নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৭: সিপিআইএম নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দিল গড়বেতার সশস্ত্র বাহিনীকে, যারা ২০০০ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের হাতছাড়া এলাকা উদ্ধার করেছিল

আগের পর্বে যা ঘটেছিল: খেজুরি থেকে নন্দীগ্রামে আক্রমণ চালালো সিপিআইএম, বদলা নিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিও। হলদিয়ার মধুসূদন মন্ডল ওরফে নারায়ণের নেতৃত্বে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হল নন্দীগ্রামে।

 

সিপিআইএমের বিকল্প প্রস্তুতিঃ সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপ 

সিপিআইএম কীভাবে নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারে নেমেছিল সেই প্রসঙ্গ শুরু করার আগে উল্লেখ করব একটা ঘটনার।
সেটা ২০০০ সালের গোড়ার কথা। তখন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কেশপুর, গড়বেতা, চন্দ্রকোণা পুরো বারুদের স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইএমের প্রায় দু’বছর ধরে রক্তক্ষয়ী  সংঘর্ষ চলছে। খুন, জখম রোজকার ঘটনা। এই সংঘর্ষ, এলাকা দখল, পালটা দখল, খুনোখুনি শুরু হয়েছিল মূলত ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে। সেই বছরই ১ লা জানুয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নতুন দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তৃণমূল কংগ্রেস।
সিপিআইএম নামক একটি সংগঠিত এবং দুর্ধষ দলের সঙ্গে ভোটের লড়াই জেতা যে কতটা কঠিন তা বুঝতে দেরি হয়নি দীর্ঘদিন কংগ্রেস রাজনীতি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মমতা জানতেন, সর্বদলীয় বৈঠকে গঠনমূলক মতামত পেশ করে কিংবা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বিধানসভায় আলচনা করে ভোটের রাজনীতিতে ভারতসেরা সিপিআইএম নামক বিরাট সাম্রাজ্যকে মহাকরণ থেকে উৎখাত করা, আর ভাগ্যের হাতে নিজের রাজনৈতিক জীবনটাকে ছেড়ে দেওয়া একই ব্যাপার। একদিন না একদিন তো সিপিআইএম হারবেই ভেবে ঘরে বসে না থেকে ১৯৯৮ এর ১ জানুয়ারি থেকেই রাস্তায় নেমে পড়েন সিপিআইএম বিরোধী লড়াইয়ের চ্যাম্পিয়ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাত্র কয়েক মাসের দল, কোনও ইতিহাস নেই। আর তাই জাতীয় বা আঞ্চলিক কোনও বাধ্যবাধকতাও ছিল না তৃণমূল কংগ্রেসের। কোনও ইতিহাস না থাকা কখনও কখনও সুবিধেরও। কেউ জানে না, আগের গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যুতে তার অবস্থান কী ছিল।
আর সিপিআইএমের কাছে এ যেন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আচমকা উঠোনে তিনতলা বাড়ির সমান ডালপালা মেলা একটা পূর্ণবয়স্ক গাছ দেখার সামিল। আগের রাতে শুতে যাওয়ার সময় যেটাকে দেখা যায়নি। ফুল গাছ না ফল গাছ, কিছুই জানা নেই!
আর সিপিআইএম ঠিক করল, অন্তত ১৫ টা সম্পাদকমণ্ডলী, ১০ টা রাজ্য কমিটি, চারটে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং দুটো পলিটব্যুরো বৈঠক না ডেকে ঠিক বুঝে ওঠা যাবে না, এই গাছে হবেটা কী? ২০১১ সালের বছর দেড়-দুয়েক আগে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া পাকা হয়ে গিয়েছে, তখনও আশেপাশে কেউ শুনেছে কিনা না ভেবেই সিপিআইএমের কয়েকজন নেতা উঁচু গলায় বলতেন, মমতা পারবে না। দেখে নেবেন, ঠিক সময়ে গিয়ে একটা ভুল করে ফেলবে।
ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর রাজনীতিকে বারবার আন্ডার এস্টিমেট করার মাশুল সিপিআইএমকে ১৯৯৮ সাল থেক বহুবার দিতে হয়েছে। তাঁকে এই আন্ডার এস্টিমেট করা এমন জায়গায়, পৌঁছেছিল, ২০১১ সালের ২০ মে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরেও অনেক সিপিআইএম নেতা বলেছেন, ‘ও তিন বছরও সরকার চালাতে পারবে না। কোনও এক জায়গায় বসতেই পারে না টানা আধ ঘণ্টা!’
ব্যাক টু ২০০০, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। ১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটের পর থেকেই টেস্ট ক্রিকেটের রমরমা যুগে টি ২০ র মতো  বেপরোয়া ব্যাট চালাতে শুরু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গী বলতে প্রবল সাহস, হার না মানা জেদ এবং রাজ্যজুড়ে সিপিআইএম বিরোধী অধিকাংশ মানুষের সমর্থন। কংগ্রেসের দাঁত-নখহীন, নিরামিষ বিরোধী রাজনীতি দেখে দেখে রাজ্যের সিপিআইএম বিরোধী লোকজন যখন কার্যত পার্মানেন্ট শীতঘুমে চলে গিয়েছিলেন, সেই সময় অভূক্ত চিতা বাঘের মতো সিপিআইএমের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিন্দুমাত্র পিছুটানহীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই যুদ্ধে তিনি বাঁচবেন কী মরবেন জানা নেই, কিন্তু যে ক্ষিপ্রতায়, উদ্যমে সব শক্তি এক করে তিনি সিপিআইএম বিরোধী লড়াইয়ে নামলেন, তার তুলনা স্বাধীন ভারতে কোনও রাজ্যে বিরোধী রাজনীতিতে দুটো খুঁজে বের করা কঠিন। শীতঘুম ভাঙল পুরনো কংগ্রসিদের। সিপিআইএমের কাঁচাঘুম ভাঙতে একটু দেরি হল। আর এইসবের ফল, দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সব জেলায় শুরু হয়ে গেল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইএমের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। রোজ খবরের কাগজে রাজনৈতিক সংঘর্ষের হেডলাইন।
মেদিনীপুরের কেশপুর, গড়বেতা, চন্দ্রকোণা, সবং, পিংলার মতোই হুগলির আরামবাগ, খানাকূল, গোঘাট এবং বাঁকুড়া কোতুলপুর, জয়পুর সহ একটা বড় এলাকায় এই সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। এছাড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং থেকে গোসাবা, হাওড়ার উলুবেড়িয়া থেকে বীরভূমের নানুর, রাজ্যে একের পর এক এলাকা তখন বাস্তবিকই জ্বলছে। এলাকা দখল এবং ভয়ঙ্কর অস্ত্রের রাজনীতি শুরু হল রাজ্যজুড়ে। আচমকা ধাক্কায় প্রথমেই কিছুটা বেসামাল হয়ে গেল সিপিআইএম। দক্ষিণবঙ্গের বহু গ্রাম, এলাকা চলে গেল তৃণমূল কংগ্রেসের কব্জায়। শাসক দল সিপিআইএমের পালটা উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি ঠিকঠাক নিতে না নিতেই এসে গেল ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোট। আগের বছরের সাফল্য ধরে রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন শেষ যুদ্ধের, বিধানসভা ভোট ২০০১। পর পর দুই ধাক্কায় সিপিআইএমও ততদিনে বুঝে নিয়েছে, আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা মানে দু’বছর বাদে বিরোধী দলের আসনে বসার জন্য রেডি হওয়া।
অসংগঠিতভাবে কেশপুর, গড়বেতা, চন্দ্রকোণা, খানাকুল, গোঘাট, আরামবাগ, কোতুলপুর বা অন্যান্য এলাকায় প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছিল সিপিআইএম। কিন্তু তা খুব একটা দানা বাঁধছিল না। তাই আর প্রতিরোধ নয়, পালটা মারের রোড ম্যাপ তৈরিতে বসল শাসক দল। এলাকায় এলাকায় শুরু হয়ে গেল পুরোদমে রাজনৈতিক সংঘর্ষ। এলাকা দখল, পুর্নদখলের রাজনীতি। বাংলার রাজনৈতিক অভিধানে যুক্ত হল নতুন শব্দ, বিরোধীশূন্য এলাকা। যে এলাকায় থাকবে শুধুমাত্র একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। এক একটা এলাকা বা গ্রাম এক একটা হীরক রাজার দেশ। এই এলাকা বা গ্রামে কোনও বিরোধী নেই। বিরোধী মত নেই। কোনও এলাকা সিপিআইএমের, তো কোনও এলাকা তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। গ্রামে গ্রামে চূড়ান্ত একাধিপত্য। সশস্ত্র রাত পাহারা, দিনের বেলা চেক পোষ্ট। চেক পোষ্টে লাগাতার নজরদারি। কে ঢুকছে, কোথায় যাচ্ছে দেখার জন্য কর্মী নিয়োগ। এই সমস্ত এলাকায় শুরু হয়ে গেল ভয়ঙ্কর লড়াই, যা ছিল আসলে ২০০১ বিধানসভা ভোটের কাউন্টডাউন্ট। একদলীয় গণতন্ত্রের একটা অনুশীলন সিপিআইএম আটের দশকের শেষ থেকেই রাজ্যে চালু করার চেষ্টা চলাচ্ছিল। এবং পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও রাজনীতি সচেতন মানুষই জানেন, সিপিআইএমের এই একদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা যে জায়গাগুলোতে সাফল্য পেয়েছিল, সেখানেই রাজনৈতিক সংঘর্ষ তীব্র আকার নিয়েছিল রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের আবির্ভাবের পর থেকে। পেশি শক্তি ভাঙতে পেশি শক্তি প্রয়োগের পরীক্ষাগার হিসেবে উঠে এল অবিভক্ত মেদিনীপুর এবং দক্ষিণবঙ্গের আরও কয়েকটি জেলার কিছু অংশ। শত্রু পক্ষকে পরাস্ত করতে তার সবচেয়ে শক্তিশালী এলাকায় আক্রমণ করা যুদ্ধে অত্যন্ত পরিচিত কৌশল।
তখনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই সময় মেদিনীপুরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় কুমার সিংহ, তাঁর বিরুদ্ধে জেলার সিপিআইএম নেতাদের তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। সিপিআইএমের অভিযোগ ছিল, ওই আইপিএস অফিসার তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। পরে ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনের আগেই অবশ্য ওই আইপিএস অফিসারকে কলকাতা পুলিশের নিয়ে আসা হয়। সেই সময় মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপির একাধিক বাহিনী গড়ে ওঠে, তাদের কাজ ছিল মূলত এলাকায় পাহারা দেওয়া। এলাকা রক্ষা করা। অন্যদিকে, হাতছাড়া এলাকা উদ্ধারের জন্য সিপিআইএমও বিভিন্ন জায়গায় বাহিনী প্রস্তুত করে এবং ব্যপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সিপিআইএম তখন শাসক দল। স্বাভাবিকভাবেই টাকার যোগান অনেক বেশি। সমস্ত যুদ্ধেই প্রধান রসদ টাকা।
সেই সময় গড়বেতার দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিধায়ক এবং রাজ্যের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সুশান্ত ঘোষ। তৃণমূল কংগ্রেসের মূল টার্গেট ছিলেন এই ডাকাবুকো বিধায়ক। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, গড়বেতা-কেশপুর অপারেশনের রিমোট কন্ট্রোল সুশান্ত ঘোষের হাতে। মেদিনীপুর জেলা পুলিশ তখন বারবার সুশান্ত ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিল রাজ্য পুলিশের শীর্ষ অফিসার এবং খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে। সুশান্ত ঘোষের বিরুদ্ধে পুলিশের প্রধান অভিযোগ ছিল, তাঁর জন্যই জেলায় রোজ গণ্ডগোল হচ্ছে। ১৯৯৯ সালের শেষে এবং ২০০০ সালের গোড়া থেকেই সিপিআইএম প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল গড়বেতা, কেশপুরে। সেই সময় ওই সব এলাকায় কার্যত কোনও আইন-শৃঙ্খলা ছিল না। প্রায় রোজ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হোত খুন, জখম, সংঘর্ষ, বাড়ি ভাঙচুর, এলাকা দখল বা পুর্নদখলের খবর। ফলে চাপ বাড়ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ওপর। পুলিশ অফিসারা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বোঝালেন, সুশান্ত ঘোষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে গণ্ডগোল থামানো যাবে। পুলিশ জানত, তৃণমূল কংগ্রেসের কাউকে বলেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে বলে সুশান্ত ঘোষকে আটকে দিতে পারলে সিপিআইএম বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়বে। তাতে সংঘর্ষ ঠেকানো সহজ হবে।
সেই সময় সিপিআইএম পার্টিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি একদিন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে প্রস্তাব দিলেন, কিছুদিনের জন্য সুশান্ত ঘোষের জেলায় না যাওয়াই ভাল। সুশান্ত যেন কয়েক মাস মেদিনীপুর জেলায় না যান। সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যান্য সদস্যরা কয়েকজন মেনেও নিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দল ও সরকারের দু’নম্বর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রস্তাব। কিন্তু সিপিআইএমে সম্পাদকমণ্ডলীতে কোনও সিদ্ধান্ত নিলেই হয় না, তা রাজ্য কমিটিতে অনুমোদনও করাতে হয়। পরের রাজ্য কমিটির বৈঠকে বিষয়টা উঠতেই রে-রে করে উঠলেন মেদিনীপুরের সম্পাদক দীপক সরকার, বাঁকুড়ার সম্পাদক অমিয় পাত্র, হুগলির নেতা অনিল বসু সহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। সবারই এক বক্তব্য, এটা তো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া অসম্ভব।
এটা করা হলে তিন জেলাতেই দলের কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাবে। কারণ, সুশান্ত যা করেছেন, দলের অনুমোদনেই করছেন। এখন লড়াই থেকে মাঝপথে সরে এলে সিপিআইএমের সর্বনাশ হবে। বিধানসভা ভোটে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলির সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় মুখ থুবড়ে পড়বে পার্টি। যে বিপর্যয় সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না বাকি রাজ্যের পক্ষে। রাজ্য কমিটিতে প্রবল বাধায় নিজের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারলেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এরপরই সুশান্ত ঘোষের ওপর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাগ আরও বেড়ে  যায়। এটা ২০০০ সালের গোড়ার ঘটনা।
এই ঘটনার দু’তিন সপ্তাহের মধ্যেই একদিন বিকেলে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা রোড  লোকাল কমিটির সম্পাদক স্বপন মণ্ডল এবং জোনাল কমিটির সদস্য আতিয়ার রহমানকে সেখানকার বাজারের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতী। ১০-১২ জন দুষ্কৃতী যখন সিপিআইএমের এই দুই নেতাকে বন্দুক দেখিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, রাস্তার লোকজন তা দেখেও প্রথমে এগনোর সাহস পাননি। কিন্তু কিছু মহিলা তাদের তাড়া করেন। সুশান্ত ঘোষ সেই সময় গড়বেতায় ছিলেন। পার্টির দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে অপহরণের খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন করেন পুলিশকে। পুলিশ কাছাকাছি ছিল, এলাকার লোকজন এবং পুলিশ একসঙ্গে ধাওয়া করে। দুষ্কৃতীরা বিপদ বুঝে ওই দুই সিপিআইএম নেতাকে ফেলে পালায়। কিন্তু স্থানীয়  সিপিআইএম কর্মীরা একজন দুষ্কৃতীকে ধরে ফেলেন, তারপর পিটিয়ে মারেন তাকে। গোটা ঘটনাটা ঘটে বিকেল থেকে সন্ধের মধ্যে। তার কিছুক্ষণ বাদেই তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ফোন করে অভিযোগ করেন, সুশান্ত ঘোষের লোকজন তাঁদের এক কর্মীকে চন্দ্রকোণায় পিটিয়ে খুন করেছে। পুলিশের কাছে থেকে প্রায় একই রিপোর্ট পেয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নিজের দলের নেতাদের থেকে খবর নেওয়ার অভ্যেস বুদ্ধদেববাবুর কোনওদিনই খুব একটা ছিল না। তৃণমূল কংগ্রেসে নেতা এবং পুলিশ অফিসারের কাছে পাওয়া খবর পকেটস্থ করে সন্ধ্যায় মহাকরণ ছাড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিছুক্ষণ বাদে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসে ঢুকছেন, তখন জ্যোতি বসু বাড়ি যাওয়ার জন্য সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। বুদ্ধদেববাবু কিছুটা রাগত স্বরেই জ্যোতি বসুকে বলেন, ‘আমাকে পুলিশ মন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়তে হবে। সুশান্ত যা খুশি করছে। আজও কিছুক্ষণ আগে একজনকে পিটিয়ে মেরেছে।’
‘ঠিক আছে, আমি কাল দেখব ব্যাপারটা’, একথা বলে জ্যোতি বসু মুজাফফর আহমেদ ভবন ছাড়েন।
সেদিন ছিল শনিবার, পরদিন রবিবার সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটা নাগাদ সুশান্ত ঘোষ চন্দ্রকোণা রোড পার্টি অফিসের দোতলায় বসেছিলেন। একতলা থেকে এক কর্মী দৌড়ে গিয়ে সুশান্ত ঘোষকে জানান, কলকাতার রাজ্য অফিস থেকে ফোন এসেছে, জ্যোতি বসু তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। প্রায় দৌড়ে একতলায় নামেন গড়বেতার বিধায়ক।
জ্যোতি বসুঃ সুশান্ত কী করছ?
সুশান্ত ঘোষঃ পার্টি অফিসে একটা মিটিং করছিলাম।
জ্যোতি বসুঃ বুদ্ধ তোমার ওপর খুব রেগে গিয়েছে। তোমার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কাল ক্যাবিনেট মিটিং আছে, তুমি কি কলকাতায় আসবে?
সুশান্ত ঘোষঃ হ্যাঁ, আজ রাতেই কলকাতা যাব। কাল যাব ক্যাবিনেট মিটিংয়ে।
জ্যোতি বসুঃ ক্যাবিনেট মিটিংয়ের পর আমার ঘরে চলে আসবে। কথা আছে।
সেই রাতেই সুশান্ত ঘোষ কলকাতায় এসে তাঁর ব্যক্তিগত সচিবকে গড়বেতা, কেশপুর, চন্দ্রকোণায় যা যা ঘটনা ঘটেছে ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষ থেকে শুরু করে সেখানকার সেই মূহুর্তের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংক্ষেপে লিখে ৫-৬ টা কপি করে পরদিন সকালের মধ্যে রেডি করতে বলে দেন ব্যক্তিগত সচিবকে। পরদিন সকাল সাড়ে ১০ টায় মহাকরণে পৌঁছে নিজে ওই তিন পৃষ্ঠা লেখা দেখে নেন সুশান্ত ঘোষ। তারপর দু’চারটে সংশোধন করতে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন ক্যাবিনেট মিটিংয়ে। মিটিং শেষে জ্যোতি বসু তাঁকে বলেন ১৫ মিনিট পর তাঁর ঘরে যেতে। কিছুক্ষণ বাদে সেই তিন পৃষ্ঠা নোটের কয়েকটা কপি খামে ভরে নিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁরা বেরোতেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ঢোকেন গড়বেতার বিধায়ক। দেখেন, যেখানে আগে থেকেই রয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। জ্যোতি বসু তিনজনকে নিয়ে তাঁর অ্যন্টিচেম্বারে গিয়ে বসেন। মাঝখানের সিঙ্গল সোফায় জ্যোতি বসু। বাঁদিকের বড়ো সোফায় অসীম দাশগুপ্ত এবং ডানদিকের সোফায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাশে সুশান্ত ঘোষ।
জ্যোতি বসু: বুদ্ধ, সামনাসামনি কথা বলা ভালো। সুশান্ত, তুমি বল তোমার কী বক্তব্য।
সুশান্ত ঘোষ: আমি কী বলব, আপনি ডেকেছেন।
জ্যোতি বসু: বুদ্ধ, তুমি বল, কী ব্যাপার, কী হয়েছে?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: আমাদের সরকার, পুলিশের প্রচণ্ড বদনাম হচ্ছে। মেদিনীপুরে রোজ মারপিট, রোজ খুনোখুনি। রোজ সংবাদপত্রে খবর হচ্ছে এই সংঘর্ষ নিয়ে। দু’দিন আগেও তৃণমূল কংগ্রেসের একজন মারা গেল। পিটিয়ে মেরে ফেলল লোকজন। এতে দলেরও বদনাম হচ্ছে, সরকারও সমস্যায় পড়ছে। এই জন্য দলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ওঁর এখন জেলায় কয়েকদিন না যাওয়াই ভাল।
মেদিনীপুর পার্টি এবং সুশান্ত ঘোষের  বিরুদ্ধে রীতিমত উত্তেজিত গলায় এমনই নানা অভিযোগ টানা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে করে থেমেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুরো শুনে জ্যোতি বসু তাঁর ক্যাবিনেটের রাষ্ট্রমন্ত্রী এবং গড়বেতার বিধায়ক সুশান্ত ঘোষের কাছে জানতে চান, ‘তোমার কী বক্তব্য?’
সুশান্ত ঘোষ তাঁৱ লেখা রিপোর্টের তিনটে কপি খাম থেকে বের করে তিনজনের হাতে ধরিয়ে দেন। বলেন, ‘আপনারা লেখাটা পড়ুন, তারপর আমি বলব।’ জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং অসীম দাসগুপ্ত তিনজনেরই পড়া হয়ে গেলে সুশান্ত ঘোষ কয়েক মিনিট মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং হুগলির পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। পড়ে এবং শুনে রীতিমতো থম মেরে গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। তারপর মাথা তুলে বলেছিলেন, ‘ইউ আর রাইট। বুদ্ধ, ইউ আর রং। আমরা সরকারে আছি। আর আমাদেরই সমর্থক গরিব মানুষ এতদিন ধরে বাড়িছাড়া? এত মানুষ এলাকাছাড়া হয়েছে? পুলিশের কোনও ভূমিকা নেই? পুলিশ কেন তাদের রক্ষা করতে পারছে না? আর প্রশাসন কিছু করতে না পারলে, মানুষের নিজের জীবন-সম্পদ রক্ষা করার অধিকার নেই? এটা চলতে পারে কখনও? আক্রান্ত হলে মানুষ আত্মরক্ষা করবেই। এসব কখনও চলতে পারে না।’
মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে সেইদিন চুপ করে তাঁর অ্যন্টিচেম্বার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় উজ্জীবিত সুশান্ত ঘোষও ঘর থেকে বেরিয়ে যান। কথা বলার মতো সম্পর্কটুকুও প্রায় পাকাপাকি ভাবে শেষ হয়ে যায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সুশান্ত ঘোষের মধ্যে। তার কিছুদিন বাদেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সিপিআইএমের একটা কর্মী সভা হয়। সেখানে জ্যোতি বসু প্রথম প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘একটা জায়গায় এতদিন ধরে গোলমাল চলছে আর আমি কিছু জানি না! এটা চলতে পারে কখনও? আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার অধিকার আছে মানুষের।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাজে দলীয় নেতা এবং কর্মীদের সামনেই অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন জ্যোতি বসু। কিন্তু তখন জ্যোতি বসুর এই মন্তব্য নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি। কারণ, তা খুব একটা জানাজানি হয়নি। এই একই কথা মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরেও একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেন জ্যোতি বসু। ২০০১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মেদিনীপুরের ধর্মার মোড়ে এবং কলকাতায় শহিদ মিনারের একই কথা বলেছিলেন রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, যা নিয়ে তীব্র বিতর্কও হয়েছিল সেই সময়।
২০০০ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি। পাঁশকুড়া লোকসভা উপনির্বাচনের ঠিক কয়েকদিন পরে। সেই নির্বাচনী লড়াইয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে দাঁড়িতেই পারল না মেদিনীপুরর সংগঠিত সিপিআইএম-সিপিআই শক্তি। ২০০০ সালের মে মাসে প্রায় দু’বছর যাবত সন্ত্রাস কবলিত পাঁশকুড়ায় লোকসভা উপনির্বাচনে সিপিআইয়ের গুরুদাশ দাশগুপ্তকে হারিয়ে জিতলেন তৃণমূল কংগ্রেস বিক্রম সরকার। সেই ভোট পশ্চিমবঙ্গে জন্ম দিল এক নতুন মডেলের। জোর যার ভোট তার। রাজনৈতিক লাইন, সংগঠন, আদর্শগত অবস্থান, কাজ, কৌশল সবাই গৌণ। সংসদীয় গণতন্ত্রের সেরা পরীক্ষা ভোট জেতার এক এবং একমাত্র পুঁজি বলপ্রয়োগ।
কয়েক দিন আগেই পাঁশকুড়া লোকসভা আসন হাতছাড়া হয়েছে, জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক দুপুরে বিধানসভা থেকে বেরোচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। পোর্টিকোয় দাঁড়ানো গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, আর ঠিক তখনই বিধানসভায় ঢুকছেন সুশান্ত ঘোষ।

হাতের ইশারায় গড়বেতার বিধায়ককে কাছে ডাকলেন মুখ্যমন্ত্রী। গাড়ির সিটে বসে জ্যোতি বসু, জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সুশান্ত ঘোষ।
জ্যোতি বসু: আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি, আর কতদিন লাগবে?
সুশান্ত ঘোষ:  আপনি ফিরে আসুন। তার মধ্যে একটা কিছু দাঁড়িয়ে যাবে।
জ্যোতি বসু: আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। যা করতে হবে তাড়াতাড়ি করো।
সুশান্ত ঘোষ: ঠিক আছে। আপনি নিশ্চিন্তে যান। ফিরে আসার পর আশা করি একটা ভালো খবর দিতে পারব।
সেই দিনই বিকেলে জ্যোতি বসু ইজরায়েল চলে গেলেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শেষ বিদেশ সফর। বিধানসভায় নিজের ঘরে গিয়ে প্ল্যান চূড়ান্ত করে ফেললেন সুশান্ত ঘোষ। দিন ঠিক হল ২০ জুন। সেই দিন কলকাতা পুরসভার ভোট। সেদিনই গড়বেতা পুনর্দখলের অভিযান শুরু করার প্ল্যান ফাইনাল করে ফেললেন সেখানকার বিধায়ক এবং দাপুটে নেতা। গোটা রাজ্য, সংবাদমাধ্যম কলকাতা পুরসভার ভোট নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। সবার নজর থাকবে কলকাতার দিকে। গড়বেতায় অভিযান চালাতে গিয়ে বড়ো সংঘর্ষ বা দু’একটা প্রাণহানি ঘটলেও কেউ সেদিকে বিশেষ নজর দেবে না। তাই বেছে নেওয়া হল সেই দিন।
২০ জুন ২০০০, ভোররাত থেকে গড়বেতায় শুরু হল সিপিআইএমের সশস্ত্র অভিযান। সিপিআইএমের প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর সামনে দাঁড়াতেই পারল না তৃণমূল কংগ্রেস। মাত্র একদিনে পুনরুদ্ধার হয়ে গেল গড়বেতার বেশিরভাগ এলাকা। পুনরুদ্ধারে মানে সিপিআইএম বন্দুক বাহিনীর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার। ঘরছাড়া হলেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা এবং লড়াকু বাহিনী।
অভিজ্ঞতার নিরিখে এই সব এলাকার পাঁচটা সাধারণ মানুষ জানতেন, গড়বেতা, চন্দ্রকোণা, কেশপুর কোনও স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবের পরীক্ষাগার নয়। প্রজার নিজস্ব মতামত বলে কিছু হয় না এখানে। রাজা যেদিকে প্রজাও সেদিকে। রাজত্ব চলে গেল সিপিআইএমের হাতে, রাতারাতি প্রজাও দলবদল করে শাসকের আনুগত্য মেনে নিল। ১৯৭৭ সালে বাম জমানা শুরু হওয়ার প্রায় বিশ বছর পর রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির আঁতুড়ঘর হিসেবে গড়ে ওঠা গড়বেতা, চন্দ্রকোণায় ফের উড়তে শুরু করল লাল পতাকা। দক্ষিণবঙ্গে ঠিকমতো বর্ষা নামার আগেই তারপর মাত্র এক মাসের মধ্যে একে একে হুগলির খানাকূল, গোঘাট, আরামবাগ এবং বাঁকুড়ার হাতছাড়া এলাকা উদ্ধার করে ফেলল সিপিআইএম। একমাত্র বাকি পড়ে থাকল কেশপুর। সিপিআইএমের মেদিনীপুর পার্টির দুই গোষ্ঠীর নেতাদের প্রবল অন্তর্বিরোধ এবং আরও দু’একটা কারণে কেশপুর পুনরুদ্ধার নিয়ে চূড়ান্ত কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত কেশপুর সিপিআইএম পুনরুদ্ধার করল সেই বছর পুজোর পরে। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর জ্যোতি বসু যখন মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়লেন, ততদিনে প্রায় গোটা দক্ষিণবঙ্গই সিপিআইএমের ভাষায় সন্ত্রাসমুক্ত। মানে বিরোধী রাজনীতিতে পাকাপাকি ফতোয়া জারি হয়ে গেল গড়বেতা, কেশপুর, খানাকুল, আরামবাগকে কেন্দ্র করে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়। এরপর ২০০১ সালের জানুয়ারির গোড়ায় গড়বেতার ছোট আঙারিয়ায় শেষ একটা লড়াই হয়। সিপিআইএম বাহিনীর সঙ্গে সারা রাতের যুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের ১২-১৩ জনের মৃত্যু হয়। সেটাই মোটামুটি শেষ লড়াই। ছোট আঙাড়িয়ায় এত জনের মৃত্যুর পর প্রায় হতোদ্যম হয়ে পড়ল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনের মাস ছয়েক আগেই দক্ষিণবঙ্গের সমস্ত সন্ত্রস্ত এলাকায় লাল পতাকার দাপট এবং একাধিপত্য জানান দিয়েছিল সিপিআইএমের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের। ২০০১ এর হাই ভোল্টেজ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কার্যত সেই সময়ই লেখা হয়ে গিয়েছিল।

 

আগের পর্বে কী ঘটেছিল: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৬: আমি আর কয়েকজন এক্স-আর্মিম্যান স্থানীয় ছেলেদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলাম

 

১০ই মে ২০০১, একদফায় হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে মুজাফফর আহমেদ ভবনের নেতৃত্বে বামেরা পেয়েছিল ১৯৯ আসন। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। হ্যাঁ, এরাজ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রেও এটাই শেষ কথা। যে মডেলকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সিপিআইএম সফলভাবে প্রয়োগ করেছিল ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে। ত্রিস্তরীয় নির্বাচনে হাজার হাজার গ্রামের আসনে প্রার্থীই দিতে পারেনি রাজ্যের মূল বিরোধী শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস। রাজনীতিতে যুক্ত হল আরও একটা নতুন শব্দ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়। মনে আছে, ২০০৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে সিপিআইএমের এই নজিরবিহীনভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়কে যৌক্তিকতা দিতে গিয়ে সেই সময় সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘বিরোধীরা যদি প্রার্থী দিতে না পারে, আমরা কী করব? আমরা তো আর বিরোধীদের প্রার্থী সাপ্লাই করতে পারব না।’ বিরোধীদের সম্পর্কে দলের রাজ্য সম্পাদকের এই কটাক্ষ শুনে জেলায় জেলায় গর্বে বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি ফুলে উঠেছিল নানান স্তরের সিপিআইএম নেতাদের। কিন্তু এই কটাক্ষ, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের মডেল যখন তাঁদের দিকেই সুদে আসলে ফেরত এল ২০১১ পরবর্তী যুগে, তখন অনিল বিশ্বাস প্রয়াত হয়েছেন। মূল্য চোকাচ্ছেন সিপিআইএমের বিভিন্ন জেলা নেতা এবং কর্মী। গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অনুশীলন যে চিরস্থায়ী কোনও বন্দোবস্ত হতে পারে না তা নিয়ে ভেবে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্যে আর সময় নষ্ট করতে চাননি মুজাফফর আহমেদ ভবনের নেতারা।

 

এবার নন্দীগ্রাম 

২০০৭ সালে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই একদিকে যেমন নন্দীগ্রামে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে সরকারের উপর চাপ দিতে শুরু করেছিল জেলা সিপিআইএম, পাশাপাশি শুরু হয়েছিল বিকল্প পরিকল্পনাও। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসনিক দক্ষতার উপর কোনও দিনই বিশেষ আশা-ভরসা ছিল না লক্ষ্মণ শেঠের। প্রশাসক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে একইরকম ধারণা ছিল আরও অনেক সিপিআইএম নেতারই। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে সিপিএমের নানান স্তরের বহু নেতা রীতিমতো প্রকাশ্যেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৭ সালের গোড়াতেই লক্ষ্মণ শেঠ বুঝতে পারেন, ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রায় পুরোটাই ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। লক্ষ্মণ শেঠের লাগাতার দাবির সামনে দাঁড়িয়ে মুজাফফর আহমেদ ভবন সিদ্ধান্ত নিল, পালটা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে পার্টির পক্ষ থেকেও। আত্মরক্ষার অধিকার সবার রয়েছে। মডেল গড়বেতা, কেশপুর ২০০০।
সিপিআইএমের শীর্ষ নেতৃত্ব ঠিক করলেন, প্রশাসনকে ব্যবহার করে যেভাবে দরকার সেভাবে সরকার নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মোকাবিলা করবে। বিডিও থেকে মুখ্যসচিব, ওসি থেকে ডিজির প্রশাসনিক কাজকর্ম চলবে নিজের মতো। সেই সঙ্গে পার্টিকেও সমান্তরালভাবে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির এই সশস্ত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক মোকাবিলা করতে হবে। জেলা সিপিআইএমের আশঙ্কা ছিল, নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের মতো ২ নম্বর ব্লক এবং খেজুরিও বেদখল হয়ে যাবে। এই আশঙ্কা একেবারে অমূলকও ছিল না। কারণ, ৭ জানুয়ারির পর থেকেই শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারীরা বুঝতে পারছিলেন,এই জমি আন্দোলনকে সামনে রেখে দ্রুত গতিতে রাজনৈতিক এলাকা বাড়ানো সম্ভব। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোট, ২০০৯ এ লোকসভা। কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে খেজুরি এবং তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে নন্দীগ্রাম। নন্দীগ্রাম এবং খেজুরি দুই বিধানসভায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য মানে, জেলার দুটি লোকসভা আসনে কয়েক মাইল এগিয়ে থেকে লড়াই শুরু করা। তৃণমূল কংগ্রেসের এই পরিকল্পনা আঁচ করে নন্দীগ্রামে পালটা সশস্ত্র প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিল ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি। তখন জানুয়ারি প্রায় শেষ। কিন্তু কীভাবে হবে এই সশস্ত্র প্রতিরোধ?
নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সশস্ত্র আগ্রাসন মোকাবিলার দায়িত্ব দেওয়া হল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার্টিকে। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আড়াই বছরের লড়াইয়ে কেশপুর, গড়বেতায় প্রায় দেড়শো জনের সশস্ত্র প্রশিক্ষত বাহিনী তৈরি করেছিল সিপিআইএম। সিপিআইএমের এই বাহিনী ২০০০ সালের মাঝামাঝি গড়বেতা এবং শেষে কেশপুর পুনরুদ্ধার সম্পন্ন করে।

চলবে

 

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.