ মে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পর আর এক মূহুর্ত সময়ও নষ্ট করতে চাননি তিনি। সেদিনই বিকেলে টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটার সঙ্গে মহাকরণে বৈঠকের পর ঘোষিত হয়েছিল সিঙ্গুরে টাটা মোটরসের ছোট গাড়ির প্রকল্প। কয়েক দিনের মধ্যেই সিঙ্গুরে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর নন্দীগ্রামের মানুষও বুঝতে পারছিলেন, যে কোনও দিন তাঁদের জমি, বাড়িতে হাত পড়বে। ২০০৬ সালের জুলাই-অগাষ্ট মাস থেকেই নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের মোড়ে মোড়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল জমি অধিগ্রহণের আশঙ্কায়। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামে প্রথম রাজনৈতিক প্রচার শুরু করেছিল কংগ্রেস এবং এসইউসিআই। তবে তা খুবই ছোট আকারে। সেটা ২০০৬ সালের অগাস্ট মাস। কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে যোগ দেয় তৃণমূল কংগ্রেস এবং জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ। গড়চক্রবেড়িয়া, সোনাচূড়া, কেন্দেমারিসহ নানা জায়গায় ছোটখাট মিটিং, বক্তৃতা শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। এই মিটিংগুলিতে দিন দিন সাধারণ মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। এই সময় হঠাৎই একদিন সালিম গোষ্ঠীর অফিসারদের নন্দীগ্রামের জমি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজ্যের শিল্প এবং বাণিজ্য দফতরের অফিসাররা। তাঁরা গিয়েছিলেন হলদিয়া থেকে লঞ্চে করে। নন্দীগ্রামের গা ঘেঁষে হলদি নদী দিয়ে যখন সেই লঞ্চ যাচ্ছিল তখন সেখানকার কিছু মানুষ তা দেখেনও। মূহুর্তের মধ্যে সেই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়, সরকার যে কোনও সময় জমি নিতে আসবে। এরপর থেকেই ‘কোনও মূল্যেই জমি দেব না’ এই দাবি তুলে মিটিং, মিছিলের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক এলাকার মানুষ। কোনও নেতা নেই। কিন্ত মানুষ আন্দোলন করতে চাইছেন, জোট বাঁধতে চাইছেন, এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয় ১ নম্বর ব্লকের বিভিন্ন এলাকায়। আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততায় বিভিন্ন এলাকায় সমাজ বিজ্ঞানের স্বাভাবিক নিয়মে নিজে থেকেই তৈরি হতে শুরু করল নেতৃত্ব। এক একটি এলাকায় এক একজন নেতা। রাজনৈতিক কোনও অভিজ্ঞতা নেই। হঠাৎ দায়িত্ব এসে পড়েছে কাঁধে। সরকারের জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতায় এই হঠাৎ করে গড়ে ওঠা এলাকা ভিত্তিক নেতৃত্ব এবং সংগঠনের জন্য রীতিমতো বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন নন্দীগ্রামের স্থানীয় সিপিআইএমের নেতারা। সেই সময় সিপিআইএমের নন্দীগ্রাম জোনাল কমিটির সম্পাদক সুনির্মল গিরি। জেনাল কমিটির প্রভাবশালী সদস্য বাদল মন্ডল, তাঁর বাড়ি সোনাচূড়ায়। দিন দিন জমি ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে দেখে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর থেকেই সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়া এলাকায় সুনির্মল গিরি, বাদল মন্ডল, জয়দেব পাইকসহ স্থানীয় সিপিআইএম নেতারা পালটা প্রচার শুরু করে দিয়েছিলেন, নন্দীগ্রামে কোনও জমি অধিগ্রহণ হবে না। বিরোধীরা মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন, এই পালটা প্রচার না করলে সেখানে রাজনীতি করা মুশকিল হয়ে যাবে। এর পর রীতিমত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে তখন ৭ টাই বামেদের দখলে। ফলে সিপিআইএমের একটা প্রভাব সেখানে ছিল।
একদিকে, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, এসইউসিআই, জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ প্রচার করছে, সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে। এবং তা সর্বশক্তি দিয়ে রুখতে হবে। অন্যদিকে, সিপিআইএম বলছে, তা হবে না। এই প্রচার-পালটা প্রচারের মধ্যে কিন্তু পুরো ব্লকের বেশিরভাগ মানুষই ঠিক করে নিয়েছিলেন, যাই হোক না কেন, তাঁরা জমি দেবেন না। সেই সময় সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের সব খবরই পাচ্ছিলেন তাঁরা। সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের গতিপ্রকৃতি দেখে নন্দীগ্রামের মানুষের ধারণা হচ্ছিল, পুলিশকে সামনে রেখে সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে, তাই কোনও মূল্যেই পুলিশকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। সমস্ত গণ্ডগোল মিটে যাওয়ার অনেক পরে আমি নন্দীগ্রামের বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে পুলিশের অতি সক্রিয়তা তাঁরা ভালো চোখে দেখেননি। বিশেষ করে, ২০০৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুর ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস থেকে গভীর রাতে পুলিশ পাঠিয়ে জোর করে অবস্থানরত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে দেওয়া, পুলিশ পাহারায় সিঙ্গুরে পাঁচিল তোলা কিংবা ১৪৪ ধারা জারি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হুগলি জেলায় ঢুকতে না দেওয়া, সব কিছু টেলিভিশনে দেখে এবং সংবাদপত্রে পড়ে নন্দীগ্রামের মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, জমি অধিগ্রহণে সিপিআইএম সরকারের প্রধান অস্ত্র পুলিশ। আমার বিশ্বাস, নন্দীগ্রামে সম্মিলিত ভাবে পুরুষ এবং মহিলারা ৩ জানুয়ারি প্রথমে গড়চক্রবেড়িয়াতে এবং পরে সোনাচূড়ায় যেভাবে পুলিশকে আক্রমণ করেছিলেন তা ছিল সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে দু’তিন মাস ধরে পুলিশের ভূমিকার জেরে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। তাঁদের একটাই টার্গেট ছিল, আর যাই হোক, এলাকায় পুলিশ ঢুকতে দেওয়া যাবে না, পুলিশ ঢুকলেই জমি বেদখল হয়ে যাবে। পুলিশেকে ঠেকানো মানেই জমি অধিগ্রহণ আটকে দেওয়া। পুলিশেকে নন্দীগ্রামে ঢুকতে বাধা দেওয়া বা আক্রমণ করার পিছনে অন্য কোনও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র অন্তত প্রথমদিকে ছিল না। যদিও সিপিআইএম নেতারা প্রথম দিন থেকেই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন, জমি অধিগ্রহণ বা শিল্পটা কোনও ইস্যু নয়, এলাকা দখল করতে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে সেখানকার মানুষ পুলিশকে বাধা দিয়েছিলেন। সিপিআইএমের এই প্রচার ছিল সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার ওর দাঁড়িয়ে। কারণ, জমি অধিগ্রহণ যদি ইস্যু নাই হবে, তবে নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের ১০ টি অঞ্চলের মধ্যে ৭ টি বামেদের হাতে থাকা সত্ত্বেও, বিরোধীরা কীভাবে সাধারণ মানুষকে জোটবদ্ধ করলেন? আর এখানে ফের ওঠে জ্যোতি বসুর তোলা সেই মৌলিক প্রশ্ন, কৃষকসভার ভূমিকা।
আসলে তমলুকে জেলা পার্টি অফিস থেকে শুরু করে কলকাতায় রাজ্য দফতর পর্যন্ত সিপিআইএমের তাবড় নেতারা সেই সময় বুঝতেই পারেননি, গরিব, সম্বলহীন মানুষের কাছে জমি কতটা সংবেদনশীল বিষয়। জমি মানে তাঁর কাছে একটা মর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান। যার প্রতি মমত্ব, ভালোবাসা অপরিসীম। এর কোনও দাম হয় না। জমি ছাড়া হারানোর কিছু ছিলও না এই মানুষগুলোর। তাই তা রক্ষা করতে ছিল এমন জান কবুল লড়াই। তাছাড়া সিপিআইএম কোনও দিনই নন্দীগ্রামের মানুষের মনের কথা পড়তে পারেনি, যথার্থভাবে বললে চায়নি, যার মাশুল তাদের দিতে হয়েছে মারাত্মক ভাবে।
২০০৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকে মোড়ে মোড়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল জমি নিয়ে আলোচনা। সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়ার নানা জায়গায় গাছে চোঙা বেঁধে মাঝে মাঝে মাইক বাজিয়ে মিটিংও হোত জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। ক্রমে জনমত গড়ে উঠছিল জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে, যার বিরোধিতা করার কোনও শব্দ ছিল না নন্দীগ্রামের ওই সমস্ত এলাকার সিপিআইএম নেতাদের কাছে। এভাবে চলতে চলতেই ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর নন্দীগ্রামে বাস স্ট্যান্ডের কাছে বড় সমাবেশের ডাক দেয় সিপিআইএম। বক্তা তমলুকের সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ। তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে নন্দীগ্রাম বিধানসভা। নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়া এলাকার বেশ কিছু সক্রিয় সিপিআইএম কর্মী এবং সদস্য সেই মিটিংয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সিপিআইএমের জেনাল কমিটির সম্পাদক সুনির্মল গিরি বা বাদল মন্ডলরা ওই সব এলাকা থেকে কোনও সাধারণ মানুষেকে মিটিংয়ে নিয়ে যাননি। কারণ, তাঁরা ভালো করে জানতেন, ১ নম্বর ব্লকের মানুষ জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করছেন। তাঁদের মিটিংয়ে নিয়ে গেলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সেই দিন লক্ষ্মণ শেঠের মিটিংয়ে বেশিরভাগ লোক জমায়েত হয়েছিলেন নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকের রেয়াপাড়া, হাঁসচড়া এলাকা থেকে, যেখানে জমি অধিগ্রহণের কোনও ব্যাপার ছিল না। তাছাড়া বাজকুল, চণ্ডিপুর, নন্দকুমার, এমনকী হলদিয়া, তমলুক থেকেও প্রচুর সিপিআইএম কর্মী, সর্মথক গিয়েছিলেন সেই মিটিংয়ে। এতদিন যে কথাটা গোপনে ছিল, তা সেই দিন প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন তমলুকের সাংসদ। নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডের জনসভায় লক্ষণ শেঠ বলেছিলেন, পেট্রোরসায়ন শিল্পতালুক হবে নন্দীগ্রামে। শিল্পায়নে নন্দীগ্রাম হলদি নদীর অন্য পারের হলদিয়াকেও ছাপিয়ে যাবে। যার ফলে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে… ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর জমায়েতের উদ্দেশে লক্ষণ শেঠ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘আপনারা কি শিল্প চান? কে কে শিল্প চান?’ যাঁদের এক ছটাক জমিও অধিগ্রহণের কোনও প্রশ্নই ছিল না এমন কয়েক হাজার মানুষ দু’হাত তুলে স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘শিল্প চাই, শিল্প চাই।’ নন্দীগ্রামের সমস্ত মানুষ শিল্প চাইছেন বলে রিপোর্ট পৌঁছেছিল মুজফফর আহমেদ ভবনে।
সেই দিনই তার ঘণ্টাখানেক বাদে আরও একটা ঘটনা ঘটে নন্দীগ্রামে, যা থেকে সিপিআইএম শিক্ষা নিলে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর বহু নেতাকে বলতে হোত না, তাঁদের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ নন্দীগ্রাম। ২৯ ডিসেম্বর সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়া এলাকা থেকে যে সমস্ত সক্রিয় সিপিআইএম কর্মী, সমর্থক লক্ষ্মণ শেঠের মিটিংয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা ট্রেকারে, ভ্যানে চেপে এলাকায় ফিরেছিলেন সন্ধে সাড়ে ছটা-সাতটা নাগাদ। তারপর সেই ২৫-৩০ জন সক্রিয় সিপিআইএম কর্মী চড়াও হন সোনাচূড়া বাজারের ঠিক মোড়ে দলের শ্রমিক সংগঠন সিটুর অফিসে। সিটু অফিসে তখন বসেছিলেন সিপিআইএমের জেনাল কমিটির সদস্য বাদল মন্ডল এবং আরও কয়েকজন নেতা। সিটু অফিসে ঢুকে প্রথমেই তাঁরা চেয়ার, টেবিল উল্টে ফেলে দেন। তারপর তাঁরা চিৎকার করতে থাকেন, কেন এতদিন তাঁদের ভুল বোঝানো হচ্ছিল, কেন বলা হচ্ছিল জমি অধিগ্রহণ হবে না। এই বলে মারমুখী সিপিআইএম কর্মীরা স্থানীয় নেতাদের সামনেই সিটু অফিসের চেয়ার-টেবিল ভাঙতে শুরু করেন। নিমেষের মধ্যে আশপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। নন্দীগ্রামের যে এলাকায় জমি অধিগ্রহণ হওয়ার কথা ছিল, লক্ষ্মণ শেঠর ঘোষণার এক ঘণ্টা পরেই সেখানে দলীয় কর্মীদের কী মনোভাব ছিল, সিপিআইএম শীর্ষ নেতৃত্ব যদি তার খোঁজ নিতেন এবং তা থেকে কিছু শিক্ষা নিতেন, তবে ভবিষ্যতে অনেক বড়ো সমস্যা তাঁরা এড়াতে পারতেন। সেই দিন নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকে সিপিআইএমের সাংগঠনিক শক্তি পুরোপুরি ধসে পড়ে, যা কলকাতায় বসে জানতেই পারেননি রাজ্য স্তরের নেতারা। আর খানিকটা বুঝেও চুপচাপ বসেছিল তমলুকের সিপিআইএম জেলা অফিস এবং হলদিয়ায় সিপিআইএম জেনাল অফিস শ্রমিক ভবন। এই শ্রমিক ভবন থেকেই তখন কার্যত চলত পূর্ব মেদিনীপুর জেলা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএম নেতারা ভেবেছিলেন, এই সব সামান্য কয়েকটা লোকের মুহূর্তের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
২৯ ডিসেম্বর নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডে লক্ষ্মণ শেঠের মিটিং, সেখানে হাত তুলে বহিরাগতদের শিল্পের দাবি এবং দু’ঘণ্টার মধ্যে তার বিরোধিতায় ভূমিপুত্রদের সিটু অফিসে ভাঙচুরের খবর কতটা কলকাতায় সিপিআইএম নেতাদের কাছে পৌঁছেছিল, তা এক বিরাট রহস্য। সিপিআইএমের রাজ্য স্তরের দু’একজন শীর্ষ নেতাকে অনেক পরে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ২০০৬ সালে ২৯ ডিসেম্বর নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডে মিটিংয়ের পর সোনাচূড়ার ঘটনা তাঁরা জানতেন কিনা। কোনও নেতাই সেই ঘটনা মনে করতে পারেননি।
পরদিন, ৩০ ডিসেম্বর সিপিআইএমের মুখপত্র গণশক্তি পত্রিকায় পাঁচের পাতায় একটা খবর প্রকাশিত হয়। তার শিরোনাম ছিল, ‘নন্দীগ্রামে শিল্প উন্নয়নের দাবিতে বিশাল সমাবেশ’। সেই খবরের প্রথম দুটো লাইন ছিল, ‘নন্দীগ্রামের মানুষ শিল্প চান। শুক্রবার নন্দীগ্রাম সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ডে প্রায় দশ হাজার মানুষের বিশাল সমাবেশ স্পষ্ট করে একথাই জানিয়ে দিল।’ আর সেই খবরের শেষ দুটো লাইন ছিল, ‘জনসভায় কৃষকসভার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সম্পাদক অশোক গুড়িয়া জানান, নন্দীগ্রামজুড়ে কৃষকসভার গ্রাম কমিটি ও অঞ্চল কমিটির সভায় তাঁরা মানুষের কাছে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি জানান, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই হলদিয়া উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মেগা কেমিক্যাল হাবের জন্য চিহ্নিত মৌজাগুলির নাম প্রকাশ করবে সরকারিভাবে।’
২৯ তারিখের মিটিং এবং পরদিন গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর দেখে নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের মানুষের আর কোনও সংশয় ছিল না যে, জমি অধিগ্রহণের পক্রিয়া শুরু হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বলা যেতে পারে, ৩০ ডিসেম্বর থেকেই জীবন বাজি রেখে জমি রক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছিলেন নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের মানুষ। এই প্রস্তুতিতে মানুষের জোটবদ্ধ হওয়ার ডাক ছিল, কোনও সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু ৩ জানুয়ারি জমি রক্ষার জন্য এখানকার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পঞ্চায়েত অফিস এবং পুলিশেকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখালে সিপিআইএম এক নিমেষে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করে ফেলে। তারপর থেকে সিপিআইএমের মূল অভিযোগ ছিল, নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের কোনও ব্যাপারই নেই। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস এবং মাওবাদীরা পুরো রাজনৈতিক কারণে গুজব ছড়িয়ে আন্দোলন সংঘটিত করছে এবং সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে এলাকা দখল করছে। কিন্তু সিপিআইএমের এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যে এবং নিজেদের সাংগঠনিক ত্রুটি ঢাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। কারণ, ৩০ ডিসেম্বর গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের শেষ লাইন। আর তা ছিল, ‘…হলদিয়া উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মেগা কেমিক্যাল হাবের জন্য চিহ্নিত মৌজাগুলির নাম প্রকাশ করবে সরকারিভাবে।’ খুব সহজ বাংলায় যার মানে, মৌজাগুলি চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। তা সরকারিভাবে প্রকাশ করাটাই শুধু বাকি। এবং এই ঘোষণা করেছিলেন জেলার কৃষকসভার নেতা অশোক গুড়িয়া, যিনি জেলা রাজনীতিতে লক্ষণ শেঠের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় সোনাচুড়ায় সিটু অফিস দলীয় কর্মীদের হাতে অফিস ভাঙচুরের কোনও উল্লেখ স্বাভাবিকভাবেই গণশক্তি পত্রিকায় জায়গা পায়নি। মুজফফর আহমেদ ভবনের নেতারা বিষয়টা জানতেন না, তা হতেও পারে। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নেতারা তা জানতেন না, এমন হওয়া অসম্ভব। শুধু তাই নয়, নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকে তিন-সাড়ে তিন মাস ধরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মিটিং-মিছিল হচ্ছে, অথচ, জেলার কৃষকসভার সম্পাদক প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিলেন, ‘গ্রাম কমিটি এবং অঞ্চল কমিটি মানুষের কাছে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেছে।’ ঘটনাচক্রে কৃষকসভার জেলা সম্পাদক অশোক গুড়িয়ার বাড়ি নন্দীগ্রামেই। ২ নম্বর ব্লকের রেয়াপাড়া এলাকায়। তাঁর বাড়ি থেকে ২০-৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে সোনাচুড়া, গড়চক্রবেড়িয়া, কেন্দেমারিতে কী ঘটছে তা তিনি কিছুই শোনেননি কিংবা জানতেন না, এমনটা হওয়া কি আদৌ সম্ভব? নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সেখানকার একটা ইট, কাঠ, পাথরও বিশ্বাস করবে একথা? গ্রামে কার বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে, সেই খবর রাখনেয়ালা পার্টি এত মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রস্তুতি দেখতে পায়নি তিন মাসের মধ্যে?
আমার মতে, তা একেবারেই নয়। সব জেনেও সেখানকার মানুষের ওপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সিপিআইএম নেতারা। তার কারণ মূলত দুটো।
প্রথমত, রাজা যা শুনতে চায়, পারিষদ বলে তার চেয়ে বেশি, এই মানসিকতা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চাইছিলেন পেট্রোরসায়ন শিল্প তালুক গড়তে। একথা নিশ্চিত, বহু মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে তা তিনি চাননি। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা শাসক এবং হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান লক্ষ্মণ শেঠ বুঝে নিলেন, যে কোনও মূল্যে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। একবারও নন্দীগ্রামে না গিয়ে ম্যাপ দেখে জমি চিহ্নিত করতে শুরু করে দিল জেলা প্রশাসন এবং হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি। কিন্ত ম্যাপে জায়গার ছবি থাকে, সেখানকার মানুষের মন তো আর ম্যাপ দেখে পড়া যায় না। মন পড়তে পারতেন যারা, সেই কৃষকসভার নেতা তো লক্ষ্মণ শেঠের বার্তা পেয়েছেন, সরকার পেট্রোরসায়ন শিল্প তালুক গড়তে চাইছে। জমি লাগবে। হীরকের রাজা যদি প্রশ্ন করতেন, সেনাপতি, শিল্প করতে হবে। জমি লাগবে, কোনও সমস্যা আছে? সেনাপতি যা উত্তর দিতেন, সেই উত্তরই দিয়েছিলেন অশোক গুড়িয়া। বাস্তব পরিস্থিতি এড়িয়ে বলেছিলেন, কোনও সমস্যা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। জানতেন, কিছু লোক তো ঝামেলা করছে। বুঝিয়ে টুঝিয়ে না মিটলে, গায়ের জোর তো আছেই। এত বছরের সরকার দিনে দিনে কম হৃষ্টপুষ্ট তো হয়নি। পার্টি আছে, পুলিশ আছে, সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। তাছাড়া নেতা যা শুনতে চান তাতে না বলার জন্য তো পার্টির এই সব পদ মেলেনি। নেতা যা বলেন, তাতে হ্যাঁ, হ্যাঁ বলার জন্যই তো এই সব নানা দলীয় কমিটিতে জায়গা মিলেছে। তাই চুলোয় যাক কৃষকের মনের কথা। কৃষক সভার নেতা ঘোষণা করে দিলেন, ‘নন্দীগ্রামজুড়ে কৃষক সভায় গ্রাম কমিটি এবং অঞ্চল কমিটির সভায় তাঁরা মানুষের কাছে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেছেন।’
দ্বিতীয় কারণ, বড়ো শিল্প এবং তার জন্য নির্মাণ কাজের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সুবিধা শাসক দলের নেতাদের কতটা পুষ্ট করে তুলতে পারে তার অভিজ্ঞতা ওই জেলার হলদিয়ার নেতাদের ছিল। তাঁরা জানতেন, বড়ো শিল্প গড়া মানেই কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ কাজ, ঠিকাদারি, ইট, বালি সাপ্লাই থেকে শুরু করে নানা কায়দায় নিজেদের লোককে আইনি-বেআইনি রাস্তায় অনেক কিছু পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ। তারপরে বিরাট সংখ্যায় একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করা, যারা দিনে দিনে হয়ে উঠবে পার্টির প্রাণভোমরা। যাদের হাতেই থাকবে একের পর এক নির্বাচনে জেতার অব্যর্থ চাবিকাঠি।
২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডে লক্ষ্মণ শেঠের মিটিংয়ের পর চৌরঙ্গি মোড় থেকে শুরু করে একদিকে আমগেছিয়া মহেশপুর, অন্যদিকে হাজরাকাটা কেন্দামারি, গড়চক্রবেড়িয়ার সোনাচূড়া পুরো এলাকার চেহারাই পালটে গেল। চারদিন বাদে ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি সকালে গড়চক্রবেড়িয়ার কালীচরণপুর ১০ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে একটা মিটিং হচ্ছিল। সকাল সাড়ে ১০টা-১১টা নাগাদ সেই মিটিংয়ে যোগ দিতে একটি গাড়িতে চেপে কয়েকজন অফিসার গিয়েছিলেন। অফিসাররা সেখানে পৌঁছানো মাত্র আশপাশে গুজব ছড়িয়ে পড়ে জমি অধিগ্রহণের নোটিস দিতে নন্দীগ্রামের ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস থেকে লোক এসেছেন। মুহূর্তের মধ্যে ৫০-৬০ জন লোক জড়ো হয়ে যান পঞ্চায়েত অফিসের সামনে। একটা ছোট্ট বাজারের মধ্যে কালীচরণপুর পঞ্চায়েত অফিস। এমনিতেই সব সময় ভিড় থাকে সেখানে। পঞ্চায়েত অফিসের লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে লোকজন চিৎকার করে জানতে চান, ভিতরে কী নিয়ে মিটিং হচ্ছে? পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন সিপিআইএমের সমেরণ বিবি। তিনি ভয় পেয়ে নন্দীগ্রাম থানায় ফোন করে দেন। একটি জিপে ৩-৪ জন পুলিশ অফিসার ও কর্মী নন্দীগ্রাম থানা থেকে রওনা দেন গড়ক্রবেড়িয়ার কালীচরণপুর পঞ্চায়েত অফিসের দিকে।

 

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৩: তোমরা কিছু জানতে না? কৃষকসভা কী করছিল? জ্যোতি বসু জানতে চাইলেন রূপচাঁদ পালের কাছে

 

পুলিশ সেখানে পৌঁছানো মাত্রই পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। আশপাশের এলাকায় মানুষের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুলিশ যাওয়ার খবর। নিমেষের মধ্যে কয়েক’শো পুরুষ-মহিলা জড়ো হয়ে যান কালীচরণপুরে। তাঁরা ভেবেছিলেন, পুলিশ গিয়েছে মানেই জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। তাঁরা জানতেনই না সমেরণ বিবি পঞ্চায়েত অফিসের বাইরে গণ্ডগোল হচ্ছে দেখে থানায় ফোন করেছিলেন। স্থানীয় লোকজন পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন, কেউ কেউ পুলিশকে ধাক্কাধাক্কিও করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকর্মী গুলি চালিয়ে দেন। এতে আগুনে ঘি পড়ে। উত্তেজিত জনতা পুলিশকে তাড়া করে। ভয়ে পালাতে শুরু করে পুলিশ। এক পুলিশ কর্মী বাঁচতে একটি পুকুরে ঝাঁপ দেন। বাকি ২-৩ জন মাঠ দিয়ে দৌড়তে শুরু করেন। পুলিশ পালিয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন ভূতার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের খালি জিপে আগুন ধরিয়ে দেন। গোটা ঘটনাটা ঘটে সকাল ১১টা থেকে ১২টা-সাড়ে ১২টার মধ্যে। গড়চক্রবেরিয়ার পরিস্থিতি তখনকার মতো শান্ত হয়। কিন্তু রাস্তায় পুরুষ-মহিলাদের ব্যাপক জামায়েত ছিল। লোকের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, এরপর আরও বড় পুলিশ বাহিনী আসবে। এরই মধ্যে ঘটে যায় আরও একটা ঘটনা।
গড়চক্রবেড়িয়াতে উত্তেজিত জনতার তাড়ায় পুলিশ পালিয়ে যায়, কিন্তু হেঁটে তাঁদের থানায় পৌঁছতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। লোকজন পুলিশকে তাড়া করেছে, মারধোর করেছে এই খবর থানায় পৌঁছেছিল আগেই। কিন্তু কালীচরণপুর থেকে অফিসাররা দীর্ঘক্ষণ না ফেরায় নন্দীগ্রাম থানার অফিসারদের ধারণা হয়, গ্রামবাসীরা পুলিশকে আটকে রেখেছে। এই খবর পাঠানো হয় তমলুকের সিনিয়র অফিসারদের কাছে। তমলুকের সিনিয়র পুলিশ অফিসাররা খেজুরি থানাকে নির্দেশ দেন, গড়চক্রবেড়িয়াতে অফিসার পাঠিয়ে ব্যাপারটার খোঁজ নিতে এবং আটকে রাখা অফিসারদের উদ্ধার করতে। সেই মতো দুপুর দেড়টা-দুটো নাগাদ খেজুরির জনকা ফাঁড়ি থেকে চার জন পুলিশ কর্মী একটা জিপে করে ভাঙাবেড়া ব্রিজ হয়ে নন্দীগ্রামে ঢোকেন। সোনাচূড়া পর্যন্ত গিয়ে তাঁরা এলাকা পুরো ফাঁকা দেখে এগোতে থাকেন গড়চক্রবেড়িয়ার দিকে। তখনও গড়চক্রবেড়িয়া মোড়ে প্রচুর মানুষের জটলা। আবার পুলিশের গাড়ি ঢুকতে দেখে মানুষ কিছু না বুঝেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। স্থানীয় মানুষ ভাবেন, একবার ফিরে যাওয়ার পর এবার বেশি ফোর্স আসছে খেজুরির দিক থেকে। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে তাড়া করেন খেজুরির দিক থেকে আসা পুলিশের গাড়িটাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে খেজুরির জনকা ফাঁড়ির পুলিশ কর্মীরা তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে ফের সোনাচূড়ার দিকে ফিরতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে খবর পেয়ে সোনাচূড়া মোড়েও লোক জড়ো হতে শুরু করেছেন। গড়চক্রবেড়িয়া থেকে আন্দোলনকারীরা ফোনে সোনাচূড়ার নেতাদের জানিয়ে দেন পুলিশের গাড়ির কথা। মুহূর্তের মধ্যে সোনাচূড়া মোড়ে বহু মানুষ জমা হয়ে যান। জনকা ফাঁড়ির পুলিশ দেখে, পেছনে গড়চক্রবেড়িয়ার লোক তাড়া করছে, আর সামনে সোনাচূড়ায় জমায়েত। সামনে জমায়েত দেখে সোনাচূড়া মোড়ের ১৫০-২০০ মিটার আগেই গাড়ি থামিয়ে দিয়ে খেজুরির পুলিশও মাঠ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের তাড়া করেন স্থানীয় মানুষ। কিছু লোক গিয়ে ভূতার মোড়ের মতোই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের ফাঁকা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মহিলারাও লাঠি, বঁটি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন। শেষমেশ মহিলারাই সোনাচূড়া হাইস্কুলের পিছন থেকে ধরে ফেলেন চার পুলিশ কর্মীকে। তারপর তাঁদের মারধোর করে আটকে রাখেন। পরে বিকেলে চার পুলিশ কর্মীকে ছেড়ে দেন স্থানীয় লোকজন। এরপর বিকেল থেকেই পুলিশের ঢোকা আটকাতে নন্দীগ্রামের চৌরঙ্গি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা কাটা শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যে ফোনে ফোনে তৈরি হয়ে যায় প্ল্যানিং। সেই সঙ্গে শুরু হয় আন্দোলনকারীদের দাপট। যে যাঁর মতো নিজের এলাকায় রাস্তা কাটতে শুরু করেন। পুলিশের ভুল বোঝাবুঝির এই খবর জানতেনই না নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকের মানুষ। বরং দু’দিক থেকে পুলিশের গাড়ি আসা দেখে তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা হয়, সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেছে প্রশাসন। এবং শুরুতেই কঠোর হাতে এর মোকাবিলা করতে হবে। বিডিও অফিসে ধরনা, জেলা শাসককে ডেপুটেশন দিয়ে কিছু হবে না। পুলিশ ঠেকাতে না পারলে অচিরেই পরিণতি হবে সিঙ্গুরের মতো। আর আটকানো যাবে না জমি অধিগ্রহণ। নন্দীগ্রামের মানুষের এই একরোখা মনোভাব এবং জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা জানতেন শুভেন্দু অধিকারী। তাই ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বলেছিলেন, নন্দীগ্রাম কিন্তু সিঙ্গুর নয়। ২০০৪ সালে তমলুক লোকসভা নির্বাচনে লড়ার সুবাদে নন্দীগ্রাম চিনতেন দক্ষিণ কাঁথি বিধায়ক শুভেন্দু।

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.